Advertisment

// নিষ্প্রভ মে দিবস //

এখন তো মে দিবস মানে একটি ছুটির দিন। এখন একে শ্রমিক দিবসের বিশেষ গুরুত্বে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
may day

সরকারি অফিস, ব্যাঙ্ক যা কিছুর কর্মচারিই ইদানীং শ্রমজীবী শ্রমিক বলেই গণ্য হচ্ছেন। ছবি- চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

অরুণ চক্রবর্তী

Advertisment

বিশ্বের অন্যত্র মে দিবস যেভাবে হাজার হাজার শ্রমিক ও মজদুরদের সম্মিলনে পালিত হয়, ভারতে তেমনটা দেখিনি। দেখিও না। কম্যুনিস্ট আর সোস্যালিস্টদের উদ্যোগে আর নেতৃত্বে বাংলায় পোস্টার কাঁধে দীর্ঘ শোভাযাত্রায় শ্রমিক মজদুরদের অধিকার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে সচতনতাকে জিইয়ে রাখার দুর্বল প্রকাশ ছাড়া এখন উল্লেখ্যোগ্য কিছুই আমার নজরে পড়ে না। সেও অনেক পুরানো অভিজ্ঞতা। এখন তো মে দিবস মানে একটি ছুটির দিন। এখন একে শ্রমিক দিবসের বিশেষ গুরুত্বে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না।

দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের কাছে মে দিবসের চেয়ে পুণ্যদিন আর হয় না। আজও যদি কল- কারখানা অফিস কাছারিতে মে দিবসের তাৎপর্য শ্রমনির্ভর জীবিকার মানুষেরা সঠিক অনুধাবন করতে পারতেন, তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক ও শিল্প-মালিক শ্রেণীর স্বার্থান্ধ জাতাকলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এখনও তারা অবাধে নিষ্পেষিত হতেন না।

প্রায় ১৫০ বছর আগের ঘটনা, যখন নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত শ্রমিক শ্রেণি তাদের জীবন প্রাণ উৎসর্গ করে দুনিয়ার মজদুরদের হাতে তুলে দিয়েছিল অধিকার, যাকে সারা বিশ্ব মান্যতা দিতে বাধ্য হয়েছে, দিচ্ছেও। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়, ১৫০ বছরের পুরানো সেই শোষণ বঞ্চনা আর নিপীড়নের রূপ কিন্তু তাতে বদলায় নি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেসব প্রতিরুদ্ধ হয়েছে এই যা। মাঝখান থেকে বদলে গেছে শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামী চেতনা।

may day পয়লা মে বরাবর ইউরোপে ফুলের উৎসব হিসেবে পালিত হয়। ছবি- চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

১৮৭৩ এই সময়কালে আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দা যখন প্রায় তলানি ঠেকে গেল, সারা দেশ তখন দিশেহারা। এজন্য ১৮৬০ সালের আমেরিকার গৃহযুদ্ধই ছিল প্রধান কারণ। যুদ্ধের পরেই রেললাইন পাতা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ফাটকাবাজি, জার্মানিতে রৌপ্যমুদ্রার মূল্যহ্রাস ইত্যাদি মিলিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় একের পর এক ব্যাঙ্ক ফেল করতে থাকে। শিল্পক্ষেত্রে গতি বাড়ানো ছাড়া আর কোন উপায় তখন আর নেই। সেই সময় আমেরিকার শিকাগোই ছিল সবচেয়ে শিল্পসমৃদ্ধ। মন্দায় আতঙ্কিত ভীত আমেরিকানরা তাই নিত্যনতুন শিল্পক্ষেত্রে তাদের পুঁজির যা ছিল তাই বিনিয়োগ করতে থাকে। হু হু করে ছোট বড় মাস্তুল থেকে ক্রমশ ধোঁয়া ছড়াতে থাকে সারা আমেরিকার আকাশে। এই সময়ের মন্দায় জর্জরিত বিশ্বের নানা দেশ থেকে, ইউরোপ থেকে, বিশেষ করে জার্মানী থেকে, শ্রমিকের ঢল এসে আমেরিকায় ভিড় করতে থাকে। কলকারখানা ভরে যায় দেশচ্যুত বাস্তুচ্যুত দিশাহারা শ্রমিকে। সুযোগ বুঝে কম বেতনে বেশি সময়ের জন্য শ্রমিকদের কাজে লাগায় মালিকশ্রেণি। ফলে ধস্ত হতে থাকে শ্রমিকদের সামাজিক, পারিবারিক আর ব্যক্তিগত জীবন স্বাচ্ছন্দ্য।

আরও পড়ুন, যৌনবিশ্বে কীসের হাতছানি

অর্থনৈতিক সংকট ও বিপন্নতা থেকে নিজেদের উদ্ধার করতে মালিকপক্ষ অসহায় অভিবাসী অর্থাৎ জীবনসংগ্রামে প্রত্যয়ী বহিরাগতদের লাগামছাড়া শোষণের পথটাই বেছে নিল। প্রতিপক্ষে শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থরক্ষায় এগিয়ে আসতে শুরু করল সমাজবাদী ও কম্যুনিস্টদের নেতৃত্বে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন। প্রতিবাদ ধূমায়িত হতে থাকে দিনে দেড় ডলারের বিনিময়ে ১০ থেকে ১৬ ঘণ্টার কাজের বরাতে। অথচ কাজ করতে করতে আহত হলে কোন ক্ষতিপূরণ ছাড়াই ছাঁটাই ইত্যাদি। মালিকরা ইউনিয়ন গঠনের বিরুদ্ধে অনমনীয়। ফলে, একসময় শ্রমিকশ্রেণীর প্রতিবাদ মুখর থেকে মুখরতর হতে থাকে। তাদের প্রথম দাবি উঠল: 'আট ঘণ্টার বেশি কাজ করব না।' সারা আমেরিকাতেই, সেই সঙ্গে ইউরোপেও এই আট ঘন্টার কাজের দাবি জোরদার হতে থাকে। মালিকশ্রেণি গুন্ডাদের লেলিয়ে, কখনো ভুয়া শ্রমিক নেতাকে স্বীকৃতি দিয়ে শ্রমিক ঐক্যে ফাটল ধরাবার চেষ্টা করতে থাকে। সব ক'টি মিডিয়াও মালিকশ্রেণির হয়ে শ্রমিক ঐক্যকে ভাঙার চেষ্টায় জুটে যায়।

