Advertisment

রাজীবের দেওয়া নাম বদলে নেহেরু যুগে ফিরে কি লাভ, শিক্ষানীতি বৈষম্যের প্রাচীর ভাঙবে?

কোঠারি কমিশনের সুপারিশে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয় যে জিডিপির শতকরা ৬ ভাগ সরকারকে শিক্ষাক্ষেত্রে খরচ করতে হবে। সেটা কিন্তু সেদিনও হয়নি। পরবর্তী কালে অনেক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই তা হয়নি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
national education policy 2020

বেসরকারিকরণ মানেই গেল গেল রব তুলতে হবে তার কোন অর্থ হয় না।

ভারতের নরেন্দ্র মোদীর সরকার ছ'বছরের শাসনকাল অতিবাহিত করার পর এক নয়া শিক্ষানীতি ঘোষণা করলেন। ১৯৬৫ সালে কোঠারি কমিশন গঠিত হয়। নেহেরুর মৃত্যুর ৫০ দিন পর এই কমিশন গঠন হয়। যদিও শিক্ষানীতি প্রণয়নের ভাবনাটি ছিলনেহেরুর।

Advertisment

৮৬' সালে রাজীব গান্ধী নিয়ে এসেছিলেন নতুন শিক্ষা নীতি। শিক্ষা দফতর হয়ে গেল মানব সম্পদ উন্নয়ন বিভাগ। ৮৪' সালের নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী হন। তখন তাঁর সরকারের বিপুল সংখ‍্যাগরিষ্ঠতা। ব‍্যবসার ক্ষেত্রে বলা হয় কোনও কর্পোরেট সংস্থা যদি শক্তিশালী লাভজনক হয় তবে সে সংস্থার পক্ষে সংগঠনে নীতি প্রণয়ন সোজা হয়। তাই রাজীব গান্ধী ৮৫' সালে ৫ জানুয়ারি নিজে ঘোষণা করেন যে নতুন শিক্ষানীতি তিনি করবেনই। তাঁর অগ্ৰাধিকার শিক্ষানীতি হলেও অতীতের ভারতীয় ঐতিহ্য এবং পাশ্চাত্য আধুনিকতার মিলন। এই শিক্ষানীতি দেশের সর্ব ধর্ম সর্ব জাতির সমন্বয় সাধন করবে।

রাজীব চেয়েছিলেন কিন্তু তাঁর শিক্ষানীতি ও বাস্তবায়িত হতে পারল না। ৮৭' সালের এপ্রিল মাসে বোফর্স কেলেঙ্কারি নবোদয় মডেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে NCERT-র নতুন সিলেবাস অথবা মুক্ত বিশ্ববিদ‍্যালয় সবই এলোমেলো হয়ে গেল।

নরেন্দ্র মোদীর শিক্ষানীতি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি কমিটি গঠন করে আগে নীতিটি পর্যালোচনা করতে আগ্ৰহী। এতো প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত। মমতা শিক্ষানীতি নিয়ে কোনও knee jerk প্রতিক্রিয়া দেননি। বিতর্ক তো সব সময়ই ভালো।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ‍্যক্ষ বেশ কয়েক বছর আগে আমাদের, কিছু ভারতীয় সাংবাদিককে বলেছিলেন, তাঁরা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ করেছেন বহু বছর আগেই। নতুন নতুন বাড়ি ও ফ‍্যাকালটি নির্মাণ। তথ্য প্রযুক্তি বিভাগের বিপুল খরচ জোগাতে এগিয়ে এসেছে বহু বেসরকারি সংস্থা। আমরা ছোট্ট এক প্রতিনিধি দল গেছিলাম ব্রিটেন সরকারের আমন্ত্রণে। ওদের রাজনৈতিক ব‍্যবস্থা সংসদ, বিশ্ববিদ্যালয় ও সংবাদ মাধ‍্যমকে কাছ থেকে দেখার জন্য। তাই সেই অধ‍্যক্ষ মহাশয় সেদিন আর একটি কথাও স্বীকার করলেন, বেসরকারি পুঁজি অনেক বেশি আসে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার বিজ্ঞান এমনকি অর্থনীতির জন্য। কিন্তু তারা অত টাকা ইতিহাস, দর্শন বা সাহিত্য পাঠের জন্য দিতে চায় না।

আরও পড়ুন- অযোধ্যায় ঐতিহাসিক মুহূর্ত: গতকাল-আজ-আগামিকালের গল্প

আমি এটা শুনে সেদিন কিঞ্চিৎ দুঃখিতই হলাম। বললাম, তাহলে হিউম‍্যানিটিজ-এর ভবিষ্যৎ? ভদ্রলোক সাদা গোঁফের নিচে মুসকিল আসান একটা হাসি উপহার দিয়ে বলেছিলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট তো অখণ্ড। আমরা বেসরকারি পুঁজির শর্ত মানি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বরাদ্দ থেকে আমরা একটা ভর্তুকি দিই এই সমস্ত বিভাগকে। আমার এ অভিজ্ঞতা অনেকদিন আগের।

