বাজার যেতে কোনও দিন আমার ভাল লাগে না। শৈশবে নরেন্দ্রপুরে আবাসিক জীবনের সঙ্গে রোজকার পাড়ার বাজারের কোনও সম্পর্ক ছিল না। সম্ভবত এই কারণে বাজার করাটা শিখিনি। চাকরি জীবনের শুরুতে হাওড়ার মন্দিরতলায় আমাদের যৌথ পরিবার ছিল। তখনও আমার খুড়তুতো ভাই সঞ্জয় বাজারে যেত। আমি যেতাম না। বাজার মানেই তো প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা, গরু, কলাপাতা বা সবজির খোসা। মাছের বাজার তো আরও ভয়ঙ্কর। গড়পড়তা বাঙালির মত আমি মৎস্য প্রেমিকও ছিলাম না। তাই মাছের বাজারও কোনও দিন আকর্ষণ করেনি। দিল্লিতেও তিন দশকের বেশি সময় অতিবাহিত। বাজারে অনাগ্ৰহটা থেকেই গেছিল।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন
কর্মজীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে হটাৎই পাড়ার বাজার আমার অসীম আগ্ৰহের বিষয় হয়ে উঠলো। এটা করোনা কাণ্ডের আগে থাকতেই। এখন তো বাজারে যাওয়া যেন এক নিষিদ্ধ ফলের দিকে আকর্ষণ। যেও না, যেও না, সর্তকবাণীর মধ্যে মুখোশধারী হয়ে যাওয়া।
আমার সেজমামা বাজার করতে খুব ভালবাসত। ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ ম্যানেজার ছিলেন। বানিজ্য ও অর্থনীতির ভাল ছাত্র। আমরা ডাকতাম 'পল্টন মামা' বলে। কেন যে পল্টনমামা বলতাম আজও জানি না। তা পল্টন মামা বলেছিল, বাজারে যাওয়া অভ্যেস কর। বাজারে গেলে খুব সহজে সমাজটাকে জানতে পারবি। দেশের অর্থনীতিটা বোঝার সহজ 'পার্সওয়াড' হল বাজার। আর এত বছর পর, পল্টন মামা জানেই না আমি বাজারে গিয়ে সব জিনিসের দাম জানতে চাই। দামের ওঠানামা বুঝতে চাই।
এবার করোনা আক্রান্ত দুঃসময়ে বাড়ি থেকেই সাধ্যমত কাজ করছি গত তিনমাস। সারাদিন বাড়িতে থাকি। একঘেঁয়ামি কাটাতে মাঝে মাঝে নিকটবর্তী চিত্তরঞ্জন পার্কের এক নম্বর মার্কেটে যাই। আপনারা সবাই যেমনটা করছেন। এখানে এসে আমার বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন হচ্ছে।
কিছু উপলব্ধি আপনাদের জানাই। প্রথমেই বলি, যতদিন যাচ্ছে মনে হচ্ছে বাজারে দোকানদারদের অবস্থা আরও বেশি খারাপ হচ্ছে। গোটা বাজারটাতে শোকের ছায়া। এই বাজারটি কিন্তু খুব ডাউন মার্কেট নয়। একটু অগোছালো, খুব শোঅফ না থাকলেও দিল্লির বাঙালি বাজার এটি। মানে এখানে লালশাক, পোস্ত, কাসুন্দি, বর্ণপরিচয়, পাঁজি, পূজোর সময় সরস্বতী প্রতিমা, নাড়ু সর্বোপরি ফুচকা পাওয়া যায়। ফ্ল্যাশবাকে একটি দৃশ্য- বেশ বড়লোকরা আসতেন দেখেছি। আর্মির চিহ্ন লাগানো গাড়ি থেকে নেমে সেনা-গিন্নি বলছেন, এই জগু, ইলিশটা কত? ২০০০? তা বেশ কমেছে দেখছি। দিয়ে দে বড়টা।
