হিলাল আমেদ-এর লেখা ‘সিয়াসি মুসলিমস, এ স্টোরি অফ পলিটিক্যাল ইসলামস ইন ইন্ডিয়া’ বই থেকে একটি তথ্য দিয়ে এবারের বেঙ্গল লাইন শুরু করছি। তথ্যটা হল, ১৯৫২ সালে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সারা দেশে গড়ে ৪৪ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছিলেন।
কিন্তু মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ভোট পড়েছিল ৬০ শতাংশের বেশি। শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীরা যাদের মাঝে মধ্যেই অন্যের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখা যায় এবং তাদের পাকিস্তান যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, তাদের জন্য এই তথ্যটা জরুরি।
কী হচ্ছে দেশ জুড়ে? ৩৭শতাংশ ভোট পেয়ে বিজেপিজোট ক্ষমতায়, প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্র মোদী। এই ৩৭ শতাংশের মধ্যে অন্তত ১০-১২ শতাংশ ভোট আছে, যেটা সাভারকারবাদীদের ভোট নয়, হিন্দুত্ববাদীদের ভোট নয়। এঁরা বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন ‘অচ্ছে দিন’ চেয়ে। গণপিটুনিতে দলিত এবং সংখ্যালঘু হত্যায় এদের সায় নেই। বিজেপি সরকার যে ভাবে চলছে, তাতে দলের নেতারা যদি এখনও সজাগ না হন, এই ১০-১২ শতাংশ ভোট বিজেপির থেকে সরে আসতে পারে।
আজ গান্ধী বেঁচে নেই। থাকলে দেখতে পেতেন, তাঁরই শেখানো সত্যাগ্রহ নতুন রূপ নিয়ে শাহিনবাগ থেকে পার্ক সার্কাসে, সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষায় রাত জাগছে। দলহীন, পতাকাহীন হিংসামুক্ত এই বিদ্রোহ আমাদের দেশে এই প্রথম, ফুলের মতো ফুটে উঠেছে।
কী হচ্ছে দেশ জুড়ে। মোদী সরকার বুলেট ট্রেন চালাতে চায় হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে, প্যাটেল মূর্তি বানিয়েছে তিন হাজার কোটিতে, কিন্তু মিডডে মিলে বরাদ্দ বাড়াতে চায় না। এরই মধ্যে গত ১৫ জানুয়ারি ‘এ এস ই আর’ (অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অফ এডুকেশন রিপোর্ট, রুরাল ) দেশের শিক্ষা নিয়ে তাদের সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে শিশুরা পিছিয়ে পড়ছে লেখাপড়ায়। বিস্তারিত সমীক্ষার একটি অংশ বলছে, পড়ুয়ারা রিডিং পড়তেই শিখছে না। চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়ারা, যারা ঠিক মতো দ্বিতীয় শ্রেণির বই রিডিং পড়তে শিখেছে, তাদের সংখ্যা এখন ১০০ জনে ৪৪.২ জন। এটা সারা দেশের গড়। ২০০৮ সালে এই গড় ছিল ৫৩.১। উত্তরপ্রদেশে বর্তমানে এই হার ৩৬.২। পশ্চিমবঙ্গে ৫০.৫। প্রথম কেরল, ৭৩.১। সব থেকে পিছিয়ে অসম, ৩৩.৫। আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশা, ৫৬.২ শতাংশ।
দেশ জুড়ে কী হচ্ছে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাঙালি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি একটি টিভি চ্যানেলে এক আলোচনায় বলেছেন, ‘বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তি নিয়ে চিন্তিত যে কোনও ভারতীয়ই উদ্বিগ্ন। বর্তমান ভারতের সঙ্গে জার্মানির নাৎসি শাসনের দিকে এগিয়ে চলার বড্ড বেশি মিল দেখা যাচ্ছে।‘
কিন্তু বিষয়টি এখানেই থেমে নেই। বিজেপির বঙ্গপ্রধান দিলীপ ঘোষ বলেছেন, বুদ্ধিজীবীরা নির্বোধ। তাঁর আরও মন্তব্য, সরকারি সম্পত্তি যারা ধ্বংস করেছে সেই সব শয়তানদের গুলি করে মারা হয়েছে অসমে, কর্ণাটকে, উত্তরপ্রদেশে। এই রাজ্যেও তাঁরা কখনও ক্ষমতায় এলে তাদের গুলি করে মারা হবে।
একসময় সিপিএম নেতা বলেছিলেন মমতাকে চুলের মুঠি ধরে সিঙ্গুর থেকে তুলে দেওয়া উচিত ছিল। পরে অনুব্রত বলেছেন, পুলিশকে বোমা মারতে এবং ভোট দিতে বেরোলে রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে থাকবে, এই হুমকির পেটেন্টও তাঁরই।
