শেখায় কোনও দোষ নেই। তবে কী শিখব, কার কাছ থেকে শিখব, সেটাই বড় কথা। মিজোরাম ঘুরতে গিয়ে দিন কয়েক আইজলে ছিলাম। তখনই মনে হল, মিজোদের থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে।
আইজল মিজোরামের রাজধানী, ছোট্ট শহর। মিজো ভাষায় ‘রাম’ মানে জমি। মিজোদের জমিই হল ‘মিজোরাম’। পেংলুই বিমানবন্দরে নেমে ঝরনা, নদী পেরিয়ে আইজল শহরে গাড়িতে প্রায় এক ঘণ্টা। শহরে গাড়ির সংখ্যা তুলনায় বেশ বেশি। প্রাইভেট গাড়ি, স্কুলবাস, অসংখ্য ট্যাক্সি, গণপরিবহণের বাস, ছোট মালবাহী ভ্যান, হাজারে হাজারে স্কুটার সারাক্ষণ ছুটছে রাস্তায়। পাহাড়ি রাস্তা। রাস্তা অনেক সময়ই দুই লেনের নয়। এক লেনের। দু’দিক দিয়েই গাড়ি আসছে যাচ্ছে। মাঝখানে সাদা রঙের দাগ দিয়ে কোনও নির্দেশও নেই। কিন্তু বিভিন্ন রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম, আইজল শহরে কোনও গাড়ি হর্ন দেয় না। কোনও গাড়ি ওভারটেকও করে না। জ্যাম হয়। ভালোই হয়। কিন্তু হর্নের আওয়াজ নেই।
যদি কোনও বাইরে থেকে আসা গাড়ি না জেনে হর্ন বাজিয়ে ফেলে, সবাই সেই চালকের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন, ভাব খানা এই, সবাই মিলেই তো যাচ্ছি বাছা, অযথা হট্টগোল কেন? অথচ কলকাতায় আমরা রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বেরোলেই বিনা কারণে হর্ন বাজাতে থাকি। কলকাতা পুলিশের হিসেব নিঃশব্দ এলাকায় হর্ন বাজানোর জন্য নিয়মিত জরিমানা করা হয়।
কত? ২০১৬ তে এই নিয়ে মামলা হয় প্রায় ১৬ হাজার। অকারণে হর্ন বাজানোর জন্য আরো প্রায় ৬ হাজার। তাতে কি হর্ন বাজানোর কুঅভ্যাস কমেছে? মোটেই না। দেখা যাচ্ছে গত প্রায় ছ’মাসে এই দুই ধরনের মামলার সংখ্যা লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। আর বিনা কারণে হর্ন মানে কী?
যদি কেউ আচমকা গাড়ির সামনে চলে আসে, তখন তো হর্ন জরুরি। কিন্তু বাস্তব বুদ্ধি বলে হর্ন বাজানোয় চালকের অধৈর্যই প্রকাশ পায়। বিরক্তি প্রকাশ পায়। ক্রোধ প্রকাশ পায়। সাধারণ অবস্থায় হর্ন বাজিয়ে এক ইঞ্চিও বাড়তি এগোনো সম্ভব নয়। হর্ন নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। অন্তত সপ্তাহে একদিন ‘নো হর্ন ডে’ করে আমরা কী একটা পরীক্ষা করে দেখতে পারি না!
