Advertisment

অনলাইনেও লক ডাউন! এমনটা তো কথা ছিল না

অনলাইন পরিষেবার ক্ষেত্রে যে সংস্থাগুলির নাম লোকের মুখে মুখে ফেরে, তাদের অনেকটাই যে তারকাখচিত বিজ্ঞাপনের চমক, সেটা লকডাউন প্রেক্ষিতে পরিষ্কার হয়ে গেল।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
online shopping

প্রতীকী ছবি। অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

সকাল থেকে যতবার অর্ডার প্লেস করছেন, ততবারই 'কারেন্টলি নট অ্যাকসেপ্টিং, ট্রাই লেটার' দেখছেন ! চাল-ডাল-তেল, শাকসবজি, শ্যাম্পু-সাবান-ডিটারজেন্ট থেকে জীবনদায়ী ওষুধ, যে কোনও অন লাইন শপিং-অ্যাপেই একই অভিজ্ঞতা। দেখতে দেখতে প্রবল বিরক্তি ও অসহায়তা ঘিরে ধরেছে আপনাকে। গত কয়েকদিন যাবৎ এমনই অভিজ্ঞতায় বিপর্যস্ত এক বিরাট সংখ্যক মানুষ। লকডাউনের বাজারে অনলাইনেও তালা ঝুলবে, এমনটা কে-ই বা ভেবেছিল? এ যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া।

Advertisment

পাড়ার মুদি দোকান, এলাকার জামাকাপড়, মনিহারি ইত্যাদির শো-রুম। সেখান থেকে বড় মার্কেট কমপ্লেক্স ঘুরে শপিং মল ও মাল্টিপ্লেক্স। সব শেষে অনলাইনে বিকিকিনি। ভারতীয় কেনাকাটার অভ্যাসে এই বিবর্তন আদতে সামগ্রিকভাবেই তার জীবনযাপন, বলা ভালো জীবনদর্শনের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের দিশারী। সময়ের নিয়মেই ঘটে যাওয়া এই পরিবর্তনে অভ্যস্ত মানুষ সম্প্রতি বিপুল পরিমাণ হয়রানির শিকার হয়েছেন। করোনা প্রতিরোধে লকডাউনে গৃহবন্দি আমজনতা অনেকটাই নিশ্চিন্ত ছিলেন অনলাইন শপিং-এর সুবিধার কথা ভেবে, যা এককথায় চূড়ান্ত বিপরীত এক অভিজ্ঞতায় পর্যবসিত হয়েছে।

আরও পড়ুন: হাইওয়েতে ট্রাক ফেলে চম্পট চালকদের, এখনও বন্ধ বহু রাজ্যের সীমানা

রাজ্যে লকডাউন ঘোষণা হয় দুটি পর্যায়ে। প্রথমটি কলকাতা ও সমস্ত পুরসভাগুলি। তারপরই প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করলেন। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন, বাজার খোলা থাকবে। তবে, ভিড় জমানো যাবে না। এখনও এখানে করোনার গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়নি। দোকান-বাজার, রাস্তাঘাটে ভিড় হলে, সেটা আটকানো মুশকিল। এই পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে, কী রাজ্য কী কেন্দ্র, সবই একটা যুদ্ধকালীন প্রস্তুতির সঙ্গে করার চেষ্টা করা হয়েছে। লকডাউন কেন জরুরি, তা নিয়ে দিবারাত্র প্রচার করছে সংবাদমাধ্যমগুলি। মানুষকে বোঝাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং, একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টজন।

lockdown coronavirus মঙ্গলবার দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে দাঁড়িয়ে ট্রাক। কখন ছাড়া পাবে ঠিক নেই, তাই ট্রাকের ছায়াতেই দিবানিদ্রা। ছবি: পার্থ পাল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

এসব খুবই অভিনন্দনযোগ্য পদক্ষেপ। কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা, যোগান, প্রাপ্তি এবং কেনাকাটার দীর্ঘদিনের অভ্যাস, তার কী হবে? স্বাভাবিক নিয়মেই লকডাউনের প্রভাবে সর্বত্র একটা বিপুল বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। একথা ঠিক, একান্ত নিরুপায় হয়েই সরকারকে খুব অল্প সময়ের নোটিশে পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটাতে হয়। এর ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ঘরে মজুত করার যথোপযুক্ত সময় পাওয়া যাবে কিনা, না পেলে কী হবে, এই নিয়ে একটা টেনশনের বাতাবরণ তৈরি হয়। দোকান-বাজার খোলা থাকলেও সেখানে ভিড় করা যাবে না। এরই পাশাপাশি যথাসম্ভব ঘরে থাকার নির্দেশ। সব মিলিয়ে এমন এক পরিস্থিতিতেই তো লোকজন অনলাইনে অর্ডার করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহের সুবিধা নেবেন।

