Advertisment

প্রশ্ন-ফাঁস পরিকল্পিত চক্রান্ত, পালের গোদাদের খুঁজতে দায়িত্ব দেওয়া হোক গোয়েন্দাদের

তখন মোবাইল ফোনের এমন দাপট ছিল না। হোয়াটসঅ্যাপ জন্মায়নি। শেষের দিকে হোয়াটসঅ্যাপ জন্মালেও তখনও অ্যান্ড্রয়েড ফোন হাতঘড়ির থেকেও বেশি সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Madhyamik Question Out

ভবিষ্যতে হয়তো এমন দিনও আসবে যখন জেড-প্লাস ক্যাটাগরি নিরাপত্তায় এই সব খুদে পরীক্ষর্থীদের পরীক্ষা নিতে হবে

গত বছরের মতো এবারও মাধ্যমিকে প্রশ্ন ফাঁস হয়েই চলেছে। এর ভিতর একদিন আবার ভূগোলের ভুয়ো প্রশ্নপত্রও হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়েছিল। দশ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী, তাদের ২০ লক্ষ বাবা-মা এবং তাদের ৪০ লক্ষ ঠাকুর্দা-ঠাকুমা ও দাদু-দিদা। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা দিতে আসা খুদে পড়ুয়াদের বিভ্রান্ত করে দিতে পারলে সরাসরি এই ৭০ লাখ মানুষকে বিপর্যস্ত করা যায়। তার সঙ্গে আরও ৩০ লাখ পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ধরে, সংখ্যাটা প্রায় এক কোটি হতে পারে।

Advertisment

আসল প্রশ্ন জোগাড় করতে না পেরে ভূগোলের ভুয়ো প্রশ্নপত্র ‘ফাঁস’ করা দেখে এমন ভাবা ভুল হবে না, এর পেছনে সংগঠিত রাজনৈতিক চক্র কাজ করছে। যারা চায় এই এক কোটি মানুষ সরকারের উপর বিরক্ত হোক। আর এই ধাক্কার মুখে পড়ে আমাদের শিক্ষামন্ত্রী প্রায় ভীমের মতো কঠোরতর, কঠোরতম, কঠোরতম-তম শাস্তির হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন।

বাংলা ভাষা ও ভাবনায় ইংরেজি আধিপত্য

পর দিন সকালে ফের সেই এক ঘটনা। ইতিমধ্যেই মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে চেক করে পড়ুয়াদের পরীক্ষাকেন্দ্রে ঢোকানোর ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। কাশ্মীরের ঢংয়ে ইতিমধ্যেই বহু ব্লকে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যারা পরীক্ষা দিচ্ছে না, বিনা দোষে তাদের অন-লাইন কাজ কর্ম সব শিকেয়। মেল করা, টিকিট কাটা ইত্যাদি চুলোয়। প্রশ্ন করলেই জবাব, ‘চুপ পরীক্ষা চলছে’।

কল্পনা করা যায়, ভবিষ্যতে হয়তো এমন দিনও আসবে যখন জেড-প্লাস ক্যাটাগরি নিরাপত্তায় এই সব খুদে পরীক্ষর্থীদের পরীক্ষা নিতে হবে। বা সেনা নামাতে হবে পরীক্ষা হলে। তৈরি করতে হবে নির্বাচন কমিশনের মতো পরীক্ষা কমিশন। বেনিয়ম ধরা পড়লে হয়তো নতুন আইন করে ইউএপিএ তে পাকড়াও করে দোষীদের যাবজ্জীবন দিয়ে পাঠানো হবে জেলে। আমরা কি সেই দিকে যাচ্ছি?

প্রশ্ন আগেও ফাঁস হত। কম হত। খুবই কম হত। কংগ্রেস আমলে বেশ কয়েক বার এমন অভিযোগ উঠেছে। বাম আমলে ৩৪ বছরে যত দূর মনে পড়ছে একবারই অঙ্ক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল। ৯০-এর দশকে। পরীক্ষার আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক এবিটিএ-র শিক্ষক হাতে লেখা সেই প্রশ্ন দিয়েছিলেন তৎকালীন এবিটিএ-র কলকাতার সম্পাদককে। তিনি প্রশ্ন নিয়ে মধ্যশিক্ষা দফতরে জমা দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, আসলের সঙ্গে তার মিল আছে কি না? পর্ষদ প্রধান পত্রপাঠ জানিয়ে দিয়েছিলেন মিলিয়ে দেখা সম্ভব নয়। ভদ্রলোক এর পর সেই প্রশ্ন আলিমুদ্দিনে গিয়ে বিমান বসুর কাছে জমা দিয়েছিলেন। বিমানবাবু রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সরকারি ভাবে প্রশ্ন মিলিয়ে দেখতে পর্ষদকে বাধ্য করেন। দেখা যায় হুবহু এক। তখন ‘বিশেষ কারণে পরীক্ষা বাতিল’ ঘোষণা করে অঙ্ক পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদিও প্রশ্ন ফাঁসের কথা কোনও দিনই সরকারি ভাবে স্বীকার করা হয়নি।