যাই হোক, কোলকাতার হর্নের শব্দে কানে আঙুল দিয়ে ফের আইজলে ফেরা যাক। গোটা শহরটাকে দেখলে মনে হতে পারে মহিলাদের শহর। বড় বড় ব্র্যান্ডের শোরুম চালাচ্ছেন মিজো মেয়েরা। পানের দোকানও চালাচ্ছেন মহিলারা। রেস্টুরেন্টেও তাঁদেরই দাপট। বড়া বাজারে মতো বিরাট বাজারে গিয়ে দেখলাম, হকারিও মেয়েদের দখলে। এবং সবাই খুব সাজ-গোজ করে কাজটা করছেন। ট্যাক্সিও নাকি চালাতে চেয়েছিল মেয়েরা। তবে সেই দাবি পূরণ হয়নি। সেটা আগে ছিল ‘বার্মিজ’দের দখলে। এখন মিজো পুরুষরাই ট্যাক্সি চালান। বাসও একচেটিয়া পুরুষদের হাতে।
আমার গাড়ির চালক আইবাক বললেন, এখনও অনেক সময় পিওন, সাফাই কর্মী এমন বহু সরকারি পদে মিজো পুরুষরা চাকরি করলেও, তারা কখনও কোনও কারেণে অফিস যেতে না পারলে, বাড়ির মেয়েরা গিয়ে কাজটা করে দিয়ে আসেন। সরকার থেকে মাঝে মাঝেই বলা হয় এরকম না করতে। কিন্তু পাল্টা যুক্তি হোল, আরে ভাই তোমার তো কাজ হওয়া দিয়ে কথা। কে করল তা নিয়ে তুমি মাথা ঘামাচ্ছ কেন? এই ব্যাপারটাতে মিজোদের সারল্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।
আইজল শহরে ঘুরলে পুলিশের দেখা মেলা ভার। স্থানীয় এক যুবককে এই বিষয়ে প্রশ্ন করতে তিনি হেসে বললেন, পুলিশ দিয়ে কী হবে? প্রায় কখনই কোনও গোলমাল হয় না। আর যদি গাড়ির সঙ্গে গাড়ির ধাক্কা-টাক্কা লাগে, নিজেরা আলোচনা করে যার দোষ সে টাকা দিয়ে দেয় যার ক্ষতি হয়েছে তাকে। আগে মিজোরাম ড্রাই স্টেট ছিল। পরে কিছুদিনের জন্য মদ ফিরে আসে। এখন মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে ফের নতুন করে গোটা রাজ্যে মদ নিষিদ্ধ করেছে। তা নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তো নেই-ই, বেশ খুশি তারা। তাদের বক্তব্য, নেশা করে বিশেষ করে পুরুষদের অনেকেই অকাল মৃত্যুর শিকার হয়। মেয়েরাও ভীষণ ভাবে ড্রাই স্টেটের পক্ষে। তবে কালোবাজারে বিক্রি হয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ, আড়াই গুণ দামে।
বাংলাদেশ এবং ময়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত থাকায়, সোনা পাচার এবং ড্রাগের র্যাকেট এখানে বেশ সক্রিয়, সেই কথা বললেন স্থানীয়েরা। থানায় গিয়ে সাংবাদিকসুলভ অনুসন্ধান অবশ্য আমার আর করা হয়ে ওঠেনি। অবাক হয়ে গেলাম, যখন দেখলাম, আইজল শহরে কোনও সিনেমা হল নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কয়েক জন ব্যবসায়ী সিনেমা হল খুলেছিলেন, কিন্তু চলেনি। কেউ দেখতে আসে না।
তাই বলে কি সিনেমা দেখেন না মিজোরা? তা কিন্তু নয়, বাড়িতে টিভিতে দেখেন। মিজো ভাষায় ৮-৯টি চ্যানেল আছে সেখানে সারাদিনই সিনেমা চলছে। মিজো সিনেমা আছে। তবে বেশি চলে মিজো ভাষায় ডাব করা হিন্দি সিনেমা। সব থেকে বেশি চলে মিজোতে ডাব করা কোরিয়ান ছবি। হিন্দি এখানে মোটে চলে না। লোকজন হিন্দি বুঝতেও পারে না। হয় মিজো নয়তো ইংরেজি। ভাঙা, গোটা, আধা ভাঙা ইংরেজি মোটামুটি শহরের সবাই বলতে পারেন। খুব সুন্দর দেখতে সব স্কুল।
কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজে ছেলে-মেয়েরা ছুটছে। কিন্তু শহরটা প্রায় ঘুমিয়ে পড়ে সন্ধ্যা ছ’টা-সাতটার পর। আইজল থেকে একটু বেরোলেই পড়বে ছবির মতো সব গ্রাম। বড় রাস্তার ধারে চোখে পড়বে কোথাও ফলের দোকান, কোথাও সবজির দোকান, কিন্তু দোকানি নেই। দাম লেখা আছে, লোকজন জিনিস নিয়ে পাশে রাখা বাক্সে টাকা রেখে চলে যাচ্ছেন। অসৎ মন। তাই খানিক দাঁড়িয়ে দেখলাম। কেউ কম টাকা দিয়ে জিনিস নিয়ে চলে যাচ্ছেন না।
আমিও ৩০ টাকা বাক্সে ফেলেএকটা আনারস নিলাম। আমার চালক ৬০ টাকা দিয়ে দুটি। আমি ফের মনে মনে গুণতে শুরু করলাম, কী কী আমরা শিখতে পারি মিজোদের থেকে।
(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)
এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে ক্লিক করে