Advertisment

দীনেশ বাজাজকে দাঁড় করিয়ে অযথা বদনামের ঝুঁকি নিল তৃণমূল

ঘটনা হল, ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত, মাঝে কয়েক বারের বিচ্ছেদ বাদ দিলে, তৃণমূল বিজেপির সঙ্গে ছিল। সেই সময়ে মমতা আরএসএসের সভায় গিয়ে তাদের দেশপ্রেমিকের তকমাও দিয়ে এসেছেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Dinesh Bajaj, Rajya Sabha

শেষ মুহূর্তে প্রার্থী হয়েছেন দীনেশ বাজাজ

রাজ্যসভা ভোটে প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক দীনেশ বাজাজকে দাঁড় করিয়ে অযথা বদনামের ঝুঁকি নিল মা-মাটি-পার্টি। দলের ৪ প্রার্থী সুব্রত বক্সী, দীনেশ ত্রিবেদী, অর্পিতা ঘোষ, মৌসম নুরকে জিতিয়ে তৃণমূলের বাড়তি ভোট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, দীনেশ বাজাজকে দেওয়া হবে। প্রতিশ্রতি যে দিয়েছেন তা দীনেশবাবুই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন মনোনয়ন জমা দিতে এসে। এবং তৃণমূলের পক্ষ থেকে এমন কথা বলা হয়নি যে দীনেশবাবু ঠিক বলছেন না। এর ফলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে বিজেপি যদি হুইপ না দেয়, বিজেপির কিছু ভোট দীনেশের দিকে চলে যেতেই পারে।

Advertisment

ইতিমধ্যেই বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসু মন্তব্য করেছেন, নির্দলকে ভোট দিতে অসুবিধা কোথায়! কিন্তু প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক দীনেশ বাজাজ এখন তৃণমূল সমর্থিত মমতার স্নেহধন্য প্রার্থী। ফলে দীনেশর পক্ষে বিজেপির ভোট গেলে তা কার্যত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে বিজেপির ভোট হবে। তখন, বিরোধীরা যে আড়ালে এবং প্রকাশ্যে ‘দিদি-মোদী’ সেটিং-এর অভিযোগ ক্রমাগত তুলে থাকেন, সেই রাজনৈতিক প্রচার আবার সামনে চলে আসবে। তৃণমূলের পক্ষে সেই প্রচার মোটেই সুখকর নয়। এই প্রচারে মমতা নিজেও খুব বিরক্ত।

মধ্যপ্রদেশ, এবং রাহুল গান্ধীর পালছেঁড়া নেতৃত্ব

কিছু দিন আগেই তিনি নিজেই বলেছেন, ‘দিদি-মোদী’ এক নয়। এবং বাস্তব ঘটনা হল, আজকের রাজনীতিতে এক নয়ও। এই মুহূর্তে দেশের প্রধান বিজেপি বিরোধী-মুখ মমতাই।  কিন্তু ঘটনা হল, ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত, মাঝে কয়েক বারের বিচ্ছেদ বাদ দিলে, তৃণমূল বিজেপির সঙ্গে ছিল। সেই সময়ে মমতা আরএসএসের সভায় গিয়ে তাদের দেশপ্রেমিকের তকমাও দিয়ে এসেছেন। ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গার পরেও মোদি-মমতার ফুল দেওয়া নেওয়ার সম্পর্ক ছিল। এই সাম্প্রদায়িক মাখামাখির ফলে ২০০৪-এর লোকসভায় তৃণমূলের আসন ১-এ নেমে গিয়েছিল। অনেক লড়াই করে মমতা নিজেই তাঁর দলের শরীর থেকে বিজেপির গন্ধ মুছেছেন। দীনেশকে দাঁড় করিয়ে সেই স্মৃতি ফিরিয়ে আনার ঝুঁকি নিলেন মমতা।

ব্যক্তি বিকাশ ভট্টাচার্য যোগ্যতায় সব ক’জন প্রার্থীর মধ্যে সেরা, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তিনি যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের চক্ষুশূল, তা নিয়েও কোনও সন্দেহ নেই। কংগ্রেসের আব্দুল মান্নানের সঙ্গে চিট ফান্ড নিয়ে মামলা করে সিবিআই করে তৃণমূলের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন বিকাশ। ফলে বিকাশকে আটকানোর চেষ্টা হবেই। তৃণমূল গোপনে দিল্লিতে কংগ্রেসের হাইকমান্ডের সঙ্গে কথা বিকাশের বদলে প্রাক্তন স্পিকার মীরা কুমারকেও চেয়েছিল পঞ্চম প্রার্থী হিসেবে। কিন্তু রাজ্য কংগ্রেসের বাধায় সেটা হয়নি। এখন দীনেশকে দাঁড় করিয়ে হয়তো তৃণমূলের ভোট ম্যনেজাররা ভাবছেন যদি পাকেচক্রে কোনও ভাবে বিকাশকে আটকে দেওয়া যায় মন্দ কী! বিশেষ করে বিকাশ রাজ্যসভায় গিয়ে ফের চিটফান্ড নিয়ে সরব হওয়ার সম্ভাবনা মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বাংলার ‘রঙ্গ’ রাজনীতিতে শোভন, বৈশাখী ও রত্না

