Advertisment

মিড ডে মিল কেলেঙ্কারি: প্রসঙ্গ মানবিকতা

জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা অনেকেই মনে করেন, পুষ্টির জন্য ছাত্রছাত্রীদের খাদ্য তালিকায় ন্যূনতম প্রোটিন থাকা দরকার। ডিমের দাম মাছ বা মাংসের তুলনায় কম। তাই তালিকায় প্রোটিন বলতে ওই ডিম।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
midday meal west bengal

ছাত্রদের সঙ্গে প্রাথমিক স্কুলে গিয়ে ডিম-ভাত খান হুগলির জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাও

"আমরা ছাত্রছাত্রী পিছু ৪ টাকা ৩১ পয়সা পাই। তাই দিয়ে ডিম খাওয়াব কোথা থেকে?" সাম্প্রতিক এক প্রশাসনিক বৈঠকে মিড ডে মিলের খাদ্যতালিকা নিয়ে এ প্রশ্ন তোলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর এই প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আরও নানাবিধ প্রশ্ন! যে প্রশ্নগুলি আবর্তিত হচ্ছে বছরের পর বছর। কিন্তু উত্তর মেলে নি।

Advertisment

মিড ডে মিল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প, যা রূপায়িত হয় বিভিন্ন রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলিতে রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে। বলা বাহুল্য, বরাদ্দ অর্থপ্রাপ্তি থেকে বাজারহাট, রান্না, জ্বালানি, খাবারের তালিকা প্রস্তুত, সব ক্ষেত্রেই সমন্বয় সাধন একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। তবে সব থেকে বড় দিক নিঃসন্দেহে সদিচ্ছা। আর এই সদিচ্ছার বিষয়টি দায়িত্বে থাকা সর্বস্তরের কর্মীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই দায়িত্ব কিন্তু তাঁদের চাকরিরই অঙ্গ। এমন নয়, কেউ এখানে বিনামূল্যে সমাজসেবা করছেন।

কিছুদিন আগের খবর, হুগলির এক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা মিড ডে মিলের বরাদ্দ ডিম পাচ্ছে না। নুন দিয়ে ভাত খাচ্ছে তারা। কারণ ডিম বিক্রি হয়ে যাচ্ছে বাইরে। এর নেপথ্যে স্কুলেরই অসাধু দুজন শিক্ষক। এই নিয়ে খবর হওয়ার পরপরই মিড ডে মিলে ডিম প্রসঙ্গে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য। কোনও যোগসূত্র? এটা ঠিক, এর সঙ্গে এও বলেছেন তিনি, "আমি বলছি ভাত-ডাল এবং আর একটা তরকারি দিয়ে পেট ভরে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করুন।" প্রসঙ্গত, হুগলির ওই স্কুলের দুই অভিযুক্ত শিক্ষককেই সাসপেন্ড করা হয়েছে। রাজ্যের প্রশাসনিক স্তরে জেলায় জেলায় পর্যবেক্ষণও শুরু হয়েছে। কর্তাব্যক্তিরা পৌঁছে যাচ্ছেন স্কুলে, তত্ত্বতালাশ চলছে। কতদিন এটা চলবে জানা নেই। যতদিন চলবে ততদিন অন্তত আশা করা যায়, ছাত্রছাত্রীরা আর কিছু না হোক, ভাত-ডাল-সবজিটা ঠিকঠাক পাবে।

আরও পড়ুন: পীড়নের শিকার পুরুষও, সব সমাজেই

শুধু এই রাজ্য নয়। মিড ডে মিল প্রসঙ্গে খবরে বারবার উঠে এসেছে উত্তরপ্রদেশের নামও। ছাত্রছাত্রীদের শুধু নুন-রুটি খেতে দেওয়া হচ্ছে মিড ডে মিলে, মির্জাপুরের একটি স্কুলের এমন এক ভিডিও বিপুল পরিমাণে ভাইরাল হয় সম্প্রতি। বিরোধীরা যথারীতি শোরগোল ফেলে দেয়। যে কোনও বিষয়ে সরকার ও বিরোধীদের এই চাপানউতোর অভিনব কিছু নয়। নতুন বিষয় পেলেই পুরোনোটা চাপা পড়ে যায়। মিড ডে মিল বিতর্কও তার বাইরে নয়।