এখানে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে একটানা খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন বিক্রি করছেন শম্ভু পট্টনায়ক। মেদিনীপুরের মানুষ। বাজারে সকলে তাঁকে শম্ভুদা নামেই চেনে। বাংলার খবরের কাগজ, পত্র-পত্রিকা এমনকি বাংলা বইও বিক্রি করেন শম্ভুদা। শম্ভুদা কে গত ত্রিশ বছর ধরে দেখছি। খুব কষ্ট করে দাঁড়িয়েছেন। প্রথমে প্রবল শীতে স্কুটার করে কোন ভোরে কাগজ নিয়ে আসতেন। এখন গাড়ি কিনেছেন।
এ মুহুর্তে নানা সমস্যায় ব্যবসা লাটে উঠেছে। প্রথমত কলকাতা-দিল্লি বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় দৈনিক বাংলা সংবাদপত্রগুলি আসছে না। দ্বিতীয়ত, ট্রেনে বা রাস্তায় এলেও অনেক দেরি হচ্ছে আসতে। ট্রান্সপোর্ট কস্ট বেড়ে গেছে। ২০০ টাকার বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পাঁজি ৩৫০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কজন কিনবে? শম্ভুদা বলছিলেন, মানুষ অহেতুক ভয় পাচ্ছে। খবরের কাগজ থেকে করোনা ছড়ায় না। বাজার শূন্য। খদ্দের কোথায়? এ বাজারটাতে নানা ধরনের দোকান। বাজারের কালী মন্দিরের সামনে নিয়মিত এসে বসে পুরুষ ও মহিলা ভিক্ষুক। মাঝে দুমাস লকডাউনের সময় মন্দিরও বন্ধ ছিল। ভিক্ষুকেরাও আসেনি। এখন মন্দির খুলেছে। বাইরে দড়ির ব্যারিকেড। রোজ দুপুরের ভোগ বিতরণ বন্ধ। দূর থেকে প্রণাম। কিন্তু পুণ্যার্থীরাই বা কোথায়? তাই ভিক্ষাপাত্রগুলিও শূন্য।
মন্দিরের পাশেই কলকাতার ঝালমুড়ি নিয়ে বসেন শীতল মন্ডল। শীতল দক্ষিণ ২৪ পরগণার মানুষ। কাঁদছেন। সারাদিন বসে আছি। কেউ আসছে না মুড়ি খেতে। দেখুন দেখুন আমি গ্লাভস পড়ছি। স্যানেটাইজার রেখেছি। তার জন্য আমার কত খরচ হয়ে যাচ্ছে দেখুন, এদিকে এই গরম মাথার ওপর সূর্য তখন এসে যায় কিন্তু খদ্দের আসছে না। সারাদিনে দুজন খদ্দের এল। ৪০ টাকা রোজগার।
শীতল বড় দুঃখী মানুষ। কদিন আগে ওর বাচ্চা মেয়েটি হটাৎ মারা গেল। সকালে এসে মন্দিরটা ধোয়া মোছার কাজ করে। কিছু টাকা পায়। কয়েকমাস আগে ওর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট (অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক) থেকে সঞ্চিত বহু টাকা পেটিএমের মাধ্যমে রহস্যজনক ভাবে কেউ তুলে নিয়েছে। এদিকে শীতলের নিজের পেটিম অ্যাকাউন্ট-ই নেই। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ বলছে, আমরা কী জানি! তোমার পাসওয়ার্ড কেউ চুরি করেছে। তোমার ATM থেকে টাকা তুলেছে। শীতল আমাকে দেখে হাত জড়ো করে কাঁদছিল।
