এবারের বেঙ্গল লাইনের লেখার বিষয় আমাদের ভাষায় কয়েকটি রাজনৈতিক এবং দু’একটি অরাজনৈতিক বাংলা শব্দের আসা যাওয়া নিয়ে। শুরু করছি তরমুজ দিয়ে। তরমুজ শব্দটা হারিয়ে যাচ্ছে বঙ্গ রাজনীতির ব্যবহারিক ভাষা থেকে। এমনই হয়।কত শব্দ আসে, কত শব্দ চলে যায়। কিছু থাকে। স্থায়ী হয়ে যায়। বঙ্গ রাজনীতিতে প্রায় ২৫-৩০ বছর আগে জন্ম নিয়েছিল তরমুজ।
তরমুজ প্রথম খবরের কাগজে লিখেছিলেন বন্ধু সাংবাদিক আশিস ঘোষ। কথাটা কংগ্রেসিদের মধ্যে তখন সবে চালু হয়েছে। তাকে প্রকাশ্যে আনেন আশিস। সে সময়ে মাঝে মধ্যেই দেখা যেত, কখনও রাজ্যসভা ভোটে, কখনও বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের ভোটে বামপন্থীরা তাদের হিসেবের থেকে দু’একটা ভোট বেশি পেয়ে যাচ্ছেন। আর বিরোধীদল কংগ্রেসের হিসেব এবং ভোটের অঙ্ক মিলছে না। হয়তো কংগ্রেসের পাওয়ার কথা ৩৩টি ভোট। পাওয়া গেল ২৬ বা ৩০টি ভোট। যাঁরা এইভাবে কমিউনিস্টদের গোপনে সাহায্য করছিলেন, তাঁদের বলা হত তরমুজ। যাঁদের দেখে বোঝার উপায় নেই। বাইরেটা সবুজ, যা কংগ্রেসের রং, কিন্তু ভিতরটা লাল, যা কমিউনিস্টদের পরিচয়। যেমন তরমুজের হয়। সেই থেকে কংগ্রেসের কিছু নেতাকে তরমুজ বলা শুরু হল। আবার কংগ্রেসের কেউ কাউকে অপমান করতেও বলতে শুরু করলেন, ‘ও তো তরমুজ’। এমন মন্তব্য শুনলে খুবই চটে যেতেন কংগ্রেস নেতারা।
দেশের মুসলিমরা মোদী-অমিতের বিরুদ্ধে, হিন্দুবিদ্বেষী নন
তার পর বহু বছর কেটে গিয়েছে। এখন ফল হিসেবে তরমুজের কদর না কমলেও, তরমুজ নেতাদের আর দেখা যায় না। দেখা যায় না বললে ভুল হবে। আসলে বাংলার রাজনীতিই এখন বদলে গিয়েছে। একসময়ে গোপনে সিপিএমকে সাহায্য করলে তরমুজ বলা হত। এখন তো তরমুজের দিন ফুরিয়েছে। গোপনে সাহায্য আর নয়, প্রকাশ্যেই কংগ্রেস-সিপিএম জোট বাঁধছে ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচন থেকে। দুই দলে হাত মিলিয়ে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধেও মিছিল এখন নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। টেলিভিশনে দেখা গেল সোমেন মিত্র বলছেন, নাগরিকত্ব আইনকে একমাত্র কংগ্রেস এবং বামপন্থীদের যৌথ আন্দোলনই রুখতে পারে।
তরমুজ খুবই প্রাচীন ফল। চিনে সবথেকে বেশি তরমুজ উৎপন্ন হয়। আফ্রিকার কালাহারি মরুভূমিতে প্রায় দু’হাজার বছর আগে তরমুজ চাষ হত বলে বই-পত্রে উল্লেখ রয়েছে। ১৬১৫ সালে এই শব্দটি অভিধানে জায়গা পায়। কিন্তু বাংলা অভিধানে যে তরমুজ পাওয়া যায়, তবে সেখানে ফল তরমুজের কথাই বলা আছে। রাজনৈতিক তরমুজ শব্দটি বাংলা অভিধানে জায়গা করে নিতেই পারত, কিন্তু তেমন হয়নি। অক্সফোর্ড অভিধানে যেমন হয়, নিয়মিত নতুন নতুন শব্দ ঢোকে, বাংলা অভিধানে তেমন নতুন নতুন শব্দ অন্তভুক্ত করার চল নেই, ব্যবস্থাও নেই। হয়তো আরও বেশ কয়েক বছর বাদে লোক-জন ভুলেও যাবে রাজনৈতিক তরমুজের গল্প।
সিপিএমের নেতৃত্বে ৩৪ বছরের বামফ্রন্টের শাসনে আর একটি শব্দও মুখে মুখে ঘুরত। এলসি। এলসির (লোকাল কমিটি) দাপট ছিল পাড়ায় পাড়ায়। এলসি শব্দ ঘিরে একটা সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতার বলয় তৈরি হয়েছিল। বামপন্থীরা ক্ষমতার বাইরে এসে পড়ায় এখন এলসি শব্দ হীনবল হয়ে টিম টিম করছে। এই শব্দটিও এখন এনডেঞ্জার্ড স্পিসিসের মত। বা বলা যায় লুপ্তপ্রায় বিরল-শব্দ।
