জীবনযুদ্ধের কারণে ব্যস্ততাই হোক বা বারংবার দেখার অভ্যাস, আজকাল চারপাশের অস্বাভাবিক ঘটনাক্রম আর তেমন ভাবায় না আমাদের। তবে সেই ঘুমন্ত আমাদেরও প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যায় সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া ভবানীপুরের ঘটনা। একজন প্রবীণ মানুষ চরম লাঞ্ছনার শিকার ও শেষে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন প্রকাশ্য দিবালোকে। কী ছিল তাঁর ভুল? না তিনি একজনের অসহিষ্ণু আচরণের প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁকে চড়চাপড় মেরে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেওয়ার পর সেখানেই মৃত্যু হয় মানুষটির।
অকুস্থল ভবানীপুরের বকুলবাগান রোড ও রমেশ মিত্র রোডের সংযোগস্থল। ঘটনা এই, রমেশ বহেল নামের এই প্রবীণ বাড়ি থেকে বেরিয়ে বেকবাগানে তাঁর সিকিউরিটি কনসালট্যান্ট সংস্থার অফিসে যাবেন। বাড়ির সামনে পার্ক করা গাড়ি বের করতে সামান্য সময় বোধহয় লাগছিল। পিছন থেকে একটি মোটরবাইক এসে দাঁড়ায় ও খুব খারাপভাবে অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে। প্রতিবাদ করায় রমেশবাবুকে চরম নিগ্রহ করে ওই বাইকারোহী।
রমেশ বহেলের ড্রাইভার তাঁর বাড়িতে খবর দেয় দ্রুত। ওঁর ছেলে ছুটে এসে বাবাকে পড়ে থাকতে দেখেন। ততক্ষণে বাইকচালক পলাতক। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তাররা রমেশ বহেলকে মৃত ঘোষণা করেন। আদতে হাসপাতালে যাওয়ার আগেই মৃত্যু হয়েছে প্রবীণ মানুষটির। ঘটনাস্থল থেকে অপরাধী পালিয়ে যাওয়ার পর চারটে দিন কেটে যায়। অনেক পরে ধরা পড়ে সে। পরিবারের অভিযোগ, অপরাধী একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাই সে আইনের শাসন এড়িয়ে যেতে পারে।
আরও পড়ুন: মিলনমেলার সিঁদুর-খেলা, সংস্কারের স্থান কোথায়?
আইন তার নিজের নিয়মে চলবে, বহু চর্চিত এই কথাটাই আমরাও এক্ষেত্রে বলব। এ বিষয়ে মত প্রকাশ আমাদের অধিকারের বাইরে। কিন্তু অপরাধ যে ঘটেছে এবং তার মাত্রাটাও চরম, সেকথা তো বলতেই হবে। এটা ঠিক, এ শহরের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু সেই সমস্ত প্রশ্নের গুরুত্বকে যেন ছাড়িয়ে গেছে এই প্রবীণ মানুষটির মৃত্যুর ঘটনা। আসলে যেটা ঘটছে, প্রত্যেকবারই আমরা ভাবছি, এর চেয়ে নিন্দাজনক কিছু হয় না! আর প্রত্যেকবারই নতুন করে তার থেকেও খারাপ কিছু ঘটছে।
সচরাচর এমন কিছু ঘটলেই আমরা তার সঙ্গে আইন-প্রশাসন-রাজনীতির সম্পর্ক বানিয়ে দায়িত্ব শেষ করি। ওদের দায়িত্ব নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সে তো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। এক্ষেত্রেও প্রশাসন তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করবে কি না, কোনও রাজনৈতিক দল অপরাধীকে আশ্রয় দেবে কি না, সেকথা সময়ই বলবে। এটাও বোঝা দরকার, বাস্তবে এই ইস্যুতে, মানে আইনের শাসন বিষয়ে, আমাদের ভূমিকা একান্তই গৌণ। বড়জোর প্রতিবাদ করতে পারি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় বা মোমবাতি মিছিল। কিন্তু তাতে কি সমস্যা কমবে?
