২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি গোটা দেশে মুক্তি পায় একটি হিন্দি ছবি, ছবিটির নাম ঠাকরে। ছবিটির পরিবেশক ছিলেন সঞ্জয় রাউত। সম্প্রতি মহারাষ্ট্রের সরকার গঠনের অতি নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহের বিতর্কিত শিবসেনা নেতা সঞ্জয় রাউত। উদ্ধব ঠাকরে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর যে সঞ্জয় রাউত আজ শিবসেনার দৈনিক মুখপত্র সামনার সম্পাদক। মহারাষ্ট্র বিধানসভায় উদ্ধব ঠাকরে ১৬৯ জন বিধায়কের সমর্থন নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দিলেন গত ৩০ নভেম্বর।
সেদিনই ছবিটি দেখলাম নেটফ্লিক্সে। বাল ঠাকরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী। পরিচালক অভিজিৎ পানসের ছবিটি শুরুই হচ্ছে আদালতে কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান বালাসাহেব। অভিযুক্ত তিনি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য। অভিযোগ মারাঠি অস্মিতার নামে দশদিনের গুণ্ডামির জন্য। ছবিটির শুরু সেখানে হলেও এরপর শুরু হচ্ছে ফ্ল্যাশব্যাক। ১৯৬৯ সালে ফ্রি প্রেস জার্নালের কার্টুনিস্ট মুম্বই নিবাসী মারাঠি সাংবাদিক বাল ঠাকরে কীভাবে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে এক নতুন জীবন শুরু করলেন। নতুন ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করলেন। তখন তাঁর মনের মধ্যে টগবগ করে ফুটছে মারাঠি মানুষ।
আরও পড়ুন, উপনির্বাচন: ভোটারদের ‘মন কি বাত’-এ বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত
দক্ষিণ ভারত, পাঞ্জাব, রাজস্থান, আর গুজরাটের মানুষ মুম্বই দখল করছে আর মারাঠিরা বেকার, তাঁরা যেন চায়ের দোকানে কাপ ধোয়ার জন্য রয়েছেন। ছবিতে দেখাচ্ছে মারাঠি মানুষের বেকারি দূর করার জন্য বিদ্রোহের ডাক দিচ্ছেন বালাসাহেব। তাই শিবসেনা নামক দলটির উদ্ভব। কিন্তু হিন্দুত্বর জন্য নয়। সংগঠনের শুরু মারাঠি স্বার্থরক্ষার জন্য। ছত্রপতি মহারাজ শিবাজীর নামে শিব সৈনিকদের দল। বাল ঠাকরের বাবাও ছিলেন তার পাশে। প্রতীক হলো বাঘ। অনেকের অভিযোগ, মারাঠি স্বার্থ রক্ষার নামে বালাসাহেব গুণ্ডাগর্দি করছেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠলেন জয় মহারাষ্ট্র স্লোগানের স্রষ্টা।
আজ এত বছর পর যখন পরিবারের কোনো সদস্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হলেন, কিং মেকার যিনি হতেন বারবার, দশকের পর দশক, আজ ২০১৯ সালে তিনিই হয়ে গেলেন কিং। প্রথমে শুধুমাত্র পুর নির্বাচনে অংশ নেন, আর আজ বিধানসভায় বালাসাহেবের পুত্র হলেন মুখিয়া। তাঁর পুত্র আদিত্যও আজ বিধায়ক।
১৯৮৯ সালে প্রমোদ মহাজনের মধ্যস্থতায় বাজপেয়ী জমানায় বিজেপির শরিক হল শিবসেনা। সেদিন থেকে আঞ্চলিক মারাঠি আঞ্চলিকতাবাদের প্রতিভূ শিবসেনা হয়ে উঠলো হিন্দুত্ববাদী পার্টি। আজ উদ্ধব মুখ্যমন্ত্রী হলেন সেই বিজেপির সঙ্গে দীর্ঘ শরিকি সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে। আবার তিনি মুখ্যমন্ত্রী হলেন কংগ্রেস এবং শরদ পাওয়ারের এনসিপি'র সমর্থন নিয়ে। কংগ্রেস এবং এনসিপি ধর্মনিরপেক্ষ দল বলে দাবি করে।
