Advertisment

অশ্লীলতার দায় বড় দায়, বিশেষত এ রাজ্যে

দু'একটা সহজ সরল কার্টুন আঁকার দায়ে যাদবপুরের অধ্যাপককে কাঁদিয়ে ছেড়েছেন বর্তমান রাজ্য সরকার। তাই এখন অধিকতর পবিত্রতা দেখাতে এই বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর ওপর লঘু পাপে গুরুদণ্ড লাগু হতেই পারে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
rabindra bharati university basanta utsav 2020

ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া থেকে, প্রকাশনার স্বার্থে পরিবর্তিত

রবীন্দ্রভারতীর দোল উৎসব নিয়ে এখন ভীষণ বিতর্ক। বুকেপিঠে কয়েকটি অশ্লীল শব্দ লিখে আনন্দ উৎসব করেছেন কিছু যুবক যুবতী। তাঁরা যে রবীন্দ্রভারতীর ছাত্রছাত্রী নন, এটুকু আপাতত জানা গেছে। সেই উৎসবের ছবি ভাইরাল হতে উপাচার্য পদত্যাগপত্র দাখিল করেছেন। অতঃপর সেই সব ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ক্ষমা চেয়ে গেছে।

Advertisment

একইরকম খবর উত্তরবঙ্গের কোন এক ইস্কুলে। কয়েকজন কিশোরী নাকি অশ্লীল প্যারোডি গেয়ে অন্তর্জালে ভাসিয়ে দিয়েছে। সেই ছবি দেখে বয়োজ্যেষ্ঠদের মনে হয়েছে যে সংস্কৃতি গোল্লায় গেল। তা সেই কিশোরীরাও ক্ষমা চেয়েছে বলে জানা গেছে। ঠিক এই জায়গাতেই আমার মতো বৃদ্ধ ভামদের উচিৎ এদেরকে একটু বুঝিয়ে বলা, এমনটি আর করিস না। 'রঙ লাগালে বনে বনে। ঢেউ জাগালে সমীরণে॥' এমন দিনে হয়ত অন্যরকম হাওয়া বয়ে গেছে। সকলে তো আর বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মতো জীবন সায়াহ্নে মননশীল নন। চটজলদি উৎসাহে পথ ভুলেছে কনিষ্ঠ পথিক। এখানেই বিষয়টির পরিসমাপ্তি হওয়া স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন: “দাদুর প্রতি আমার অসীম প্রেম আছে”: রোদ্দূর রায়ের একান্ত সাক্ষাৎকার

কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। সমাজের চৈতন্য ঠিক এই সময়ই জেগে ওঠে। বাংলার সংস্কৃতি যে কতটা গোল্লায় গেল সেই নিয়ে আলোচনা করার একটা সুযোগ পাওয়া গেল। অন্যদিকে যাঁরা সেই আলোচনা করেন, তাঁরা কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে পাবেন না যে নিজেদের অতীত ঠিক কতটা উজ্জ্বল। আসলে আয়নার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ালে সামনেটাই দেখা যায়। আলো বেচারি সরলরেখায় চলে, তাই অন্ধকারাচ্ছন্ন পেছন আয়নায় অনুপস্থিত। বিজ্ঞানে অবশ্য কিছুটা উপায় আছে। চুল কাটার সময় মাথার পেছনে একটা আয়না নেড়ে নাপিত যেমন ছাঁট দেখান, তেমনই আদর্শবাদী বিদ্বজ্জন ঘরে সোজাসুজি দুটো ড্রেসিং টেবিল রাখতে পারেন। তাহলে বুঝবেন যে এই কিশোরী বা যুবক-যুবতীদের নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হওয়ার মত কিছু ঘটে নি।

রাজ্য সরকারের আবার উভয় সঙ্কট। একে তো তাঁদের রাজত্বে বাংলার সংস্কৃতি একেবারে পথে বসেছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতে সকাল বিকেল 'চাঁদ উঠেছিল আকাশে'। সে গান তারপর অন্য সুরে গেয়েছেন রোদ্দুর বাবু। তাই শুনেই বোধহয় আগে কিছু শব্দ বসিয়ে পিঠে আবির মেখেছেন তন্বী যুবতীরা। অশ্লীল বলতে যে শব্দটি, তা কিন্তু সকলের পিঠে নেই, মাত্র একপিঠে। এখন তাই অন্যপিঠে তৃণমূল স্তরে বাংলার প্রকৃত সংস্কৃতি পৌঁছে দেওয়া জন্যে রাজ্য সরকারকে 'দাদুকে বলো' গোছের একটা কিছু শুরু করতে হবে। তবেই তো স্বর্গ থেকে কান পাতবেন বিশ্বকবি।

আরও একটা দিক আছে। দু'একটা সহজ সরল কার্টুন আঁকার দায়ে যাদবপুরের অধ্যাপককে কাঁদিয়ে ছেড়েছেন বর্তমান রাজ্য সরকার। তাই এখন অধিকতর পবিত্রতা দেখাতে এই বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর ওপর লঘু পাপে গুরুদণ্ড লাগু হতেই পারে। আসলে বাংলা সংস্কৃতির দারোয়ানদের সময় বিশেষে সন্দীপন, নবারুণ কিংবা রোদ্দুরকে সামলাতে গিয়েই নাভিশ্বাস ওঠে। সেখানে একপিঠ শব্দবন্ধ নিয়ে শালীনতার পুরোহিতদের হাবুডুবু খাওয়াটাই স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন: পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা কি ইয়েচুরিকে বাছবে?