তাহলে কোথায় আমাদের ভূমিকা? শুধু ভূমিকা নয়, মুখ্য ভূমিকা! সেটা হলো এই জাতীয় ঘটনা বন্ধ করায়। যে লোকটি অপরাধ করে, সে কে? সে কি আমাদের অচেনা কেউ? তা কিন্তু নয়। সে আমাদেরই কেউ। আমাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। আমরাই তার ঔদ্ধত্য, অসভ্যতা, দুর্ব্যবহার, অসহিষ্ণুতা, ধৈর্যের অভাব ইত্যাদি দোষ, যা সমাজের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক, তাকে পরিপুষ্ট হতে সাহায্য করেছি। আমরা ঘরে-বাইরে কোথাও তার অন্যায় ব্যবহারের প্রতিবাদ করিনি। আমরা ভয়ে, আত্মস্বার্থ রক্ষা বা আপন ধান্দায় কিংবা উদাসীনতায় চুপ করে থেকেছি।
আরও পড়ুন: অনলাইন বিতণ্ডা এবং শালীনতার সীমা-পরিসীমা
প্রিয় পাঠক, একটু তলিয়ে দেখলেই বিষয়টি অনুভব করতে পারবেন। সব কিছুরই একটা গোড়ার কথা থাকে। এই জাতীয় অপরাধেরও। অপরাধী একদিনে তৈরি হয় না। একজন মানুষের এমন চরম অসহিষ্ণুতা হঠাৎ করে প্রকাশ পায় না। শৈশবে আদর-আহ্লাদের বাড়াবাড়ি। অপরের প্রতি বাড়ির শিশুটির ব্যবহারের মধ্যে কোনও বৈকল্য থাকলে, সে ব্যাপারে উদাসীনতা আমাদের চেনা চরিত্র। কৈশোর-যৌবনে তাকে ঘরে-বাইরে হিরোগিরি করলে তালি দেওয়া, এটাও অনেক সময় না বুঝেই করে থাকি আমরা। এভাবেই একজন মানুষের কুঅভ্যাসগুলির বাড়বাড়ন্ত হয়। যার পরিণতি পথেঘাটে কথায় কথায় সামনের মানুষটির প্রতি ঔদ্ধত্য, অসহিষ্ণুতা, অভব্য আচরণ এবং গালিগালাজ ও মারধরের চেষ্টা। চরম পরিণতি মৃত্যু, যা কলকাতাবাসী চাক্ষুষ করল অতি সম্প্রতি।
একটা সময় 'পাড়ার মস্তান' বলে চিহ্নিত কিছু লোক থাকত সব পাড়াতেই। তাদের সঙ্গে রীতিমতো দূরত্ব বজায় রাখতেন পাড়ার মানুষ। এখন উল্টো। এখন মস্তানদেরই রাজত্ব। যারা ভদ্র ও সভ্য, তারা এখন কোনও কাজে লাগে না। তাদের ভীরু ও কাপুরুষ বলা হয়। তারা কখনও প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলে, পাশে কেউ দাঁড়ায় না। মস্তানদের পদলেহন করে করে মেরুদন্ড বেঁকে গেছে আমাদের। শিরদাঁড়া সোজা মানুষ দেখার অভ্যাসটাই যেন চলে গেছে। আর এখান থেকেই বদলে যাচ্ছে সব পুরোনো ধ্যানধারণা ও সমীকরণ। এই বিন্দু থেকেই ঔদ্ধত্য ও অসহিষ্ণুতার দাপট নিয়ে পরিবেশকে অশান্ত করে তুলছে একদল মানুষ। এই পরিস্থিতি থেকেই এমন করুণ পরিণতি এই প্রতিবাদী মানুষটির।
