গৌতম ঘোষদস্তিদার
সম্প্রতি কেন্দ্র এবং রাজ্যস্তরে বিদ্যালয়ের চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে দুই-সরকারের হেলদোলহীন আচরণে সাধারণ মানুষ আর তেমন-বিস্মিত ও হতভম্ব নয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্তরে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির তুলনায় এইসব দুর্নীতি নেহাতই মূষিকসম। কিন্তু, মূষিকেরাও যে সম্মিলিতভাবে ভূমিধস সম্ভব করতে পারে, তা আমাদের অজানা নয়। তাই এই দুই-সরকারের, বিশেষত কেন্দ্রের, সূক্ষ্ম রাজনীতিপ্রবণ সিদ্ধান্ত আমাদের মতো ঘরপোড়া গরুদের বিচলিতই করে। সর্বোপরি, নরেন্দ্র মোদীর মতো বাগ্মী ও নীতিবাদী প্রধানমন্ত্রী (পরীক্ষার আগেও ছাত্রদের কাছে মনের কথা বলেছেন যথারীতি) যখন জানিয়ে দেন, দ্বাদশশ্রেণির অঙ্কের প্রশ্নফাঁসের কারণে নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই, তখন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরের বিনিদ্ররজনীর অবসান ঘটলেও (বলেছিলেন, প্রশ্নফাঁসে তাঁর নিদ্রাকণ্টকী হয়েছে), সাধারণ শিক্ষাব্রতী মানুষের নতুন করে বিনিদ্রার শিকার হবেই। বুধবার সেই সিদ্ধান্ত-অনুযায়ী সিবিএসই-র দ্বাদশশ্রেণির লাখ-ছয়েক ছাত্রের অর্থনীতির পরীক্ষা ফের নেওয়া হলেও, আবার অঙ্কের পরীক্ষা থেকে রেহাই পেল তারা। অথচ, দুটি বিষয়ের প্রশ্নই পরীক্ষার প্রায়-ন-ঘণ্টা আগে ফাঁস হয়েছিল। অঙ্ক-পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল অন্তত ১৬-লক্ষ। অবশ্য, রাজ্যে শাসকদলের এক ছাত্রহিতার্থী প্রধানশিক্ষকের প্রশ্নফাঁস-নাটিকার যবনিকা পড়েছে প্রথম দৃশ্যেই।
আরও পড়ুন, কুমারীধর্ষণের চরম শাস্তিতে সক্রিয় সরকারঃ একটি প্রতিক্রিয়া
কিন্তু, এক-যাত্রায় এমন পৃথক-ফল হল কেন? আসলে, নির্বাচনের প্রাক-বছরে দেশের ১৬-লক্ষ ছাত্রর নতুন করে পরীক্ষাগ্রহণ শাসকদলের কাছে আত্মঘাতী হতে পারে। কেননা, কেন্দ্রের শাসকদলটি এমনিতেই যখন নানা দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতায় অভিযুক্ত, তখন নতুন করে ১৬-লক্ষ পরিবারের বিজেপি-বিরূপ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। সাধারণ হিসাবেই ওই ১৬-লক্ষ পরিবারে অন্তত চারজন করে ভোটার আছেন। ৬৪-লক্ষ ভোটারের মূল্য শাসকদলের কাছে স্বভাবতই অপরিসীম। নিন্দুকরা এমন ভাবলেও, নীতিবাদী প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই ছাত্রদের ভবিষ্যতের মূল্যে ভোট-কেনার প্রত্যাশী নন। তিনি কেবল নীতিবাগিশ নন, যুক্তিবাদীও। তিনি তাই নিশ্চিতভাবেই জানিয়েছেন, অঙ্কের প্রশ্নফাঁসের সুবিধা অধিকসংখ্যক ছাত্রের কাছেই অধরা ছিল (কোন সূত্রে তা জানা ও মানা গেল, তা রহস্যাবৃত), তাই তাদের সততায় সন্দেহপোষণ মোটেই সমীচীন নয়। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বিরোধীরা যতই সন্দেহ করুন, তাঁর ছাত্রবত্সলতা ও যুক্তিসিদ্ধতায় বিন্দুমাত্র ফাঁক নেই। হয়তো, সে-জন্যই আমরা দেখলাম, বুধবার আবার অর্থনীতির পরীক্ষার ‘সহজ’ প্রশ্নপত্রে খুশি ছাত্ররা। নতুন করে পরীক্ষা নিয়ে বা ছাত্র ও অভিভাবকদের ‘খুশি’ করে, সরকার বা পর্ষদ প্রশ্নফাঁসের কারিগরদের আড়াল করতে চাইছে কি না, সে-প্রশ্ন না-তুলেও এতটুকু ভাবাই যায়, ফের অর্থনীতির পরীক্ষার মাধ্যমে সরকার ও পর্ষদ আপাতত সখাত-সলিল থেকে উদ্ধার পেল।
আরও পড়ুন, পৌরুষ! আর চাই না