সম্প্রতি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রশাসক জানিয়েছেন, যে আর্থিক উদারবাদের প্রথম অধ‍্যায়ে রাজস্ব যতটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমুখী ছিল এখন কিন্তু এই নিউ এজ ডিজিটাল দুনিয়ায় বেসরকারি রাজস্ব আসছে দর্শন, ইতিহাস ও কলাবিদ‍্যার জন্য। তবু এখনও তুলনামূলকভাবে কলা ও দর্শনের জন্য বেসরকারি রাজস্ব সংগ্ৰহ অনেক কম।

তবে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ‍্যক্ষ যা বলেছিলেন সে ঘটনাটা আজ কেন মনে পড়ল? মনে পড়ার একটাই কারণ সেটা হল শিক্ষানীতিতে যদি বেসরকারিকরণকে গুরুত্ব দেওয়া হয় তাহলেই বামপন্থী বিদ্বৎ সমাজ গেল গেল রব তোলেন, কিন্তু যতই ভাল ভাল নীতিকথা আপনি বলুন না কেন শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে গেলে আজ তা বেসরকারি সূত্র ছাড়া আদৌ সম্ভব

কতখানি?

কেন্দ্রের রাজকোষের অবস্থা তো সকলেরই জানা। রাজ‍্য সরকারগুলিরও নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। মনমোহন সিং-এর সময় কপিল সিব্বল মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী হিসেবে (২০০৯ -২০১২) বেসরকারিকরণ চেয়েছিলেন। তাছাড়া ন‍্যাশনাল কাউন্সিল অফ হায়ার এডুকেশন রিসার্চ নামের এক সুপার-রেগুলেটর গঠন করতে চান এবং ব‍্যর্থ হন।

তাই বেসরকারিকরণ মানেই গেল গেল রব তুলতে হবে তার কোন অর্থ হয় না। আবার মাতৃভাষাকে প্রাথমিক স্তরে গুরুত্ব দেওয়ায় সে ক্ষেত্রে হিন্দি জাতীয়তাবাদের সংঘ দর্শন চাপিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু এদেশে হিন্দি মাতৃভাষা নয় এমন রাজ‍্যের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। বরং বাংলার ক্ষেত্রে প্রশ্নটা অন‍্যত্র। অশোক মিত্র কমিশন যেমন ''মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ'' রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্যের ভিত্তিতে যেভাবে বাংলাকে প্রাথমিক স্তরে পঠন-পাঠনের প্রধান মাধ‍্যম করে তুলেছিল তাতে কি রাজ‍্যের লাভ হয়েছে? বরং ইংরাজি মিডিয়াম স্কুলগুলি থেকে গেছিল। সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা মূলত শহুরে এক ভিন্ন শ্রেনীভুক্ত হয়। আর গ্ৰামীন বাংলার সরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা আর একটি প্রজাতি তৈরি হয়। রাজ‍্যে শহর ও গ্ৰামের মধ‍্যে আর্থসামাজিক দূরত্ব বাড়ে। তিনটি প্রজন্ম এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আরও পড়ুন- মমতার জন্য সরষে পাবদা আনাতেন সোমেন দা

এরপর দেখা যায় ছাত্রছাত্রীদের মধ‍্যে CBSC আর ISC-তে পড়ার চল মাধ‍্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের চেয়ে বেড়ে গেল। প্রথমে ক্লাস ফোরের বৃত্তি পরীক্ষা উধাও হল। তারপর দেখলাম কোথায় গেল সেই স্কুলওয়ারি টেস্ট পেপারের দিনগুলো। এখন বাংলা বাধ‍্যতামূলক, তবে কি দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরাজি গুরুত্ব পাবে? নাকি পাবে না ? ১৯৯৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ মধ‍্যশিক্ষা পর্ষদের সচিব উজ্জ্বল বসু লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ পঞ্চাশ বছর ধরে শিক্ষায় ইংরাজির স্থান নিয়ে ভেবেছেন। শিশু বয়সে ইংরাজি ভাষা শিক্ষাকে শিশু মনের পুষ্টি সাধনের পক্ষে ঘোরতর ক্ষতিকর বলে সোচ্চার রায় দেন। আবার বহু শিক্ষাবিদ বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি সম্পর্কিত মনোভাবকে বিকৃত ভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে।