খবরে প্রকাশ, খুব জোরে হর্ন বাজানো প্রসঙ্গেও বলেন উনি সেদিন। পথেঘাটে চলতে ফিরতে আমরাও কি বিরক্ত হই না? যেভাবে গাড়ি, বিশেষত মোটরবাইকের হর্ন বাজে, যে পরিমান শব্দ ও গতির ঝড় তুলে আরোহীরা যাতায়াত করে, তাতে সকলেরই যথেষ্ট অসুবিধা হয়। আক্ষেপ, আজকের পরিবেশ এমন যে এই অসুবিধার প্রতিবাদ করতেও ভয় পাই আমরা। সম্মান হারাবার ভয়। নিগৃহীত হওয়ার আশঙ্কা। বলা যায়, এখান থেকেই শুরু প্রশাসনের ভূমিকা। সাধারণ মানুষের অভিযোগকে যথার্থ মাত্রায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না, এমন কথা বারবার উঠেছে। প্রতিবাদীকে খুনের হুমকি দেওয়া, হুমকিতে কাজ না হলে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেওয়া, এমন ঘটনারও অভাব নেই। অপ্রিয় সত্য হলো, বহু ক্ষেত্রে প্রশাসন এসব বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে না। কঠোর বাস্তব হলো, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা আজ সোনার পাথরবাটিতে পরিণত।
আরও পড়ুন: আত্মহনন ও প্রতিরোধ
অপরাধী পেশায় আইনজীবী, কেউ কেউ এই প্রসঙ্গটি তুলছেন। তাঁদের বক্তব্য, আইনের সঙ্গে যুক্ত একজন কী করে এই জাতীয় আচরণ করে? এটা নিছকই এক অবান্তর প্রশ্ন। কোনও পেশার কোনও মানুষই এই আচরণ করতে পারে না। কোনও যুক্তিতেই সমাজের একজন অপর মানুষকে অপমান, নিগ্রহ, লাঞ্ছনা করতে পারে না। প্রবীণ না হয়ে তরুণ হলেই বা কি হতো? সবলে-সবলে হলে যে কেউ মারা যেতে পারত। সবলে-দুর্বলে হলে দুর্বল। মোদ্দা কথা, প্রক্রিয়াটাই তো অসুস্থ। কথা ও আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যা ও বিতর্কের সমাধান সম্ভব।
অর্থাৎ ঘুরেফিরে উঠে আসছে আমাদের নিজেদের দায়িত্বের দিকটিই। নিজেদের, পরিবারের সদস্যদের চিন্তা ভাবনার জগৎটিকে প্রকৃত সমাজমনস্ক করে তুলতে হবে। ঔদ্ধত্য, দুর্ব্যবহার, অসহিষ্ণুতা, অল্পতেই মাথা গরম করে ফেলা - এই বিষয়গুলিকে সূচনাতেই দমন করা প্রয়োজন। আরও বেশি বেশি মানবিক গুণের চর্চা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে সর্বস্তরে। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াটা কোনও ইউটোপিও থিওরি নয়। ন্যূনতম সংবেদনশীলতা কোনও অসম্ভব জীবনাভ্যাস নয়। একটু চেষ্টা করলেই আমরা এটা অর্জন করতে পারি।
আর প্রশাসনের পক্ষে যে ত্রুটিবিচ্যুতি, আইনের যে জটিলতা, রাজনীতির কূটকচালি - সেসব আছে, থাকবে। নির্মম বাস্তব হলো, এখানেও তো আমরাই আছি। সমাজ আসলে একটা অদৃশ্য শৃঙ্খল। এই শৃঙ্খলের প্রত্যেককেই বেঁধে থাকতে হবে একে অপরের পরিপূরক হয়ে। এই শৃঙ্খল ভাঙলে, আজ যে ভাববে, 'আমি তো ভালোই আছি', কাল সেও একই অবস্থার মুখোমুখি হতে পারে। মনে করুন সেই পুরোনো প্রবাদ, প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগলে বা আগুন ধরালে, আপনার ঘর বাঁচবে তো? আপনি যে আচরণ করে (শুধু গালিগালাজ নয়, মারতে মারতে মেরে ফেলার মতো কান্ড ) এখন উদ্ধার পেলেন, সেই একই পরিস্থিতির শিকার হবেন না তো আপনি নিজে? অথবা আপনারই পরিবারের কোনও সদস্য বা বন্ধুবান্ধব!