কিন্তু, সত্যিই কি বিষয়টি এত অকিঞ্চিত্কর যে, কৃতবিদ্য প্রধানমন্ত্রী এক-টুসকিতে সব সামলে নিলেন? মানুষ এত-সহজেই বিশ্বাস করে নিল, প্রধানমন্ত্রী তাঁর মনের কথার মতোই অত-কোমলপ্রাণ (সাপ্তাহিক মন কি বাতে তিনি একটি সুবিধা পান, তেড়িয়া-সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হয় না তাঁকে) যে, তিনি সুকুমারমতি ছাত্রদের প্রকৃতই অত-বিশ্বাস করেন? তিনি জানেন না, এই ছাত্ররাই একদিন জওহরলাল নেহরু বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে? সেখানে গিয়ে এক-একজন রোহিত ভেমুলা বা কানাহাইয়ালাল হবে? ছাত্রদের প্রতি তাঁর বিশ্বাস সহজাত, এ-কথা শুনলে কি দীনদয়াল উপাধ্যায়ও হাসবেন না? আর, বিশ্বাসের কথা আসবেই বা কেন? ছাত্ররা কি তাঁর বিশ্বাসভাজন হতে চেয়েছে? অঙ্কের প্রশ্ন যদি একটি ছাত্রও পায়, তাহলেও তা দুর্নীতি। ভবিষ্যতে সেই দুর্নীতির কলঙ্ক বইতে হবে এই বছরের প্রতিটি ছাত্রকেই। খেদের বিষয় যে, তারা কষ্টিপাথরে যাচাই হওয়ার সুযোগ পেল না। প্রশ্নফাঁসের জন্য ১৬-লাখ ছাত্রই দায়ী নয় যে, তারা এই চিরকলঙ্কভার বইবে। তাতে কী! ততদিনে ভোটের বৈতরণী পেরিয়ে যাবেন হিসাবি প্রধানমন্ত্রী।
চাঁদের অন্য-পিঠও থাকে। আমরা দেখেছি, ইউপিএ-আমলে বিজেপি যতই আধারসংখ্যার বিরোধিতা করুক (যদিও বিষয়টি প্রথম ভেবেছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী), ক্ষমতায় এসে ১৮০-ডিগ্রি ঘুরে গেছেন নরেন্দ্র মোদী। তিনি, যে-কোনও একনায়কের মতোই, দেশের প্রতিটি মানুষকে সন্দেহভাজন মনে করে তাদের রক্তকরবীর খনিশ্রমিকের মতো সংখ্যাচিহ্নিত করতে বদ্ধপরিকর। তাঁর এই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন কেবল দেশের কুবেররা। তাঁরা ব্যাংকের বিপুল টাকা মেরে বিদেশে পালাতে পেরেছেন অনায়াসে। কিন্তু, শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্রদের তিনি নিশ্চয়ই সন্তানতুল্য দেখেন। বিশেষত, যুবাবয়সে চা বিক্রি করে গ্রাসাচ্ছাদন করেছেন বলে গরিব ছাত্রদের লড়াইও তাঁর অজানা নয়। ফলে, তাদের সততায় বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই তাঁর। যদিও, সিবিএসই-র অর্থনীতির ছাত্ররা থেকে গেছে সন্দেহভাজনই। কেননা, তারা ভবিষ্যতে এক-একজন অমর্ত্য সেন, কৌশিক বসু বা রঘুরাম রাজন হয়ে উঠতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর এই হিতবাদী সিদ্ধান্তে নিশ্চয়ই তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়ে যাবে। কিন্তু, ছাত্রদের যা ক্ষতি হওয়ার, হয়ে গেল।
আরও পড়ুন, যৌনবিশ্বে কীসের হাতছানি
এবারের প্রশ্নপত্রফাঁসের সুত্রে আমাদের মনে পড়েই বিজেপি-শাসনে সেই ঐতিহাসিক ‘ব্যাপম’ (বৈষয়িক পরীক্ষা মণ্ডল) কেলেঙ্কারির কথা। ২০১৩ সালে মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিং চৌহানের মুখ্যমন্ত্রিত্বের শুরুতেই সেই কেলেঙ্কারির পরদাফাঁস হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীর শ্যালক থেকে রাজ্যপালের পুত্রের মতো রথি-মহারথিরাও অভিযুক্ত হয়েছিলেন সেই কেলেঙ্কারিতে। পুলিশি হেফাজত বা সড়ক-দুর্ঘটনায় সংশ্লিষ্ট অন্তত ১০০জনের মৃত্যু হয়েছিল। গৌরী লঙ্কেশের মতো রহস্যমৃত্যু হয়েছে সাংবাদিক অক্ষয় সিংয়েরও। তাঁরা দু-জনেই সরকারি কেলেঙ্কারি ফাঁস করেছিলেন। এখনও, রাজ্যের বিশেষ তদন্তবারী দলই (সিট)ব্যাপমের তথাকথিত ‘তদন্ত’ করে যাচ্ছে। আজও সেইসব মৃত্যুর কোনও কিনারা হয়নি। সিবিআই-কে কাছে ঘেঁষতে দেননি মুখ্যমন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদী কখনও সে-বিষয়ে টু-শব্দটি করেননি। ব্যাপমের প্রশ্নফাঁস ও উত্তরপত্র জোগান দেওয়ায় যে বিপুলপরিমাণ টাকার লেনদেন হয়েছিল, তা সহজ-অনুমেয়। কেননা, সরকারি চাকরির ওই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা নেওয়া হয় উচ্চপদাধিকারী নিয়োগের জন্য। যারা টাকার বিনিময়ে ওই পরীক্ষার চৌকাঠ পেরিয়ে সরকারি আধিকারিক হয়েছে, তারা যে এতদিনে নিজেদের বিনিয়োগ-করা টাকা সাধারণজনের থেকে উসুল করে নিয়েছে, তা-ও নিশ্চিত। এবারের প্রশ্নপত্রফাঁসের ঘটনাও যে তেমনই কোনও হিমশৈলর চূড়া নয়, তা কে বলে দেবে!