স্বপন দাসের সেলুন। আর সিডি-ডিভিডি র দোকান। বিহারের কিষাণগঞ্জ আর পশ্চিমদিনাজপুর সীমান্তে ছিল বাড়ি। আশির দশকে এসে ভিডিও ক্যাসেট, পরে সিডি-ডিভিডির ব্যবসা শুরু করে। এখন তো ডিভিডির ব্যবসাই উঠে গেল। পাইরেসি আর ইউটিউব -মোবাইলের জন্য। অনেক টাকা ধার করে তখন ও একটা সেলুন বানায়। বন্ধ ছিল। এবার সেলুনটা খুলেছে। কিন্তু খদ্দের নেই। স্বপন বলছিল, দাদা, মানুষ ভাবছে সেলুনে চুল কাটলেই করোনা হয়ে যাবে। এদিকে দেখুন একজন ডাক্তার এখন এসেছেন চুল কাটতে। আমি সবরকম সাবধানতা রক্ষা করে ব্যবসা করি। তবু মানুষের প্যানিক। কাগজে দু লাইন লিখে দিন। যদি খদ্দের আসে। এ বাজারে মিষ্টির দোকান ছিল দুটো। একটা বন্ধ হয়ে গেল। বিক্রি বাট্ট নেই। মিষ্টি তৈরির কারখানার জন্য কারিগর রাখতে হয়। দোকানে কাজ করে দু-তিনটি ছেলে। এতজনকে বেতন দেওয়া। তার ওপর ঘর ভাড়া। তার চেয়ে দোকান বন্ধ করলেই লাভ।
একই যুক্তি শ্যামল বড়ুয়ার। ওদের ঘুগনি বাজারে ফেমাস। আজও ওর মা নিজে বাড়িতে ঘুগনি বানান। দুভাই এসে বাজারে সন্ধ্যায় তা বিক্রি করে। যে ঘুগনির রেসিপি কেউ জানে না। অসাধারণ স্বাদ। বাজারে ওদের দোকানে ফিসফ্রাই-ডিমের ডেভিল-চিকেন কাটলেট এসবও পাওয়া যেত। ব্যবসা নেই তাই ওরা ছেলেগুলোর পাওনা গন্ডা মিটিয়ে দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। ছেলেগুলো দেশে চলে গেছে বলে জানাল শ্যামল। শ্যামলদের দেশ ছিল চট্টগ্ৰামে। ওরা বাংলাদেশের বড়ুয়া। ধর্ম বৌদ্ধ। দিল্লিতে বৌদ্ধ মন্দিরে আজও যায় উপাসনার জন্য। বিশেষত বুদ্ধপূর্ণিমায়। তবে ওরা এতবছর ধরে এখানে থাকতে থাকতে ভুলেই গেছে না ওরা বৌদ্ধ না হিন্দু। কালীবাড়িতে গিয়ে রোজ মাথা ঠেকাতো। আবার বলে,আমরা আসলে বৌদ্ধ।
এই বাজারটি দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটির অধীনে। মাছের বাজারটির অবস্থাও তথৈবচ। বাঙালি বলছে মাছ খাবো না এ-ভাবা যায়। এক মাছ ব্যবসায়ীর বৌ স্থানীয় সরকারি হাসপাতালের নার্স। তার করোনা হয়। বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সে ব্যবসায়ীটি এখন বাড়িতে আছে। এ ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সে সেলফ কোয়ারেন্টাইনে আছে তবু মানুষের ভয়।
ভয়। ভয়। ভয়। ব্যবসা নেই। বাজার মুখ থুবড়ে। দুটো মিষ্টির দোকানের একটি মিষ্টির দোকান বন্ধ। কলকাতা বিরিয়ানি নামক দোকানটিতে ফাটাফাটি বিরিয়ানি পাওয়া যেত। আজ সেটিও বন্ধ। ফলওয়ারা ফলের দাম কমিয়ে বিক্রি করছে রাস্তার ধারে। অবশ্য কতিপয় দোকানদার এতটাই আক্রমণাত্মক হয়ে গেছে যে সহজ সরল খদ্দের পেলে ঠকিয়েও দিচ্ছে কেউ কেউ। অন্নপূর্ণা হোটেল ছিল ভাত-মাছের হোটেল। লোকে বসে খেত। বাঙালি রান্না। আলুপোস্ত থেকে মাছের ঝাল। দোকানটি বন্ধ করে দিয়েছে ওরা। দোকান যারা বন্ধ করেছে তাদের যুক্তি, বিক্রিবাট্টা নেই। এ অবস্থায় দোকান বন্ধ করে দেওয়াই ভাল। যাদের নিজেদের দোকান তারা তো তবু দোকান বন্ধ করে দিয়ে বাড়িতে বসে খরচা কমাচ্ছে। আর যাদের দোকান ভাড়া দিতে হয় তাদের অবস্থা আরও খারাপ!