বাংলা বানান দেখে রেগে যাবেন না

একটি সূত্রে খবর পেয়ে কলকাতার সেই শিক্ষক-নেতাকে এই নিয়ে প্রশ্ন করতে তিনি সরলভাবে বিস্তারিত ভাবে  সব কথা বলেছিলেন। তা থেকেই জানাজানি হয়। খবরের কাগজে সে কথা লেখাও হয়েছিল। সরকারের থেকে তারও  কোনও প্রতিবাদও করা হয়নি। এছাড়াও কয়েক বার পরীক্ষা চলাকালীন প্রশ্ন বাইরে এসেছে বাম আমলে। তবে পরীক্ষা চালু হয়ে গিয়েছে, এই যুক্তি দিয়ে তৎকালীন সরকার সেই সব ঘটনায় গুরুত্ব দেয়নি। পুলিশ উল্টে সাংবাদিকরা এই প্রশ্ন বের করার কাজে যুক্ত কি না, তা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছিল একবার। একটা কথা মনে রাখতে হবে, তখন মোবাইল ফোনের এমন দাপট ছিল না। হোয়াটসঅ্যাপ জন্মায়নি। শেষের দিকে হোয়াটসঅ্যাপ জন্মালেও তখনও অ্যান্ড্রয়েড ফোন হাতঘড়ির থেকেও বেশি সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি।

২০১১-এর পরে থেকে এই প্রশ্ন বেরিয়ে যাওয়াটা বাড়তে শুরু করে। এবং তা করোনা ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে গত বছর থেকে। মোবাইল ফোনের দৌরাত্ম্য সারা দুনিয়াকেই চোখের জলে নাকের জলে করাচ্ছে। কখনও ট্রাম্পের নির্বাচনে কারচুপি করে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ। কখনও বিজেপির আইটি সেলের বিরুদ্ধে ফেক নিউজের অভিযোগ, কখনও অজানা সূত্র থেকে ছড়িয়ে পড়া ফেক নিউজ, এ তো এখন নিত্যকার ঘটনা। পরীক্ষা তার বাইরে থাকবে কী করে? আজকের ডিজিটাল যুগে বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে এত বড় একটা পরীক্ষাকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা যে হতে পারে, এমন আগাম ধারণা প্রশাসকদের থাকা উচিত ছিল!

পরীক্ষার ক’দিন নানা রঙের পাঞ্জাবি পরে সাংবাদিক বৈঠকে আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর কিছু হম্বি-তম্বি আর বাণী ছাড়া সরকার এই নিয়ে গভীর ভাবে কিছু ভেবেছে বলে মনে হয় না।  পরীক্ষা মিটে গেলে আর প্রশ্নও নেই, শিক্ষামন্ত্রীর কোনও ভাবনাও নেই। ফের নিয়ম করে একই ঘটনা ঘুরে ঘুরে আসবে পরের বছর। ফের শিক্ষামন্ত্রী একই ভাবে একই কথা বলে, একই হুমকি-টুমকি দিয়ে ম্যানেজ করে কাটিয়ে দেবেন পরীক্ষার ক’টা দিন। এই ভাবেই চলছে।

কেমন আছে বাংলা অভিধান?

তাহলে উপায় কী? উপায় খুঁজে বের করতে হবে শিক্ষা দফতরের দক্ষ অফিসারদেরই। কিন্তু সব দেখে মনে হচ্ছে তারা ধরেই নিয়েছেন এই সব কিছুর জন্য দায়ী ১৫-১৬ বছরের ছাত্র-ছাত্রীরাই। সেটা কিন্তু না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অতীতেও দেখা গিয়েছে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে যুক্ত কিন্তু ঘরের লোকজনই। পড়ুয়ারা নয়। কেউ এক জন লেখা পড়া করেনি, মোবাইলে বন্ধুকে প্রশ্ন পাঠিয়ে টুকলির চেষ্টা করতে পারে। পারে না তা নয়। কিন্তু তাতে প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়বে না। এই ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে, আসল প্রশ্ন না পেলে পুরোনো প্রশ্ন ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে একটা স্পষ্ট পরিল্পনা দেখা যাচ্ছে। পরীক্ষার হলে মোবাইল ঢোকা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন ফাঁস মেটাল ডিটেকটর দিয়ে ধরা যাবে না। গোপনে গোয়েন্দাদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। কলকাতা পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত করে যদি এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া যায়, তারাই পারবে পালের গোদাদের খুঁজে বের করতে। শিক্ষামন্ত্রীর হাস্যকর হুমকি আর ধমকের ভয়ে এই জিনিস বন্ধ হবার নয়।

(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)

এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে ক্লিক করে

madhyamik exam Bengal Line
Advertisment