ধরে নেওয়া যাক শব্দগুলো অশ্লীল। কিন্তু তার অন্য একটা ব্যাখ্যাও তো থাকতে পারে। ধরা যাক ওগুলো বানান ভুল। এই বঙ্গের শিক্ষা পর্ষদ তো জানিয়েই দিয়েছে যে বানান ভুলে নম্বর কাটা যাবে না। অর্থাৎ সরকারি স্তরে একথা একেবারে স্বীকৃত যে অভিধান বিস্মরণে পাপ নেই। বানান ভুলে তাই রস খুঁজলে ক্ষতি কি? বিটি রোডে ধারে রবীন্দ্রভারতীর 'দুই বিঘা জমি'-তে 'সপ্ত পুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া'-র শেষে যদি চন্দ্রবিন্দুপ্রাপ্তি হয়, তাহলে তাকে বানান ভুল বলে ধরে নিলেই তো সাত খুন মাফ।

অবশ্য তা না হলে কবির ভাষা ধার করে নেতা-মন্ত্রীরা দু'পা ছড়িয়ে বাংলা সংস্কৃতির অন্তর্জাল (অন্তর্জলি নয়) যাত্রায় কাঁদতেই পারেন 'রোদনভরা এ বসন্ত সখী কখনো আসে নি বুঝি আগে'-র সুরে। সাবধানে থাকবেন, সেখানেও ছন্দ মিলিয়ে শব্দের প্রথম অক্ষর বদলে দিলে কবিগানের দফারফা। আবহাওয়া আজকে আবার মেঘলা। বৃষ্টি পড়ছে। ফলে বর্ষণসিক্ত বাঙালি সমাজের সংস্কৃতিবান এবং বতীদের কান্না আবার সেই বৃষ্টির জলে আড়াল না হয়ে যায়।

আরও পড়ুন: বাংলা ভাষা ও ভাবনায় ইংরেজি আধিপত্য

বাঁকা কথা অনেক হলো। এবার কাঠের স্কেল হাতে সোজা রেখায় শব্দ আঁকা যাক। এই বাংলার প্রধান চার রাজনৈতিক দলের (যদি বুঝতে অসুবিধে হয় তাই নামগুলো লিখে দেওয়াই ভালো - তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস) এই অশ্লীলতা নিয়ে বলার কোনও জায়গা নেই। কারণ তাদের প্রতিটি দলে এমন নেতানেত্রী আছেন যারা এর চেয়ে খারাপ কথা সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে বারবার বলেছেন। সেই কথাগুলো এখানে সাজিয়ে দিলে সত্যিই বাংলা ভাষার অপমান হয়। সেইসব নেতানেত্রীর কিন্তু কোনও শাস্তি হয় নি। কেউ ক্ষমা চেয়েছেন, কেউ বা সেটুকু ভদ্রতাও দেখান নি।

বিভিন্ন দলের নেতানেত্রী তাঁদের কলেজে পড়া দামাল ছেলেদের সামলাতে পারেন না। তাঁদের দলের বুড়ো খোকারা অক্সিজেনের অভাবে ভুলভাল বকে ফেলেন। সেখানে কোনও শাস্তি নেই। আর কিছু ছেলেমেয়ে সামান্য দুষ্টুমি করায় এত কথা! এই বাংলাতেই কোনও ইস্কুলে কিশোর-কিশোরী ভালোবাসার তীব্রতায় নিয়ম ভাঙলে শাস্তির ভয়ে তাদের বাড়ি ফিরে ছাদ থেকে ঝাঁপ দিতে হয়। সংবেদনশীল সমাজের ন্যুনতম দায়িত্ব, তাদের শাস্তি না দিয়ে ঠিকটা বোঝানো।

চলুন সবাই মিলে কান মুলে দিই রবীন্দ্রভারতীতে গুলিয়ে ফেলা যুবক-যুবতীদের, কিংবা উত্তরবঙ্গের স্কুল কিশোরীদের। সেটাই যথেষ্ট শাস্তি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখার প্যারোডি দেখলে হয়ত মজাই পেতেন। এই বাচ্চাগুলোকে বলতেন সব ভুলে সামনের দিনগুলোতে আবার দোল উৎসবে মেতে উঠতে। তবে হ্যাঁ, এবার একটু সাবধানে। আর এদের যদি প্রশাসনিক কোন শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে এই লেখাই হোক তার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ।

প্রশাসক বা শাসক সাধারণভাবে ক্ষমতার দাপটে নিজের অতীত ভুলে যান। শাস্তি দেওয়ার আগে তাঁদের উচিৎ চালুনি আর ছুঁচের মাপগুলো একবার ভার্নিয়ার স্কেল দিয়ে মেপে নেওয়া। সবশেষে আসুন, দাদুর ভাষায় আর একবার ক্ষমা চেয়ে নেওয়া যাক, 'ক্ষমা করো আজিকার মতো - পুরাতন বরষের সাথে পুরাতন অপরাধ যত'। সৎ, নিষ্কলুষ, সংস্কৃতিবান, শালীন প্রশাসক এবং শাসককুল শুনছেন কি? আমরা সবাই হাঁটু গেড়ে ক্ষমা চাইছি। পিঠে আর আবির মেখে বানান ভুল করব না।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

Anyo Paksha
Advertisment