আজাদি শ্লোগান: উত্তর-আধুনিক রামধনু স্বর
এবার একটি আপাত অরাজনৈতিক শব্দ-বন্ধের প্রসঙ্গে আসা যাক। শব্দ জন্ম নেয় সামাজিক রাজনৈতিক টানাপোড়েন থেকে। আজ থেকে চার-পাঁচ দশক আগের কথা। তখন কলকাতার রাস্তা ঘাট আজকের মতো ছিল না। এখানে ওখানে প্রায়ই মাটি খুঁড়ে রাস্তায় ফেলে রাখা হত। উন্নয়নের কাজ করত সিএমডিএ। আজ যার নাম কেএমডিএ। সেই সময় সিএমডিএকে ব্যঙ্গ করে লোকজন নাম দিয়েছিল, ‘কাটছি মাটি দেখবি আয়’। এখন অবশ্য কেএমডিএ-কে কেউ আর এই নামে চেনেন না।
একটা পুরোনো শব্দ, যার ব্যবহার ইদানিং প্রায় উঠেই গিয়েছিল, ফের ফিরে এসেছে সন্ত্রাসবাদীদের হাত ধরে। লস্কর। লস্কর বললে অবশ্য বোঝা যাবে না। লস্কর এ তৈবা। আমরা সন্ত্রাসবাদী হামলার কথা ছাড়া লস্কর শব্দ ব্যবহার করি না বললেই হয়। ১৬০৩ সালে আকবরের বঙ্গদেশ জয়ে সেনাবাহিনী পাঠানোর কথা ভারতচন্দ্র কবিতায় লিখেছিলেন, ‘আগে পাছে দুই পাশে দু’সারি লস্কর। চলেন মানসিংহ যশোহর নগর’। লস্কর মানে ফৌজ, সেনা, সিপাই। ফারসি শব্দ। বাংলায় অবশ্য ‘গদাই লস্করি চাল’ বলে একটা কথা চালু আছে। গদা, হরিচরণ যার অর্থ লিখেছেন, লৌহময় অস্ত্র, যাহা মেঘবৎ শব্দ করে। সেই ভারি অস্ত্রটি নিয়ে তো আর হন হন করে বা টগবগিয়ে যাওয়া যায় না। গতি মৃদুমন্দই হয়ে পড়ে গদার ভারে। সেই গতি থেকেই সম্ভবত এসেছে ‘গদাই লস্করি চাল’ , কুঁড়েমি, উদ্যমহীনতা বোঝাতে। তবে ‘লস্করি চাল’ মানে অবশ্য অভিধান বলছে, লস্করের ন্যায় নিয়ন্ত্রিত চলন।
রাজনীতির বাইরেও এমন ঘটনা নিয়মিত ঘটে। কিছু শব্দের ব্যবহার কমে যায়, কিছু শব্দ হারিয়ে যায়, তেমনই আবার কিছু শব্দ থাকে, আমরা কিন্তু যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে চলি, যার অর্থ আমরা জানি না। বাসন-কোশনের ‘কোশন’ শব্দের মানে কী আমরা জানি না। যেমন জানি না আশেপাশের ‘আশে’ শব্দের মানে। যত্ন-আত্তি বলি, কিন্তু ‘আত্তি’ মানে জানি না। কলিম খান তাঁর ‘বাংলা ভাষা: সাতরাজার ধন মানিক আছে যেখানে’ নামে একটি অসাধারণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন এই নিয়ে। কলিম খান, রবি চক্রবর্তী লেখা ‘প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ে এই প্রবন্ধটি আছে।
মগজাস্ত্র শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন সত্যজিৎ রায় জয়বাবা ফেলুনাথ-এ। আবার দিদি, এই শব্দটি বাংলায় জাঁকয়ে বসেছে গত ৭-৮ বছরে। সঙ্গে নতুন এসেছে ‘দিদিকে বলো’। অসম, বিহার, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু ইত্যাদি রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, কিন্তু রাজনৈতিক শব্দ হিসেবে ভাষায় দিদির মতো শক্ত-পোক্ত জায়গা করে নেওয়া, সে শুধু এই রাজ্যেই হয়েছে।
সেনাপ্রধানের বক্তব্য, এবং জরুরি অবস্থার কিছু কথা
শব্দের প্রচলিত অর্থ ত্যাগ করে ব্যঙ্গাত্মক অর্থ বের করেছিলেন মার্কিন লেখক এবং সাংবাদিক অ্যামব্রোস বিয়ের্স। ১৯ শতকের এই সাংবাদিক ব্যবসা শব্দের যে অর্থ লিখেছিলেন তা বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘ব্যবসা এক ধরনের লেনদেন, যেখানে অমল কমলের কাছে রাখা বিমলের টাকা ছিনিয়ে নিলে সেই ক্ষতিপূরণের জন্য, কমল বিমলের পকেট থেকে শ্যামলের টাকা কেড়ে নেয়’। ক্যানন বা কামানের অর্থ তিনি লিখেছেন, ‘একধরনের যন্ত্র যা দিয়ে বিভিন্ন দেশ তাদের সীমানা নির্ধারণ করে।‘ বাংলায় হিমানীশ গোস্বামী তাঁর অভিধানাই পানাই বইয়ে এমন অনেক শব্দের নতুন নতুন অর্থ খুঁজে বের করেছেন।