তথ্যসূত্র অনুযায়ী, হুগলির ওই স্কুলটির ডিম-কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে জেলাশাসক নিজে উদ্যোগ নিয়ে বিষয়টি পর্যালোচনা করেন। তারপর এক প্রাথমিক স্কুলে গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে বসে ডিম-ভাতও খান। এরই পাশাপাশি বিজ্ঞপ্তি জারি করেন, তাঁর জেলার মিড ডে মিলে ডিম সেদ্ধ ও ডিমের ঝোলের সঙ্গে সপ্তাহে একদিন মুরগির মাংসও দেওয়া হবে। রীতিমতো মেনুও ছাপিয়ে দেন তিনি।

পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনও মিড ডে মিলে বরাদ্দ পদ নিয়ে জানায়, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার মাছ বা ডিম দেওয়া হবে তাদের জেলার মিড ডে মিল অন্তর্ভুক্ত ছাত্রছাত্রীদের। বস্তুত, ২০০৯-১০ আর্থিক বর্ষ থেকেই মিড ডে মিলে ডিম দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সেটা জানতেন না, এটা যথেষ্ট বিস্ময়কর। তাঁর বক্তব্যে প্রশাসনিক স্তরে কিছুটা অস্বস্তির বাতাবরণ তৈরি হয়েছে নিঃসন্দেহে। তবে, সেটারও সমাধান হয়ে যাবে কোনও এক সময়। প্রসঙ্গত, জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা অনেকেই মনে করেন, পুষ্টির জন্য ছাত্রছাত্রীদের খাদ্য তালিকায় ন্যূনতম প্রোটিন থাকা দরকার। ডিমের দাম মাছ বা মাংসের তুলনায় কম। তাই তালিকায় প্রোটিন বলতে ওই ডিম।

বিষয়টা আসলে মাছ-মাংস-ডিম বা বরাদ্দ খাবারে প্রোটিন থাকা না থাকা নয়। বিষয়টা সততার। প্রশ্নটা মানবিকতার। বরাদ্দ খাবার, অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীদের যেটা প্রাপ্য, সেটাও কি তারা পাচ্ছে? চাল ও ডালে পোকা, সেই পোকা সহই রান্না। পাতলা জলের মতো ডাল। বিস্বাদ, বেরঙ খাবার। সত্যি কথা বলতে কী, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনুসারে ভাত-ডাল-সবজিও যদি ঠিকমতো পেত ওরা!

আরও পড়ুন: আমাদের ওপর ভরসা হারাচ্ছে আমাদের সন্তানরা

শুধু সাম্প্রতিক সময়ে নয়, মিড ডে মিল নিয়ে নানা ন্যক্কারজনক ঘটনা এর আগেও বহুবার ঘটেছে। সব আমলেই ঘটেছে। মিডিয়ায় নিন্দার ঝড় উঠেছে। প্রশাসনের তরফে দুয়েকজন শাস্তি পেয়েছে। তারপর সব থেমে গেছে। আসলে শাস্তি দিয়ে কখনই বিবেকবোধ জাগানো যায় না। দরিদ্র ও অসহায় কয়েকটি ছেলেমেয়ের মুখের গ্রাস চুরি করে যারা পকেট ভরে, তাদের জন্য কোনও শাস্তিই যথেষ্ট নয়। এদের সামাজিক ভাবে বয়কট করা উচিত। সমাজে থাকার অধিকারই নেই এদের।

এখানে একটা বিষয়ে আলোচনা জরুরি। সাধারণ ধারণা অনুসারে প্রোটিন, ভিটামিন, কার্বোহাইড্রেট, মিনারেল, এসব ভেবে মিড ডে মিলের খাদ্য তালিকা প্রস্তুত হবে, এমনটা আমরা মোটেই আশা করি না। সরকারি বদান্যতায় ক'টি গরীব বাচ্চা দুপুরে ভাত খেতে পাচ্ছে, এটা ভেবেই বেশ একটা তৃপ্তি অনুভব করি আমরা বেশিরভাগ মানুষ। যদিও ভারত সরকার মিড ডে মিল প্রকল্প চালু করে শুধু পেট ভরানো নয়,  ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্যরক্ষার কথা মাথায় রেখেও। তাদের কাছে পুষ্টিকর খাবার পৌঁছনোর তাগিদেই এই প্রকল্পের প্রণয়ন।