কিন্তু না, সেখান থেকেই অত্যন্ত তিক্ত এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হলো গ্রাহকদের। বাকি সব ছেড়ে শুধু ওষুধের কথাও যদি বলি, মানুষের হতাশা চরমে পৌঁছল গত কয়েক দিনে। কারও ক্ষেত্রে অর্ডার নেওয়াই হয়নি। কারও ক্ষেত্রে নেওয়ার পর ক্যান্সেল হয়েছে। আজকাল অনেকেই সম্পূর্ণভাবে অনলাইন শপিংয়ের ওপর নির্ভরশীল। বহু প্রবীণ নাগরিক আছেন, যাঁদের পক্ষে দোকান-বাজারে সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থাতেই যাওয়াটা অসম্ভব। এখন তো একেবারেই অপারগ তাঁরা। তাঁদের ক্ষেত্রে অনলাইনের বিকল্প নেই বললেই চলে। অনলাইন পরিষেবা মুখ থুবড়ে পড়ায় তাঁরা কতটা অসহায় বোধ করছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আরও পড়ুন: করোনা আতঙ্ক: পরিযায়ী শ্রমিকদের কাউন্সেলিংয়ের নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের

অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। সরকারের পক্ষ থেকে অনলাইন পরিষেবা সংস্থাগুলিকে বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয় এ বাবদ। বাড়ি বাড়ি ডেলিভারির ক্ষেত্রে তারা লক ডাউনের আওতায় পড়বে না, এই ঘোষণাও ছিল। তবু, কেন এমন ল্যাজে-গোবরে অবস্থা? রেল ও বিমান পরিষেবা বন্ধ, এটা কারণ হিসেবে পুরোপুরি ধরে নেওয়া যাবে না। কারণ মালবাহী ট্রেন চলাচল লকডাউনের আওতার বাইরেই রয়েছে। তাদের ডেলিভারি কর্মীদেরও পথেঘাটে চলায় বাধা নেই। তবে? সমস্যাটা কোথায়?

আসলে অনলাইন পরিষেবার ক্ষেত্রে যে বহুজাতিক বা দেশীয় সংস্থাগুলির নাম আজকাল লোকের মুখে মুখে ফেরে, তাদের নামের অনেকটাই যে তারকাখচিত বিজ্ঞাপনের চমক, সেটা এই লকডাউন প্রেক্ষিতে পরিষ্কার হয়ে গেল। দ্রুতগতি পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে যে কৃতিত্বটা তারা নেয়, আদতে তার বেশিরভাগটাই দাঁড়িয়ে সরকারি পরিবহন ব্যবস্থার ওপরে। যদি সেটাও হয়, অসুবিধাটা কোথায়? অসুবিধাটা আসলে তাদের অভ্যন্তরীণ পরিকাঠামো ব্যবস্থা। সেখানে অনেকটাই জটিল এক সমীকরণে তাদের ব্যবসাটা চলে। সেই সমীকরণের মধ্যেই কোথাও একটা ফাঁক থাকার কারণেই কি এই বিপর্যয়?

বলা বাহুল্য, এই পরিকাঠামোর অনেকটাই এক বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবি মানুষের ওপর নির্ভরশীল। যে ডেলিভারি বয় হাসিমুখে আমার-আপনার বাড়িতে এসে চাহিদার জিনিসটি দিয়ে যায়, তাকে দেখে কিছুটা কল্পনা করা যায় তার দৈনন্দিন লড়াইয়ের কথা। এই লড়াইটা সে পেটের দায়ে করে। চাকরির ক্ষেত্রে স্থায়ীত্বের কোনওরকম গ্যারান্টি ছাড়াই করে। করতে বাধ্য হয়। এছাড়াও এক বিরাট সংখ্যক মানুষ আছেন, যাঁরা প্যাকেজিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধাপে কাজ করেন। এভাবেই এই মানুষগুলি 'অনলাইন পরিষেবা' নামক রথের চাকাটিকে গড়িয়ে নিয়ে চলেন। যে মসৃনগতিতে বহুজাতিক সংস্থাগুলি ব্যবসা করে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই শ্রমজীবি মানুষগুলির জীবন যে চলে না, তা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্স পড়ার দরকার পড়ে না।

lockdown coronavirus অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ি বাড়ি মাল পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন পাড়ার ছোট দোকানীরা। ছবি: গুরমীত সিং, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