সরকারের স্থায়িত্ব রক্ষার জন্য জোট ধর্ম পালনের জন্য এখন কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম (অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি) তৈরি হয়েছে। সেই ঘোষিত পত্রে শিবসেনাকে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলতে হয়েছে। অর্থাৎ বাজপেয়ী যেমন তার পাঁচ বছরে বিজেপির কোর অ্যাজেন্ডা রাম মন্দির নির্মাণ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, এবং কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা অনুচ্ছেদ বাতিল তিনটি বিষয়কেই শিকেয় তুলে রাজত্ব করেন জোট ধর্ম রক্ষা করে। আজ উদ্ধবও রাম মন্দির ও এই বিষয়গুলিকে একই ভাবে ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে রাজ্যের উন্নয়ন ও প্রশাসনিকতায় মন দেবেন। কাজটা সহজ নয়। তবে কি শিবসেনা ও এক নতুন শিবসেনা হতে চাইছে? বালাসাহেব এবং উদ্ধবের মধ্যেও অনেক পার্থক্য।
বালাসাহেব সাংঘাতিক রাগী ছিলেন, উদ্ধব তা নন। কিন্তু তিনি সুসংগঠক। বাবা যতটা আক্রমণাত্মক ‘সরকার’ ছিলেন, ছিলেন প্রায় গডফাদারের মত, উদ্ধব তা নন। এখনতো উদ্ধবের পুত্র আদিত্য ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত, আধুনিক, ব্যক্তিগতভাবে খুবই কসমোপলিটন, এবং ধর্মনিরপেক্ষ।
আরও দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত এবার মহারাষ্ট্র নির্বাচনে ও তারপর সরকার গঠনের সময়ও মারাঠি অস্মিতা প্রতিটি আঞ্চলিক দলগুলিকে একত্রিত করে রেখেছে। তামিলনাড়ুতেও তামিল স্বার্থে ডিএমকে এবং এআইএডিএমকে মিলিত হয় না কখনোও। আর তাই তামিলনাড়ুর আঞ্চলিক দল দুটির মধ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণ তীব্র। সর্বদাই দিল্লির উপরে কোনও একটি দল নির্ভরশীল। পশ্চিমবঙ্গেও রাজনৈতিক বিরোধ, মতাদর্শগত বিরোধ, এত তীব্র যে আমরা বাঙালিরা কখনোই বিকশিত হতে পারিনি। তৃণমূল কংগ্রেস আঞ্চলিক দল হলেও এখনো কখনোই বাঙালির এথনিক ফ্যাক্টর-এর ওপর শতকরা ১০০ ভাগ নির্ভর রাজনীতি করে না। রাজ্যের সামাজিক মনস্তত্ত্বই আলাদা।
আরও পড়ুন, দিল্লি থেকে বলছি: মহারাষ্ট্র পরিস্থিতি ও কৌটিল্যের দুর্ভাগ্য
আর তাই শুরু থেকেই বালাসাহেবের সঙ্গে শরদ পাওয়ারের সম্পর্ক খুব ভাল ছিল। ষাটের দশকে যখন বাল ঠাকরে একটি মারাঠি সংবাদপত্র শুরু করার পরিকল্পনা নেন, তখন তার পার্টনার ছিলেন পাওয়ার। ঠাকরের বোন ঠাকরের বাড়িতে পাওয়ারের সঙ্গে বসে পত্রিকা পরিকল্পনা করেন। কিন্তু পত্রিকাটি প্রকাশের পর চলেনি এবং দুপক্ষই পত্রিকাটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