সব থেকে বড় কথা, এটা সারা দেশের সমস্ত সরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বরাদ্দ। এমন নয় যে শুধু আর্থিকভাবে অনগ্রসর স্কুলগুলিই এর অন্তর্ভুক্ত। এটা ঠিক, এই প্রকল্পের কল্যাণেই আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা সমাজের বহু ছেলেমেয়ে স্কুলে এসে পেট পুরে দুপুরে খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। তাদের কাছে পুষ্টির থেকেও বেশি গুরুত্ব পায় পেট ভরে দুমুঠো খাবারের প্রতিশ্রুতি। সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলিতে এর ফলে স্কুলে যোগদানের হার বেড়েছে এবং কমেছে স্কুলছুটের হার, এও এক বাস্তব ও নির্মম সত্য।

আর্টিকল ২৪-এ উল্লেখিত 'কনভেনশন অন দ্য রাইটস অফ দ্য চাইল্ড' অনুসারে ভারত সরকার দেশের শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্যের যোগান দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ১৯৯৫ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্প পরবর্তীকালে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। পরিবর্তন যাই হোক, মূল লক্ষ্য ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পরিচ্ছন্ন ও খাদ্যগুণসম্পন্ন খাবার পৌঁছে দেওয়া। প্রসঙ্গত, মিড ডে মিল প্রকল্প ন্যাশনাল ফুড সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৩-র অন্তর্ভুক্ত। ছাত্রছাত্রীদের জন্য বন্টন করা এই খাদ্য তালিকায় বয়সের আনুপাতিক হিসেবে ৪৫০ থেকে ৭০০ ক্যালোরি খাদ্য থাকা আবশ্যিক। মিড ডে মিল প্রসঙ্গে এই যাবতীয় তথ্য প্রতিষ্ঠিত করে ছাত্রছাত্রীদের খাদ্যের অধিকারের সাংবিধানিক ব্যাপারটি। অর্থাৎ যে বা যারা এই সংক্রান্ত বিষয়ে অসৎ বা উদাসীন, তারা আইনত অপরাধী। তাদের কঠোরতম শাস্তি প্রাপ্য।

আরও পড়ুন: আয়ুষ চিকিৎসক, অ্যালোপ্যাথি ও দেশ

কিন্তু আবারও সেই কথা, শাস্তি দিয়ে এই জাতীয় অপরাধচক্র বন্ধ করা যাবে? শুধু এই রাজ্যের কথাই যদি ধরি। এতগুলি জেলা, এত সংখ্যক স্কুল। সরকার ও প্রশাসন পাহারা দিয়ে, পরিদর্শন করে কীভাবে ছাত্রছাত্রীদের খাদ্যসুরক্ষার ব্যাপারটি সুনিশ্চিত করবে? মুখ্যমন্ত্রী ভাত-ডাল-সবজির উল্লেখ করেছেন। সেসবের জন্য বরাদ্দ টাকা যথাযথ খরচ হবে, এমন গ্যারান্টি কে দেবে? খাদ্যশস্য এবং সবজির গুণমান সঠিক থাকবে, এর দায়িত্বই বা নেবে কে? রান্নাঘরে পরিচ্ছন্নতা বজায় থাকবে। বাসনকোসন ধোওয়া হবে। সর্বকাজ করা হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে। এতকিছু নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা মাথা ঘামাবেন তো?

এই প্রতিবেদন যখন লিখছি, ঠিক সেই মুহূর্তের এক চাঞ্চল্যকর খবর। রাজ্যের মোট ৮৩,২২৫ টি স্কুলে মিড ডে মিল দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তার মধ্যে ৬,০০০ স্কুল রাজ্যের শিক্ষা দফতরকে রিপোর্ট দেয় না। প্রশ্ন এটাই। সততা, দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ আইন করে শেখানো যায় না। চেতনা জোর করে জাগানো যায় না। যে ছেলে বা মেয়েটি পোকা হওয়া চালের ভাত খাচ্ছে, সেও এ দেশের সন্তান। আমাদের সবার বাড়ির শিশুদের মতোই এক অসহায় শিশু। তার সুস্থভাবে বেঁচে থাকা বড়দের ওপর নির্ভর করেই। সেই বড়রা এতটুকু সৎ হবে না? তাদের বিবেক এতটুকু জাগ্রত হবে না? যদি না হয়, তাহলে মিড ডে মিল বিতর্ক চলবে। অপরাধ ঘটবে আর অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। আমাদের দুর্বল স্মৃতিশক্তি। খবর ঠান্ডা হওয়ার কিছুদিন পর আমরাও সব ভুলে যাব।

government of west bengal
Advertisment