আমি নিজে শিক্ষাবিদ বা পন্ডিত নই। কিন্তু কান্ডজ্ঞান থেকে মনে হয় চাকরি-বাকরির জন্য ইংরেজি শিক্ষা প্রয়োজন। এই শিক্ষানীতিকে বাস্তবায়িত করা হলে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক এমনকি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত ইংরাজি শিক্ষাটার পরিণতি ঠিক কী হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত, ১০+২ বদলে যে পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে তাতে প্রাথমিকের আগে প্রি নার্সারি - নার্সারি থেকে প্রথম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাও পর্ষদের অধীনে আসবে। এটা ব‍্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা ইংরাজি স্কুলগুলির ওপর আঘাত বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে যারা এসব স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকা তাদের কর্মসংস্থানের ভবিষ্যত কী হবে সেও তো প্রশ্ন।

আবার আজকাল শুনি এই শিক্ষক শিক্ষিকারা ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতেও অনেকে প্রাইভেট টিউশনি করে অর্থোপার্জন করেন। সরকার যদি শিশুদেরও পর্ষদের আওতায় আনতে চায় তবে সেটি কি মাধ‍্যমিক পর্ষদের আওতায় হবে নাকি নতুন পর্ষদ গঠন হবে? নতুন পর্ষদ গঠন করলে নতুন করে শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়োগ করলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও বাড়বে। আর এজন্য নতুন ভবন নির্মাণ করতে হবে, নতুন শিক্ষক নিয়োগ হবে। এই পরিকাঠামোর জন্য মূল প্রশ্ন হল প্রয়োজনীয় টাকাটা আসবে কোথা থেকে?

এরপর প্রশ্ন হল, শিক্ষা সংবিধানের যুগ্ম তালিকায় যদি কোনও রাজ‍্য সরকার এই শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে এবং রাজ‍্যে এটি বাস্তবায়িত করতে রাজি না হয় তবে তার সাংবিধানিক পরিণতি কী হবে? শিক্ষা যুগ্ম তালিকায় কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অভিযোগ এ নীতি নিয়ে তাদের সঙ্গে কোন আলাপ আলোচনাই করা হয়নি। তবে সে ক্ষেত্রে কী হবে?

যদি বিজেপি শাসিত রাজ‍্যগুলিতে শিক্ষানীতি কার্যকর হয় আর অবিজেপি তা না করে তবে তো ভারতেই ছাত্রছাত্রীদের মধ‍্যেই দুটি পৃথক শ্রেণী, পৃথক দুনিয়া তৈরি হবে। পাশ্চাত্যের দেশগুলির পরীক্ষা বা বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রশ্নেও যদি ভেদাভেদ হয়ে যায় তাতে কি দেশে সংশয় আরও বাড়বে না?

আর সবচেয়ে বড় কথা হল, এই শিক্ষানীতিকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে যদি আরও টাকা লাগে তবে তার জন্য বেসরকারিকরণের মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্ৰহের চেষ্টা কোথায় কোথায় হবে তা নীতিতে স্পষ্ট নয়। বাস্তবে এই পুঁজি কতটা আসবে? দেশের অর্থনীতি শোচনীয়। বৃদ্ধির চিত্র হতাশার। করোনা দেশের কর্ম সংস্থান উৎপাদন বিদেশি লগ্নির চিত্রকে আরও দুঃখের গর্ভে নিমজ্জিত করেছে। এ অবস্থায় লাগে টাকা তো দেবে কোন গৌরী সেন?

কোঠারি কমিশনের সুপারিশে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয় যে জিডিপির শতকরা ৬ ভাগ সরকারকে শিক্ষাক্ষেত্রে খরচ করতে হবে। সেটা কিন্তু সেদিনও হয়নি। পরবর্তী কালে অনেক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই তা হয়নি। মোদীর শিক্ষানীতি থেকে জানা যায়নি জিডিপি-র শতকরা কতভাগ অর্থ দরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে বলিপ্রদত্ত। আর টাকাটা আসবে কোথা থেকে? তাই দপ্তরের নাম রাজীবের দেওয়া মানবসম্পদ উন্নয়নের বদলে আবার নেহেরু যুগে শিক্ষা শব্দে ফিরে যাওয়া আমার কাছে কোনও রোমহর্ষক পরিবর্তন নয়! তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হল, আর্থিক। যে দেশে স্কুল ড্রপআউট সমস্যা চরমে, যে দেশে স্কুলে মিড ডে মিল দিতে হয় গরিব ছাত্রছাত্রীদের কল‍্যাণে, যে দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে গ্ৰাম-শহর বিরোধ আজও ভয়ঙ্কর, যে দেশে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য শিক্ষার আলোকে সমাজের প্রতিটি কোনে ছড়িয়ে দিতে পারে না সে দেশে শিক্ষানীতির অগ্ৰাধিকার হওয়া প্রয়োজন অখন্ড ভারতের আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের প্রাচীর ভেঙে দেওয়া।

পড়ুন, জয়ন্ত ঘোষালের সবক’টি কলাম এখানে

Delhi Theke Bolchi
Advertisment