শরদ পাওয়ারের কন্যা সুপ্রিয়া যখন প্রথম রাজ্যসভার সদস্য হন তখন শিবসেনাও তাঁকে সমর্থন করেন। পাওয়ার তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বালাসাহেব নিজে ফোন করে পাওয়ারকে বলেন "ওকে কত ছোট দেখেছি। আর এখন ও রাজ্যসভার সদস্য হতে চলেছে, ওকে আমার শিবসেনা থেকে সমর্থন করব।" পাওয়ার তাঁকে প্রশ্ন করেন "বিজেপি কি আপনার এ কথা মানবে? ওরা তো চটে যাবে। ওরা তো আপনার শরিক।" জবাবে বালাসাহেব বলেন, "পদ্মফুলকে (পদ্মফুল বিজেপির প্রতীক) নিয়ে ভেবো না। কমল বাঈকে আমি যা বলব তাই শুনবে।"
বালাসাহেব চলে গেলেও এই সম্পর্কটা অটুট থেকে গেছে। শিবসেনার কাণ্ডারী উদ্ধবও বুঝতে পারছেন সময় অনেক বদলে গেছে। মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী যশোবন্ত রাও চবন আজ নেই, দিল্লিতে মোরারজি দেশাই উপপ্রধানমন্ত্রী এমন এক পরিস্থিতিও আজ নেই। সেই বেকারি, সেই উগ্র আঞ্চলিকতা, সেই মারাঠি বিচ্ছিন্নতা আজ কোথায়? আজ গোটা দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক এক অত্যাবশ্যকীয় রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য। কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত নয়, সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা দুপক্ষেই। সেই সারকারিয়া কমিশনের দিন তো আজ নয়, যখন সেই কমিশনের সুপারিশের প্রয়োগের মাধ্যমে রাজ্যের ক্ষমতা বাড়ানোর আন্দোলন চালাচ্ছিল কংগ্রেস বিরোধী সমস্ত তৎকালীন বিরোধী দলগুলি। তাই শিবসেনাও গুন্ডাগর্দির দলের ভাবমূর্তি বদলে এক নতুন শিবসেনা গড়তে চাইছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে কাজটা কতটা সম্ভব? দ্বিতীয়ত উদ্ধব সত্যি সত্যিই কি সেটা করতে চাইছেন? শপথ গ্রহণের সময় উদ্ধব কিন্তু শিব সৈনিকের গৈরিক পোশাক পরেই মঞ্চে আসেন এবং ভুলে গেলে চলবে না এই মঞ্চ থেকেই বালাসাহেব তাঁর শিবসেনার যাত্রা শুরু করেন। লালকৃষ্ণ আদবানি করাচি গিয়ে জিন্নাকে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি বলে দলের সভাপতির পদ খুইয়েছিলেন। বিজেপিকে নতুন ধর্মনিরপেক্ষ পথে নিয়ে যেতে গিয়ে নিজের হাতে তৈরি অনুগামী ও আরএসএস তথা সংঘ পরিবারের বিদ্রোহ সামলাতে পারেননি তিনি।
এক প্রবীণ সাংবাদিক আদবানির ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বলেছিলেন, বিড়াল যদি বলে মাছ খাব না, তবে নেভার ট্রাস্ট দ্যাট ক্যাট। অমিত শাহ পালটা রণ কৌশল রচনা করছেন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনছেন সংসদে শীঘ্র। এনসিপি কংগ্রেস বিরোধিতা করলেও শিবসেনা কি করবে? বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে যে শিবসেনা ছিল সবচেয়ে সোচ্চার দল, সেই দল কি আজ জোটধর্মের জন্য ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সেই কোর ইস্যুকে ভুলে থাকতে পারবে? উদ্ধব নিজেও এই কঠিন প্রতিকূলতা জানেন। তিনিও সাবধানে এগোতে চাইবেন। আপাতত তাঁর প্রথম সাংবাদিক বৈঠকে ওঠা প্রশ্নে রাগতস্বরে পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন, এই ধর্মনিরপেক্ষতা কাকে বলে?