একটি খুব নামী বহুজাতিক সংস্থা সম্পর্কে এমনও অভিযোগ আছে যে ওয়্যারহাউসে কাজ করা কালীন কর্মীরা বাথরুমে যাওয়ার সময়টুকুও পান না। ওয়্যারহাউস মানে যেখানে মজুত স্টক থেকে অর্ডার অনুসারে মাল প্যাকেটজাত করা, তার লেবেলিং ইত্যাদি নানা ধাপে গুছিয়ে তাকে পাঠানোর ব্যবস্থা হয়। তারও পরে এক শহর থেকে অন্য শহরে চালান। মোদ্দা কথা, আমি-আপনি আমাদের কাঙ্খিত বস্তুটি হাতে পাওয়ার আগে রয়েছে অনেকগুলি ধাপ। আর সব ধাপেই কাজ করছেন অগণিত মানুষ।

কথা হলো, লকডাউন কি কোথাও এই ছন্দটায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে? কোথাও কি শ্রমজীবী মানুষের অসন্তোষের অন্ধকার ছায়া বিস্তার করে আছে এই বৃহৎ অনলাইন সংস্থাগুলির সুখের ঘরে? তার জন্যই কি এই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনের সময়ে এহেন অপেশাদারোচিত পিঠটান? শুধু এটাই বা কেন? কোটি টাকার মুনাফাকারী এইসব সংস্থার নিজস্ব পরিবহন পরিকাঠামো নেই, এটাও খুব অবাক হওয়ার মতো একটি ঘটনা। জানি, এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া মুশকিল। তবে প্রশ্ন তো জাগেই। সারা বিশ্বে এই মুহূর্তে এক যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা। এমন অবস্থায় তথাকথিত পেশাদারী নামী সংস্থাগুলির এহেন অবাণিজ্যিক ও অপেশাদারী আচরণের অর্থ কী? প্রসঙ্গত, কেন তারা পরিষেবা দিতে অক্ষম, তার তেমন বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যাও সেভাবে কোথাও মেলেনি। যা প্রত্যাশিত ছিল।

আরও পড়ুন: লকডাউনের রোজনামচা – এখন লড়াই, ভবিষ্যতে কী?

একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। আমার পাড়ায় একটি অতি ছোট দোকান, তার মালিক তরুণটি এর মধ্যে একদিন কিছু জরুরি জিনিস বাড়িতে এসে দিয়ে যায়। ফোনে অনুরোধ জানানোর পর দু'বার বলতে হয়নি। ডেলিভারি চার্জ দূর, কোনও বাড়তি কিছুই এবাবদ নেওয়ার কথা ভাবতেই পারে না সে। গত কয়েক দিন টিভির খবরে এমন অনেক দোকানির মহৎ প্রচেষ্টার ছবিই দেখলাম। বড্ড মন ভালো করা ছবি। মুদি থেকে কাঁচা সবজি, অনেকেই এহেন ডেলিভারি ব্যবস্থা চালু করেছেন দেখলাম। তাতে দুটো লাভ। মানুষ ঘরে বসে জিনিস পেয়ে যাচ্ছেন। এর সঙ্গে দোকানে ভিড় জমাটাও এড়ানো যাচ্ছে। কিন্তু এসবের উর্দ্ধে রয়েছে আর একটি কথা। সেটা হলো আন্তরিকতা। এই আন্তরিকতাই বিপদে, সংকটে আপন স্বার্থের উর্দ্ধে নিয়ে যায় আমাদের। এ অনুভব কোনও বহুজাতিক সংস্থা কেমন করে দেবে? তার তো নিজের ঘরে লাভের কড়ি গুনে নেওয়ার দায়। মনুষ্যত্বের দায় তার নেই।

online shopping indian economy coronavirus
Advertisment