তবে দিলীপ ঘোষ বাহিনীর মণি-মুক্তোয় ওই সব হম্বি-তম্বির জৌলুস চাপা পড়ে যাচ্ছে। তবে সবাইকে হার মানিয়ে দিয়েছেন আমাদের লাটসাহেব, জগদীপ ধনখড়। তাঁর কথা, অর্জুনের তিরের ডগায় পরমাণু অস্ত্র লাগানো থাকত।
ধনখড় সাহেব এক কঠিন লড়াইয়ে নেমেছেন। রাজ্য সরকারের সঙ্গে তাঁর বিরোধ। মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গেও (মুখে বলেননি) তাই। পার্থবাবু নাকি কথা শোনেন না। উপাচার্যরা ‘সরকারের কথায় চলেন’। ওঁর কথা শোনেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে গোব্যাক শুনতে হয়। এই যে এতগুলো ফ্রন্টে ওঁর লড়াই, এ নজির বিহীন। মনে পড়ে যায় সুকুমার রায়ের জগাইয়ের কথা। ‘সাত জার্মান জগাই একা, তবুও জগাই লড়ে’।
হ্যাঁ ‘গো ব্যাক’। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও শুনতে হল। ধর্মতলায় ছাত্রদের কাছে। কলকাতায় যেদিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এলেন, তাঁর সঙ্গে মমতার বৈঠক নিয়ে ছাত্রদের ক্ষোভ। একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক করবেন, এতে দোষ থাকার কথা নয়। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, তিনি আর্থিক দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে গিয়েছিলেন রাজ্যের স্বার্থে। কিন্তু আর্থিক দাবি নিয়ে বৈঠকে অর্থমন্ত্রী এবং দফতরের অফিসারদের কাউকে দেখা যায়নি। সন্দেহ সেখান থেকেই।
তাছাড়া নাগরিকত্ব বিলের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে আলোচনার সময় সংসদে তৃণমূলের বেশ কয়েকজন সাংসদের বিস্ময়কর অনুপস্থিতি এই সন্দেহ বাড়িয়েছে। সন্দেহ বেড়েছে কারণ এই সব প্রশ্নের কোনও বিশ্বাসযোগ্য জবাব মেলেনি। জবাব অবশ্য আরও অনেক প্রশ্নের মেলেনি।
সব থেকে বড় প্রশ্ন, এই যে ৮ তারিখে একটা বনধ হয়ে গেল, সেখানে দেখা গেল বনধ সমর্থকরা সরকারি বাস জ্বালাচ্ছে। মালদহের ঘটনা। বনধ যদি মোদী সরকারের বিরুদ্ধে হয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই সরব, তখন কেন রাজ্যের বাসে হামলা? উত্তর নেই কোনও।
জেএনইউতে হামলাকারীদের নাম-ধাম সব ফাঁস হয়ে গিয়েছে। প্রত্যেক হামলাকারীকে চেনা যাচ্ছে। কিন্তু গ্রেফতার নেই। কেন? তারও জবাব নেই কোনও। উল্টে, মোদী সরকারের পশুমন্ত্রী গিরিরাজ সিং অর্জুণের তিরের পরমাণু বোমার মতোই এক নতুন আবিষ্কার করে আমাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তিনি জানতে পেরেছেন কেন যে ছেলে-মেয়েদের মিশনারি স্কুলে পাঠানো হয়, যারা পাশ করে আইআইটি ইত্যাদিতে পড়ে বিদেশ গিয়ে গোরু খেতে শুরু করে?
তাঁর নিদান, স্কুলে গীতার পাঠ দেওয়া হোক। তাহলেই এই বিপদ কাটবে। তিনি প্রায় হায় হায় সুরে মন্তব্য করেছেন, দেশের নাকি এতই খারাপ অবস্থা, তিনি সার্ভে করে দেখেছেন, ১০০ বাড়ি পিছু নাকি মাত্র ১৫টি বাড়িতে এখন হনুমান চালিসা আছে। হনুমানপ্রেম দীর্ঘজীবী হোক।
তবে অস্ট্রেলিয়ার প্রাণী ‘ওমব্যাট’-দের জন্যেও আমাদের একটু প্রেম জেগে উঠুক। ওমব্যাটকে বাংলায় কী বলা উচিত জানা নেই। ছোট ভালুকের মতো দেখতে। লম্বায় সাড়ে তিন ফুট মতো । ছোট ছোট পা। ছোট লেজ। মাটির তলায় বড় সুড়ঙ্গ করে থাকে।
অস্ট্রেলিয়ার অরণ্যে ভয়াবহ দাবানলে কয়েক কোটি প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। ভয় পাওয়া, ঝলসে যাওয়া প্রাণীদের বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে খবর, এই কাজে নাকি এগিয়ে এসেছে ওমব্যাটরাও। সে দেশের সংবাদমাধ্যমে এই নিয়ে বিস্তর লেখা-লেখিও হচ্ছে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ছোট ছোট প্রাণীদের নিজেদের গর্তে ডেকে এনে আশ্রয় দিচ্ছে ওমব্যাটরা। সব থেকে বড় কথা, কোনও কাগজ দেখতে চাইছে না।
অবশ্য কেউ কেউ দাবি করছে খবরটা গুজব।
(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)
এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে ক্লিক করে