২৯৪ আসনের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় এখন বিধায়ক সংখ্যা ২৯৩। ফালাকাটা বিধানসভার বিধায়কের মৃত্যুতে একটি আসন শূন্য আছে। পদত্যাগ না করে তৃণমূল-বিজেপিতে চলে যাওয়া বিধায়কদের বাদ দিলে বাম-কংগ্রেসের মোট বিধায়ক সংখ্যা এখন ৫১ জন।

তৃণমূলের বিধায়ক সংখ্যা এখন ২০৭ জন। এর সঙ্গে আছেন বাম-কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যাওয়া ১৭ জন বিধায়ক। কিন্তু তাঁরা পদত্যাগ করে তৃণমূলের প্রতীকে জিতে আসেননি। খাতায়-কলমে তাঁরা এখনও বিরোধী দলের বিধায়ক। যেহেতু রাজ্যসভা ভোটে দলের প্রতিনিধিকে দেখিয়ে ভোট দিতে হয়, এই ‘আসলে দলত্যাগ করা কিন্তু খাতায়-কলমে দলত্যাগ না-করা’ বিধায়করা কোন দিকে ভোট দেন সেদিকে সবার নজর থাকবে। হুইপ থাকলে তাঁরা যদি তৃণমূলকে ভোট দেন, নতুন করে তাঁরা দলত্যাগ আইনের আওতায় পড়তে পারেন। প্রত্যেক প্রার্থীর জয়ের জন্য দরকার ৪৯টি ভোট। সেক্ষেত্রে তৃণমূলের ৪ প্রার্থীর জয়ের জন্য দরকার ১৯৬টি ভোট। তৃণমূলের নিজস্ব বিধায়ক ২০৭। তাহলে দেখা যাচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বলেছেন তাঁদের অতিরিক্ত ভোট দীনেশ বাজাজকে দেওয়া হবে, তার সংখ্যা হল মাত্র ১১টি ভোট। দীনেশ বাজাজ কি এই মাত্র ১১টি ভোটের জন্য এই নির্বাচনী মঞ্চে শেষ মুহূর্তের খেলোয়ার হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন? ফলে অনেকেই ধরে নিচ্ছেন ভোটের দিন  ২৬ মার্চ হয়তো কিছু চমক অপেক্ষা করে আছে।

পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি আসন সহ ১৭টি রাজ্যের ৫৬টি আসনে ভোট হবে। অন্য কোনও রাজ্য থেকে অবশ্য এই ধরনের জটিলতার কোনও খবর এখনও মেলেনি। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো। স্বাভাবিক অবস্থায় একেক জন প্রার্থীর জয়ের জন্য দরকার ৪৯টি করে ভোট। বিজেপির সায়ন্তন বসু যদিও বলেছেন নির্দল প্রার্থীকে ভোট দিতে কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু আবার যদি উল্টোটা হয়, অর্থাৎ যদি বিজেপি তাদের নিজেদের ৬ বিধায়ক এবং তাদের সঙ্গের অন্য দল থেকে আসা ১০ বিধায়ককে ভোটের দিন গরহাজির রাখে তাহলে প্রার্থী পিছু জয়ের জন্য ভোটের প্রয়জনীয় সংখ্যাটা ৪৯ থেকে আরও একটু কমে যেতে পারে।

বাম-কংগ্রেস ছেড়ে যে ১৭ জন বিধায়ক দলত্যাগ না করে তৃণমূলে গিয়েছেন, এবং যে ১০ বিধায়ক বিভিন্ন দল থেকে দলত্যাগ না করে বিজেপিতে গিয়েছেন, এই সব ক’টি ভোট পেলেও কিন্তু দীনেশ বাজাজের জয়ের সম্ভাবনা নেই। দীনেশবাবুকে জিততে হলে বাম-কংগ্রেসের ভোট ভাঙাতে হবে। সেটা কি সম্ভব? বাম-কংগ্রেসের নেতারা বলছেন অসম্ভব। তবে রাজীব গান্ধীর দলত্যাগ বিরোধী আইন এবং পরে অটলবিহারী বাজপেয়ীর জরুরি সংশোধনী সত্ত্বেও, নানা কারণ দেখিয়ে দলত্যাগের মতো একটি ‘অনৈতিক’ বিষয়  এখন বহু দলেরই ক্ষমতা অর্জনের গোপন অস্ত্র। এই কাজে দক্ষতায় সব থেকে এগিয়ে বিজেপি। তার পরেই নাম করতে হয় তৃণমূল কংগ্রেসের। ফলে ২৬ মার্চ ভোটের দিন কোনও চমক থাকবে কি না, থাকলে সেটা কী, তা আগাম আন্দাজ করা খুবই শক্ত!

(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)

এই কলামের সব লেখা, এইখানে

Bengal Line
Advertisment