Advertisment

একদিকে দেবীর আরাধনা, অন্যদিকে নাবালিকা ধর্ষণ

বিপদ কি শুধু মেয়েদের? যে বালক বা কিশোর ধর্ষণের মতো মারাত্মক অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, বিপদে কি সেও পড়ছে না? এমন এক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার পর কোনওদিন কি তার জীবন স্বাভাবিক ছন্দে ফেরে?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
gangrape, গণধর্ষণ

অকুস্থল তেলেঙ্গানার নিজামাবাদ জেলা। সম্প্রতি তিন বছর বয়সী এক শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করে এক নাবালক। বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে মেয়েটিকে নিয়ে গিয়ে এই ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটায় ছেলেটি। মেয়েটি বাড়ি ফিরে তার মাকে জানানোর পর, তিনি নিকটবর্তী মোপাল থানায় ছেলেটির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। আপাতত পকসো আইনের আওতায় তদন্ত শুরু হয়েছে।

Advertisment

অল্প কিছুদিন আগের কথা। গত ১৭ সেপ্টেম্বর ওড়িশার বারগার জেলার পইকমল এলাকায় ৯ বছরের বালিকাকে ধর্ষণ করে এক ১৪ বছর বয়সী কিশোর। একে অপরের খেলার সঙ্গী ওরা। খেলার সময়ই কাছাকাছি এক ঝোপের আড়ালে মেয়েটিকে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে পালায় ওই কিশোর। পরে মেয়েটিকে উদ্ধার করে তার পরিবার এবং আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শেষে মেয়েটির পরিবারের করা অভিযোগের ভিত্তিতে ওই কিশোরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

ওড়িশারই কেন্দ্রপাড়ার মধুপুর গ্রাম। গত অগাস্টে এক ৫ বছরের বালিকাকে ধর্ষণ করে এলাকারই এক কিশোর। ছেলেটির বয়স ১৬। মেয়েটিকে চকোলেটের লোভ দেখিয়ে কাছাকাছি এক চাষের ক্ষেতে নিয়ে গিয়ে এই চূড়ান্ত ন্যক্কারজনক কাজটি করে সে। ঘটনার পর মেয়েটি তার মাকে সব জানায়। আঘাতে জর্জরিত মেয়েটিকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। বালিকার মায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে ছেলেটিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তদন্ত চলছে।

আরও পড়ুন: ঋতু, নারী ও আমরা

রাজস্থানের ভরতপুর। ১০ বছরের এক বালক ধর্ষণ করে তার খেলার সাথী ৪ বছরের এক শিশুকন্যাকে। ঘটনাটি ঘটার আগের মুহূর্তেও আরও কয়েকজন বাচ্চার সঙ্গে খেলছিল দুজনেই। তারপর কখন যেন ওই শিশুকন্যাকে নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে মারাত্মক এই অপরাধ ঘটায় ওই বালক! নিকটবর্তী সিকরি পুলিশ স্টেশনে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। ছেলেটি ও মেয়েটি একে অপরের প্রতিবেশী। মেয়েটিকে অনেকক্ষণ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে ধর্ষিতা অবস্থায় তাকে ওই নির্জন স্থান থেকে উদ্ধার করেন তার মা। এটা এবছরের জুলাই মাসের ঘটনা। 

নারী ধর্ষণ।

নাবালিকা ধর্ষণ।

নাবালকের দ্বারা নাবালিকা ধর্ষণ।

প্রায় প্রতিদিনই খবরের শিরোনামে।

এরপরও এই সমাজের পিঠ চাপড়ে বলব না, কেয়া বাত! সত্যি উন্নতির শিখরে যাচ্ছি আমরা। আমরা। মানে মানুষ। যাকে বলে এ মহাবিশ্বের প্রাণীকুলের সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টি! 

প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে সেই সংক্রান্ত কিছু খবরের সন্ধান করব, এ তো আমাদের রুটিনের মধ্যেই পড়ে। এই রুটিন কাজটিও কতদূর গা ঘিনঘিনে হতে পারে, সেটা এই প্রথম অনুভব করলাম। অনুভব করলাম, আমাদের সমাজে কন্যাসন্তানের নিরাপত্তার প্রশ্নটি কোন খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে! যে কোনও বয়সে, যে কোনও পরিবেশে তার ফুলের মতো শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে পারে কীটের দল। হ্যাঁ, সেই কীটের দলও, যারা নিজেরাই এখনও নাবালকত্বের দরজা পেরোয়নি।

ধর্ষণ এক চরম ঘৃণ্য অপরাধ। একজন নাবালকের দ্বারা সংঘটিত হলেও, এই অপরাধের কোনও ক্ষমা নেই। আইন ও প্রশাসন সংবিধান মেনে তাকে কী শাস্তি দেবে, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু কোনও যুক্তিতেই তার এই অপরাধকে ছোট করে দেখা সামাজিক ভাবে সম্ভব নয়। যে শিশুকন্যা বা বালিকা এই জঘন্যতম অপরাধের শিকার, তার যন্ত্রণা, কষ্ট,অপমান ও গ্লানির দিকটা যদি আমরা বিচার করি, তাহলে ধর্ষকের বয়স কী, সে সাবালক না নাবালক, সেটা গৌণ হয়ে যায়। পাঠক মাফ করবেন। এখানে অপরাধী একজন নাবালক, এটা ভেবেও কিছুতেই তার প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারছি না। তবে, একজন প্রতিবেদকের তো কখনওই কোনও বিষয়ে একতরফা বিচার করা উচিত নয়। তাকে বাস্তবতাও ভুলে গেলে চলে না। দেশের আইন ও সংবিধানের প্রতিও যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রাখতে হয়। তাই এমন এক স্পর্শকাতর বিষয়কে সেই যুক্তির নিরিখেই দেখার চেষ্টা করব।

আরও পড়ুন: পীড়নের শিকার পুরুষও, সব সমাজেই

আইন প্রসঙ্গে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আইন করে অপরাধ বন্ধ করা গেলে, অপরাধের পুনরাবৃত্তি হতো না। এটা একটা সর্বজনীন উপলব্ধি। আসল কাজটা করে আমাদের মানসিকতা। অপরাধ করা বা না করা, দুটোই মনের ব্যাপার। এটা শুধু অপরাধী নয়, তার পারিপার্শ্বিক প্রসঙ্গেও উল্লেখ্য। এখানে একটা কথা অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলা প্রয়োজন, ভুলটা আমরা, সমাজের বড়রা, গোড়াতেই করি। আমরা বিপদের আশঙ্কায় শুধু মেয়েদের পায়ে বেড়ি পরাই। প্রতি মুহূর্তে তাদের বলি, এটা কোরো না। ওখানে যেও না। এই সময়ের মধ্যে ঘরে ফেরো। এরকম পোশাক পরো, এরকম পোরো না। বাড়ির ছেলেদের এসব প্রসঙ্গে কিছুই শেখাই না। বলি না, মেয়েদের সম্মান করো। তাদের ভোগ্যবস্তু হিসেবে দেখো না। তাদের কষ্ট, যন্ত্রণা, অপমানকে নিজের বলে ভাবো।

সমাজের শরিক উভয়েই, একে অপরের পরিপূরক, একথাও কি সচেতন শিক্ষার প্রয়োজনে বলি? লেখাপড়া করে গাড়িঘোড়া চড়ার ফর্মূলা মাথায় গুঁজে দেওয়াটাই আমাদের কাছে ছেলেমেয়ে মানুষ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। অথচ শুধু প্রতিষ্ঠা নয়, মানুষ হওয়ার আরও কিছু দায় আমাদের আছে, যেটা ভুলে যাওয়ার ফলেই এই যাবতীয় অসুস্থ প্রক্রিয়া। এতে আক্রান্ত নিষ্পাপ বাল্য ও কৈশোর। কখনও কখনও যৌবনে বা বার্ধক্যেও প্রবাহিত।

আজকাল কন্যাসন্তানের অভিভাবকরা মোটামুটি বিপদ সচেতন হয়ে গেছেন। পরিস্থিতির কারণে হতে হয়েছে তাঁদের। কিন্তু বিপদ কি শুধু মেয়েদের? যে বালক বা কিশোর ধর্ষণের মতো মারাত্মক অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, বিপদে কি সেও পড়ছে না? এমন এক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার পর কোনওদিন কি তার জীবন স্বাভাবিক ছন্দে ফেরে? এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, প্রায় প্রত্যেকটি ঘটনাই ঘটছে চেনাজানা মহলে। অর্থাৎ ধর্ষিতার সঙ্গেই বেড়ে উঠছে ধর্ষক। তাহলে কখন কোন প্রেক্ষিতে তার মধ্যে এই অপরাধ প্রবণতা জন্ম নিচ্ছে, সেটা বোঝা দরকার।

আরও পড়ুন: আমাদের সমাজ কি ধর্ষণকারীর স্বর্গরাজ্য নয়?

এই বিন্দু থেকেই আমাদের ভাবনাচিন্তার গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে যেতে হবে। বস্তুত, ধর্ষণ প্রতিরোধে এক পুরুষ সন্তানের অভিভাবকের দায়িত্ব অনেক বেশি। একেবারে শৈশব থেকেই তার ভাবনার জগৎ যাতে সুস্থপথে সঞ্চরণশীল থাকে, সেটার খেয়াল রাখতে হবে। স্মার্টফোনের দৌলতে বা সমাজের সামগ্রিক পরিবেশের মধ্যে ভুল পথে যাওয়ার বহু মালমশলা মজুদ, একথা মানছি। কিন্তু তার জীবনটা তো শুরু হচ্ছে তার ঘর থেকেই। সেখানে বড়দের একে অপরের প্রতি আচরণ, বিশেষত মা-বাবার মধ্যে সম্পর্কের সুস্থতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখতে হবে, একজন শিশু বাড়িতে যে ব্যবহার পায়, সেটাই সে ফিরিয়ে দেয় সমাজকে। 

মাথায় রাখতে হবে, শাসনের নামে অত্যাচার এক শিশুর সুস্থ মানসিক গঠনের ক্ষেত্রে প্রবল প্রতিকূল হতে পারে। শৈশব থেকে কৈশোর, অর্থাৎ যখন তার অনুভূতিগুলি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, সেই সময় দেখা বা ভুক্তভোগী হওয়া যে কোনও ঘটনাই তার মনোজগতের আমূল পরিবর্তন ঘটায়। এ বিষয়ে বড়দের লক্ষ্য রাখা একান্ত জরুরি। শৈশব থেকেই মেয়েদের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছে। সেটা সুস্থ ও স্বাভাবিক গতিতে চলছে কিনা, সেটা বিশেষত অভিভাবকদের লক্ষ্য রাখা দরকার। 

আমাদের দেশে এখনও যৌনতা বিষয়ে এক অদ্ভুত ছুতমার্গতা আছে। এও তো এক স্বাভাবিক জীবনধর্ম। যথাসময়ে সেই ধর্ম পালিত হওয়াই প্রকৃতির নিয়ম। এক্ষেত্রে দু'জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সম্মতি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সেটা ব্যতীত যখন বিষয়টি ঘটে, তখনই সেটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। এই সম্পূর্ণ শিক্ষাটাই যথাযথ সময়ে ছেলেমেয়েকে দেওয়া প্রয়োজন। তেমন অসুবিধা বুঝলে মনোবিদের পরামর্শও নেওয়া যেতে পারে। মোদ্দা কথা, অনুভূতির সূক্ষ্ম বিন্দুগুলি যখন থেকে জাগ্রত হচ্ছে, তখন থেকেই শিশুকে একটি যথার্থ বাস্তবধর্মী, সুস্থ, স্বাভাবিক, আনন্দময় পরিবেশ দিতে হবে। পড়াতে হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সংবেদনশীলতার পাঠ। নাহলে শুধু আইনের শাসনে এই ঘৃণ্য অপরাধ বন্ধ হওয়া অসম্ভব।

rape rape law
Advertisment