কিন্তু তাতেও মালিকশ্রেণি সফল হয় না। এক সময় আমেরিকার ১৩ হাজার কলকারখানার ৩ লক্ষ শ্রমিক কাজ ফেলে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়, একটিই দাবি ৮ ঘন্টার বেশি শিফট নয়। ইউরোপেও শ্রমিক শোষণের ছবি খুব ভিন্ন ছিল না, সেখানেও শুরু হল ৮ ঘন্টার শিফটের দাবি। শ্রমিক আন্দোলনের জেরে অর্থনীতি আবার বিপন্নতার মুখোমুখি। কিন্তু নানা পন্থায় শ্রমিক আন্দোলনকে বিপথু করার কাজ চালাতেই থাকে মালইকের দল।

আরও পড়ুন, নিঃসঙ্গতার একশ বছর

একদিন শিকাগোর এক কারখানার সামনে জমায়েত হয়ে শ্রমিকরা আট ঘন্টার কাজের দাবি জানাচ্ছিল। বিশাল জমায়েত ছিল সেটা। সমাবেশে বক্তৃতা চলাকালীন কেউ পুলিশকে লক্ষ করে একটা গ্রেনেড ছুঁড়তেই পরিস্থিতি যায় পালটে। পুলিশ গুলি চালায় শ্রমিকদের ভিড়ে। সাতজন শ্রমিক নিহত হয়। গ্রেনেডের আঘাতে পুলিশেরও কয়েকজন মারা যায়। ব্যপক ধর পাকড় শুরু হয়। কে গ্রেনেড ছুঁড়েছিল, সেটা সে পেলই বা কী করে এসব কিছুই অবশ্য জানা গেল না। কেউ কেউ বলেন, আন্দোলনকে বেপথু করতে মালিকশ্রেণিরই কারসাজি ছিল এই গ্রেনেড ঘটনা। সাতজন কর্মীকে এজন্য মৃত্যদণ্ড দেওয়া হল। জেল হল আরও অনেকের। কিন্তু আন্দোলন তাতে থামল না। আরও জোরদার হল তা। ঘটনাচক্রে সেদিনটা ছিল পয়লা মে।

পয়লা মে বরাবর ইউরোপে ফুলের উৎসব হিসেবে পালিত হয়। বসন্তের শেষে ফুল দিয়ে এই দিনে গ্রীষ্মকে স্বাগত জানাবার রীতি। মালিকশ্রেণি দিনটাকে এই উৎসবের দিকে ঘোরাবার চেষ্টা করলেও দুনিয়া জুড়ে শ্রমিকদের অসন্তোষে তাতে বদলালো না। আটঘণ্টার দাবি মেনে নেওয়ার পর পয়লা মে চিহ্নিত হল শ্রমিক দিবস হিসেবে।

আরও পড়ুন, কুমারীধর্ষণের চরম শাস্তিতে সক্রিয় সরকারঃ একটি প্রতিক্রিয়া

কম্যুনিস্টদের এই সাফল্য দুনিয়া জুড়েই পুঁজিপতিদের পরাজয় ও শ্রমিক-মজদুরদের প্রতীক হয়ে উঠতে থাকে। কম্যুনিস্ট দেশগুলি আজও এই দিনটাকে অতি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে, অন্যত্র কিছু কিছু দেশের শ্রমিকরা পালন করে এই দিন। বৃটেন অবশ্য বরাবর পয়লা মে ব্যাঙ্ক হলিডে হিসেবে পালন করে আসছে, যা আজও ভারত, স্বাধীন হবার পরেও, মেনে আসছে।

আমেরিকায় ফার্স্ট মে'র গুরুত্ব কেউ জানেই না মনে হয়। তারা মনে করে এটা কম্যুনিস্টদের পালনীয় একটি দিন। এই দিনের জন্মদাতা যে তারা, সে কথা কেউ জানে বলে মনে হয় না। পোপও একসময় চেষ্টা করেছিলেন, পয়লা মে'র শ্রমিকদের বিজয় উল্লাস যাতে আবার ফুলের উৎসবে বদলে ফেলা যায়, এবং এভাবে কম্যুনিস্টদের সাফল্যকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায়। এসব চেষ্টা সাগর সাঁতরে একসময় ভারতের উপকূলেও ঢেউ তুলে আছড়ে পড়ে।

পুঁজিবাদ যে শেষটায় তাদের এমন চেষ্টায় সফল হয়েছে, তা আমরা ভারতের মে দিবস উদযাপনের স্তিমিত আলোর ছটাতেও টের পাই। মে দিবস ভারত তথা বাংলায় এখন একটা ছুটির দিন মাত্র। তবে কি মে দিবস একদিন শ্রমিকদের বিজয় দিবস নয়, শ্রমিকদের পরাজয় দিবস বলে চিহ্নিত হবে?

may day labour day
Advertisment