এবার অভ্র বসুর বাংলা বুৎপত্তি অভিধান ‘শব্দগল্পদ্রুম। এই বই একটি অসাধারণ সংকলন, যেখানে লেখক শব্দের হারিয়ে যাওয়া অর্থ খুঁজে বের করেছেন। যেমন, খাণ্ডারনি। লেখক লিখছেন, ‘খাণ্ডারবাণী হল ভারতীয় সঙ্গীতের এক বিশিষ্ট গায়নপদ্ধতি, যেখানে বীররসের প্রাধান্য। সেই গায়নপদ্ধতির নামানুষঙ্গেই জাঁদরেল দজ্জাল মহিলা হলেন খাণ্ডারনি। জাঁদরেল শব্দটি ইংরেজি ‘জেনারেল’ শব্দের বঙ্গীকৃত রূপ। মিলিটারি মেজাজ বোঝাতেই এই শব্দের প্রয়োগ’।
অর্কিড। ‘অর্কিডের সৌন্দর্য মানুষকে মুগ্ধ করে, তবে শব্দটির বুৎপত্তি রক্ষণশীল মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে। অর্কিড এসেছে লাতিন orchis বা গ্রিক orkhis থেকে, যার অর্থ অণ্ডকোষ। অর্কিডের জোড়া শিকড়ের সঙ্গে অণ্ডকোষের দৃশ্যসাযুজ্যের কারণেই এই নাম। অভ্র বসু লিখেছেন, শ্বশুর শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ, যে তাড়াতাড়ি খায়। তবে কী ভাবে স্ত্রী বা স্বামীর পিতার সঙ্গে শ্বশুর শব্দ জুড়ে গেল তার স্পষ্ট কোনও উত্তর নেই। এমন অসংখ্য শব্দ ও তার বিস্ময়কর অর্থ নিয়ে এই অভিনব অভিধান বাংলা ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নেবে সন্দেহ নেই।
রাজশেখর বসুর দাদা শশীশেখর বসু তাঁর ‘যা দেখেছি যা শুনেছি’ সংকলনে লিখেছেন, ‘খানগি’ মোটেই খারাপ শব্দ নয়। ‘খানগি’ মানে কনফিডেনশিয়াল। হাইকোর্টে, সেক্রেটারিয়েটে অতীতে পশ্চিমে নাকি হরদম কনফিডেনশিয়াল ফাইলকে ‘খানগি ফাইল’ বলা হত। কনফিডেনশিয়াল ক্লার্ককে বলা হত ‘খানগি ক্লার্ক’। এর পর বাঙালি প্রথমে এই শব্দকে জুড়ে দিল রেড লাইট এরিয়ার সঙ্গে, তার পর শব্দটির ডানদিকে ‘ছেলে’ বসিয়ে তৈরি করল একটি ‘স্ল্যাং’। এইভাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দের উপর অশ্লীলতার তকমা লাগিয়ে দিল সময়। দেশে যত ‘কনফিডেনশিয়াল সেক্রেটারি’ আছেন তাঁরা এখন আর মোটেই আর রাজি হবেন না ওই শব্দটিকে ফের পুরোনো অর্থে ফিরিয়ে আনতে!
আঁতকে উঠবেন না, এ লড়াই মুসলমানদের
আমরা এখন বাংলায় দিব্বি লিখছি ‘অচ্ছে দিন’, ‘নোটবন্দি’, ‘জিএসটি’। এর জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য নরেন্দ্র মোদীর। তবে তাঁর ‘মিঁত্রো’ বাঙালি নেয়নি।
শেষ করি অত সম্প্রতি বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়া একটি নতুন রাজনৈতিক শব্দ দিয়ে শব্দ দিয়ে। যার নাম ‘এনার্সি’। ইংরেজি ‘এন আর সি’কে অনেক জায়গাতেই লেখা হচ্ছে এনার্সি। এত অল্প সময়ে এত বেশি কথা এবং লেখা হয়েছে এই এনার্সি নিয়ে, বোঝাই যাচ্ছে বাঙালি জীবনে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে চলেছে। এই একটি শব্দকে ঘিরে বঙ্গ রাজনীতি অদূর ভবিষ্যতে আবর্তিত হবে, অন্তত এই মুহূর্তে খুবই মনে হচ্ছে। স্লোগান উঠছে, ‘সবহিকা খুন হ্যায় শামিল ইহাঁ কি মিট্টিমে। কিসি কে বাপ কা হিন্দুস্তান থোড়ি হ্যায়’। কবি রাহত ইন্দোরি-র লেখা এই কথাগুলোও মনে হচ্ছে যায়গা করে নিচ্ছে আমাদের ভাষায়।
(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত।)
এই কলামের সব লেখা পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে