Advertisment

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়: মোদী-শাহের রাজনীতির বাঙালি বিকল্প

এখানে উদ্বাস্তুদের জমির মালিকানা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাপকের ধর্ম বিবেচনাধীন নয়। তাঁদের উদ্বাস্তু পরিচয়ই একমাত্র পরিচয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Refugee, Mamata Banerjee

অমিত শাহের সারা দেশে এনআরসি করে বেছে বেছে হিন্দুদের রেখে মুসলিম বিতাড়নের যে ঘোষণা, তাকে কার্যত চ্যালেঞ্জই জানালেন মমতা

তারপর, সমস্ত পথ একটাও কোনো কথা না বলে

Advertisment

আমরা হাঁটতে থাকি, হেঁটে যেতে থাকি

এক দেশ থেকে অন্য দেশে

এক ধর্ষণের থেকে আরো এক ধর্ষণের দিকে’ (শঙ্খ ঘোষ, দেশান্তর)

এনআরসি নিয়ে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের সঙ্গে সম্মুখ সমরে মমতা। রাজ্য সরকারের জমিতে যে উদ্বাস্তুরা ঘর বেঁধে ছিলেন তাঁদের জমির উপর আইনি অধিকার, অর্থাৎ মালিকানা, কিছুদিন আগেই দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এবার, সোমবার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর ঘোষণা, কেন্দ্রীয় সরকারের এবং বেসরকারি জমিতে যারা প্রায় ৪৮ বছর ধরে ঘর বেঁধে আছেন, জমির মালিকানা তাঁরাও পাবেন

আরও পড়ুন, তিন কেন্দ্রের উপনির্বাচন: আরও তলানিতে বাম-কংগ্রেস ভোট

প্রায় দেড় লক্ষ উদ্বাস্তু উপকৃত হবেন সব মিলিয়ে এই সিদ্ধান্তে। রাজ্য সরকারের দেওয়া জমির মালিকানা কারও থাকলে তাঁর নাগরিকত্ব নিয়ে কেন্দ্রের সরকার কোনও প্রশ্ন তুললে, তার পাশে যে রাজ্য দাঁড়াবে, এই সিদ্ধান্তের মধ্যে সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। তাছাড়া, এখানে উদ্বাস্তুদের জমির মালিকানা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাপকের ধর্ম বিবেচনাধীন নয়। তাঁদের উদ্বাস্তু পরিচয়ই একমাত্র পরিচয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। অমিত শাহ-নরেন্দ্র মোদীদের যে উদ্বাস্তু নীতি, তা সম্পূর্ণভাবে ধর্ম নির্ভর। এটা মমতার উদ্বাস্তু নীতির সঙ্গে একটা বড় ফারাক।

অমিত শাহের সারা দেশে এনআরসি করে বেছে বেছে হিন্দুদের রেখে মুসলিম বিতাড়নের যে ঘোষণা, তাকে কার্যত চ্যালেঞ্জই জানালেন মমতা। তিনি আগেই বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের একজনেরও নাগরিকত্ব বাতিল করা যাবে না। এবার তিনি আর এক ধাপ এগোলেন। আসামে যে ১৯ লক্ষ মানুষকে এনআরসি তালিকা থেকে বের করে দিয়ে ‘নাগরিক নয়’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১২ লক্ষ হিন্দু। এই নাম না থাকা মানুষদের দুর্ভোগের অন্ত নেই। আত্মহত্যাও করেছেন কেউ কেউ।

রাম মন্দির, ইউনিফর্ম সিভিল কোড, কাশ্মীর থেকে ৩৭০ প্রত্যাহার, এগুলো ছিল প্রথম যুগের হিন্দুত্ববাদীদের অ্যাজেন্ডা। মোদী-শাহ যুগের অ্যাজেন্ডা প্রথমে উন্নয়ন থাকলেও ক্রমাগত অর্থনৈতিক অধোগতির পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিত এনআরসিকে এ যুগের হিন্দুত্ববাদীদের নতুন এবং প্রধান অ্যাজেন্ডা করে তোলার চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে বলা হচ্ছে, হিন্দুদের কোনও ভয় নেই, নতুন আইন আসছে, এনআরসি থেকে বাদ পড়া হিন্দুদের রক্ষা করতে।

যদিও ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব বিচারের যে বিলের কথা বলা হচ্ছে, তা ভারতীয় সংবিধান বিরোধী বলে অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞদেরই মত। বোঝাই যাচ্ছে, ওই বিল পাশ হলে তা সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। এনআরসি এবং ‘হিন্দুদের কোনও ভয় নেই’, এই দুটি বিষয়কে একসঙ্গে করলে, এর অভ্যন্তরে লুকোনো বিদ্বেষের বীজটির অঙ্কুরোদগম হয়, ডালপালা মেলে। যার নাম ধর্মের রাজনীতি। আসামের এনআরসি থেকে বাদ পড়েছেন ১৯ লক্ষ মানুষ, যাঁদের মধ্যে ১২ লক্ষ হিন্দু। এই নিয়ে বিপুল অস্বস্তি হিন্দুত্ব শিবিরে। তার জবাবে এখনই ইঙ্গিত দেওয়া শুরু হয়েছে, ওই এনআরসি বাতিল হতে পারে।

আরও পড়ুন, ‘তৃণমূল না এনআরসি-র কাছে হেরে গেলাম’

কী হবে এখনই বলা কঠিন। তবে যদি তেমনই হয়, সেক্ষেত্রে ওই ১২ লক্ষ মানুষ, যাঁদের গায়ে একবার দেগে দেওয়া হলো, ‘তুমি ভারতের নাগরিক নও তবে তোমাকে ক্ষমা করা হলো’ বলে, এই ভাবেই তাঁকে একটু ছোট, একটু অনুকম্পার পাত্র করে তুলে, তাঁর মনে সংশয় ঢুকিয়ে দেওয়া হবে, পরে যে আর কোনও এনআরসি হবে না, তখন যে তাঁর নাম ফের বাদ পড়বে না, এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। অতএব নিশ্চিন্তে থাকতে হলে ঠিকঠাক চিহ্নে ভোটটা দিও ভাই। এটাও আরেক রকমের ভয়ের রাজনীতি।

বাঙালির কাছে কুড়ি শতকে সবচেয়ে অমানবিক শব্দটির নাম ছিল ‘দেশভাগ’। আর একুশ শতকে সবচেয়ে অমানবিক শব্দটির নাম ‘এনআরসি’। ইতিমধ্যেই ১৯ লক্ষ মানুষ ভয়ে ভয়ে আছেন। আরও মানুষ খোঁজা হচ্ছে ওই তালিকাকে দীর্ঘতর করার জন্য। প্রায় ৫২ হাজার সরকারি কর্মী ১০ বছরের পরিশ্রমে ১,২২০ কোটি টাকা খরচ করে এই ভয়ের শব্দটিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে।

'উদ্বাস্তু' শব্দটার ডানদিকে স্রোত কথাটা আমাদের বসাতে হয় প্রায়ই। কারণ, উদ্বাস্তুরা দলে দলে ছুটে চলেন স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মা, আত্মীয়দের প্রাণ বাঁচাতে। উদ্বাস্তু শব্দটার মধ্যে ভয় আছে। ভিটেমাটি থেকে বারবার উচ্ছেদের আতঙ্ক আছে।

কেন হিন্দুত্ববাদীরা এই পথে হাঁটছে? হিন্দুত্ববাদীদের যেহেতু কোনও স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস নেই, সম্মান অর্জন করার মতো কোনও অতীত নেই, ফলে তাঁরা মুখে যতই দেশপ্রেমের কথা বলুন না কেন, স্বাধীনতার তিন দশক পরে তাঁদের রাজনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি যা হয়েছে, তা হয়েছে মূলত বিদ্বেষ-নির্ভর রাজনীতিতে ভর করে। সংখ্যালঘুকে ভয় দেখানো, ভয় পাওয়ানো, তাঁদের কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে দেওয়ার ইচ্ছে, এটা একটা নির্দিষ্ট রাজনীতি, যা পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে গুরুত্ব পাচ্ছে। সেই তালিকায় ঢুকে পড়েছে আমাদের দেশও।

উদারতার রাজনীতি এই মুহূর্তে বিশ্ব জুড়েই পিছু হটছে, বিদ্বেষ নির্ভর-দেশপ্রেমবোধহীন-কঠোরভাবে রাষ্ট্রবাদী-সংখ্যাগুরুর এক সংকীর্ণ গণতন্ত্রের পথে হাঁটছে পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ। এই সংকীর্ণতার রাজনীতি জনপ্রিয় হচ্ছে আমাদের দেশেও। হচ্ছে বলেই আমাদের দেশের একটি রাজ্য কাশ্মীরে ১০০ দিনের বেশি ইন্টারনেট বন্ধ, বন্ধ স্কুল-কলেজ, সব বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা বন্দি এবং পেলেট গানে একের পর এক আহত শিশুর ছবি দেখেও গোটা দেশ কার্যত নীরব থাকে। নীরব থাকে দেশ জুড়ে দলিত বা মুসলিমদের গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনায়।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রচুর রাজনৈতিক সমালোচনা থাকতেই পারে। কিন্তু দেশকে বদলে দেওয়ার, ‘বিদ্বেষ-নির্ভর’ রাজনীতি দিয়ে এই যে দেশ দখলের প্রক্রিয়া, এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কাজটা সহজ নয়। অতীব কঠিন। বামপন্থীরা নীতিগতভাবে একই অবস্থানে থাকলেও, পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তারা এখন গুরুত্বহীন। ফলে মোদী-শাহের ‘বিদ্বেষ’-এর রাজনীতির বিরুদ্ধে মমতাই এখন মডেল সারা দেশে। যেসব বাঙালি মনে করেন, ধর্ম নয়, বাঙালি পরিচয়ই তাঁদের প্রথম পরিচয়, তাঁদের সমর্থন যে মমতার দিকে যাবে, সন্দেহ নেই।

(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)

Mamata Banerjee nrc Bengal Line
Advertisment