সবচেয়ে বেশি মনটা খারাপ হয়ে গেল গোপালদার খবরটা শুনে। গোপালদা বাজারে বহু বছর ধরে হিংয়ের কচুরি, ছোলার ডাল বিক্রি করতেন। তারপর নানা ধরনের ঘরোয়া অনুষ্ঠানে রাঁধতে যেতেন। রান্নার নেশা ছিল ওঁর। সবসময়ই গোপালদা আদুর গায়েই থাকতো। বয়স হয়েছে, ছেলে মনোজ সাঁতরাই এখন ব্যবসা দেখে। আজও সে দোকান খুলেছে রাস্তার ওপর। নিজে হাতে এগরোল থেকে কবিরাজি কাটলেট বানায় সে। বললাম, হ্যাঁ রে বাবা কেমন আছে ? মনোজ বলেছিল, করোনার জন্য বাজারে আসতে দিচ্ছি না বাবাকে। বয়স হয়েছে তো। আর খদ্দেরও নেই। আমি একাই যথেষ্ট।
কিন্তু গতকাল গোপালদার সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে ভর দুপুরে খেয়ে ওঠার পর। হাতটা বেঁকে গেছে। মুখটাও। ভীত সন্ত্রস্ত মনোজ এইমস-এ ফোন করেছিল। ভর্তি? অসম্ভব। এমনকি সরকারি হাসপাতালে ওপিডিও বন্ধ। কোন হাসপাতালেই বেড নেই। বুঝলাম দিল্লিতে করোনা ছাড়া অন্য অসুখ হলে কী ভয়ানক পরিণতি হতে পারে। এ হল দেশের রাজধানী। আমরা তো আর জীবনে অমিতাভ বচ্চন হতে পারিনি যে লীলাবতী হাসপাতালের পাত্র মিত্র অমাত্য সবাই সব ভুলে তাঁকেই দেখবে। গোটা দেশ আরোগ্য কামনা করবে। বেচারা বর্ধমানের গোপাল সাঁতরা! পাড়ার ডাক্তারাও তাকে কেউ দেখল না। ডাঃ আগারওয়াল বলে এক চিকিৎসককে শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়, দেখেন তিনিই। সঙ্গে সঙ্গে ৩০০০ টাকার দক্ষিণা। এখন গোপাল বাড়িতেই। প্যারালাইসিসের সাধ্যমত চিকিৎসা করাচ্ছে বেচারা মনোজ।
ছোটবেলা থেকে জানি না কেন এসব মানুষজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে, আড্ডা মারতে খুব ভাল লাগত। নরেন্দ্রপুরে যতদিন ছিলাম ততদিন এ সুযোগ ছিল কম। পরে কলেজজীবনে মন্দিরতলার পাড়ায় আমার বেস্টফ্রেন্ড ছিল বিকাশ নামের এক রিক্সাওয়ালা। আমার মা-ও বিকাশকে খুব ভালবাসত। কে জানে হয়ত মার্কসবাদী ছিলাম তো বিকাশের সঙ্গে মিশলে নিজেকে হয়ত মনে হত, আমিই লেনিন।
তবে আজও এক নম্বর বাজারে গিয়ে এদের সঙ্গে গপ্পো করতে, সুখ-দুঃখের কথা বলতে খুব ভাল লাগে। এরা সবাই গরিব নয়। কিন্তু অসংগঠিত ক্ষেত্র। মানুষগুলোর কাছে ছেঁড়া জামা পরেও যাওয়া যায়, ফুলবাবু হয়ে যেতে হয় না। আসলে গরিব-বড়োলোক ছাড়াও আছে সামাজিক মর্যাদা বা Status-এর প্রশ্ন। আমার পাড়ার মুসলমান মাংসওয়ালাটি কিন্তু আমার চেয়ে বড়লোক। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু সমাজ ওকে সে সম্মান দেয় না ও Intellectual নয় বলে। বড়লোক মাংসওয়ালার চেয়ে আজও গরিব পুরোহিতের সম্মান বেশি।
আরও পড়ুন- অপরাধ-রাজনীতি হাতে হাতে ধরি ধরি
আনন্দবাজারে আমার সম্পাদক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় একবার আমাকে বলেছিলেন, একটা জিনিস লক্ষ করেছ কলকাতা শহরে বালিগঞ্জের মত ধনী-মধ্যবিত্ত পাড়ার পাশে পাশেই আছে গরিব মানুষদের বস্তি। কোন সংঘাত নেই। দুটো ভিন্ন সমাজে। এ এক শান্তিপূর্ণ শ্রেণীঅবস্থান !
আমি আজও এই বিষয়টি দিল্লিতে দেখি আর ভাবি। করোনা আক্রান্ত পুঁজিবাদেও গরিব-বড়োলোকের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। সাংবাদিক অনিতা প্রতাপের একটি লেখায় পড়লাম, আমেরিকাতেও উত্তর করোনা পরিস্থিতিতে বড়লোক আরও বড়োলোক হচ্ছে কারণ করোনায় সামাজিক Isolation-এ তাদের খরচ কমে গেছে। সঞ্চয় বাড়ছে। আর গরিব মানুষ Supply না থাকায় আরও গরিব হচ্ছে।
প্রণাম তোমায় বাজার-অর্থনীতি।