সংবিধান ছিল সংবিধানের মতো। সংসদে তর্ক-বিতর্ক হত, আদালতে আলোচনা হত। নাগরিকত্ব আইনকে ঘিরে, ৭০ বছর পর দেখা যাচ্ছে, ১ লক্ষ ১৭ হাজার ৩৬৯ শব্দের ওই বই, দেশের সংবিধান, নিয়ে কথা বলছেন সাধারণ মানুষ। লোকজন সংবিধানের প্রিঅ্যাম্বেল বা উপস্থাপনা আওড়াচ্ছেন। পাতা ওল্টাচ্ছেন বিভিন্ন ধারা-উপধারার। স্কুলে পাঠ্য হচ্ছে সংবিধানের অংশ। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট আমাদের স্বাধীনতা দিবস, আর তার ৮৯৫ দিন পরে ক্যালিগ্রাফি আর্টিস্ট প্রেম বিহারী নারায়ণ রায়জাদার হাতে লেখা (প্রথম দুটো কপি), নন্দলাল বসুর পরিকল্পনায় সুসজ্জিত সংবিধান ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি যখন লাগু হয়েছিল, তখনও বোধহয় সংবিধান নিয়ে আমজনতাকে এত কথা বলতে শোনা যায়নি। দেশের প্রজাতন্ত্র বোধহয় আরও এক ধাপ এগোলো। বলাই যায়, আলো ক্রমে আসিতেছে।
আমাদের সংবিধানকে অনেকে মনে করেন ধার করা। সম্পূর্ণ ভুল কথা। যুগে যুগে দেশে দেশে স্বাধীনতা, সাম্যের দাবিতে যে আন্দোলন, আত্মত্যাগের যে ইতিহাস, তা তো সমগ্র মানবজাতিরই সম্পদ। বিজ্ঞান, সাহিত্যের মতো। আর সেই সব আন্দোলনের নির্যাস রয়েছে আমাদের সংবিধানে। এটা ধার করা নয়। তাই আমাদের সংবিধানে পাওয়া যায়, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, আমেরিকার সংবিধানের ছায়া। ১৮৫৭-র যে বিরাট সিপাই বিদ্রোহ, তার প্রভাবেই ভারতে চালু হল নতুন আইন-কানুন, সেটা কী আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জন করা নয়! তার প্রভাব আছে সংবিধানে। ১৯৩৫-এর যে ভারত শাসন আইন, তাও কোনও উপহার ছিল না। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের ফল। তার প্রভাব তো বিপুল। আর শুধু সিপাই বিদ্রোহ নয়, আরও অসংখ্য ভারতীয়ের বিদ্রোহের প্রভাবও প্রত্যক্ষ, বা অপ্রত্যক্ষ ভাবে পড়েছে এই সংবিধানে। তার সঙ্গে এই সংবিধান একটা দীর্ঘ গবেষণারও ফসল। ১৯১৫ সালের ১ ডিসেম্বর কাবুলে যে প্রথম বিদেশের মাটিতে অস্থায়ী ভারত সরকারের জন্ম হয়েছিল, যার রাষ্ট্রপতি ছিলেন মহেন্দ্র প্রতাপ, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন , মৌলানা বরকতুল্লা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলানা উবাইদুল্লা, তাঁদের ভাবনার, দেশপ্রেমের অপ্রত্যক্ষ প্রভাবও নিশ্চয়ই আছে আমাদের সংবিধানে। ঠিক যেমন প্রভাব রয়েছে ১৯৪৩ সালে নেতাজির তৈরি অস্থায়ী সরকারের প্রভাব। যে সরকারের তিনি নাম দিয়েছিলেন, ‘আরজি হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ (স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার)। প্রভাব রয়েছে অন্যান্য এই ধরনের সব অস্থায়ী সরকারেরও। নেহরু- আম্বেদকরের ভূমিকার কথা তো সবার জানা। লঙ্কাজয়ের পর রামের অভিষেকে যেমন আনা হয়েছিল চতুঃসাগরের জল এবং পঞ্চশত নদীর জল, এও যেন অনেকটা তাই। সারা পৃথিবী থেকে খুঁজে খুঁজে আনা মণি-মুক্ত। এই সংগ্রহকে ধার করা বলে না, স্বীকৃতি বলে।
দিন কয়েক আগে প্রকাশিত অক্সফ্যামের একটি রিপোর্টে দেখা গিয়েছে সারা পৃথিবীতে এবং বেশি করে ভারতে, কিছু ধনকুবেরের হাতে জমে যাচ্ছে প্রায় সব সম্পদ। নীচে চুঁইয়ে পড়ছে অতি সামান্য। প্রজাতন্ত্রের ৭০ বছরে এসে সংবাদমাধ্যমে হেডলাইন হচ্ছে গণতন্ত্রের সূচকে ভারত নীচে নেমে যাচ্ছে। না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা স্লোগান সত্ত্বেও ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টার ন্যাশনালের রিপোর্ট বলছে দুর্নীতি বাড়ছে দেশে। এই সূচকে ভুটানের মতো ছোট্ট দেশও আমাদের ছাড়িয়ে আর্থিক স্বচ্ছতার নিরিখে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। ঠিকই আমরা পাকিস্তানের চেয়ে অনেকটা ভালো অবস্থায় আছি। আমাদের নেতারা হয়তো ভুটানকে না দেখিয়ে বলবেন পাকিস্তানের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করে খুশি থাকতে।
ফেরা যাক সেখানে, শুরু করেছিলাম যে বিষয় দিয়ে। সংবিধান রক্ষায় রাত জাগছে মানুষ। এই রাত জাগা খুব সহজ হবে না। ইতিমধ্যেই আক্রমণ শুরু হয়েছে শাহিনবাগের উপর। জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে পাকিস্তানের সঙ্গে। একসময় কানহাইয়া কুমারদের স্লোগানে বাইরের শব্দ ঢুকিয়ে দেশদ্রোহী প্রমাণের চেষ্টা হয়েছিল। জেএনইউতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সার্ভার ভাঙার অভিযোগ আনা হয়েছিল। পরে আরটিআই করে যানা যায়, কর্তৃপক্ষই সার্ভার বন্ধ রেখেছিল। ফলে এই সত্যাগ্রহীদের সামনে এখন কঠিন সময়।
অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘প্রজা ও তন্ত্র’ বইয়ে লিখেছেন, ‘ঐতিহাসিক সুমিত সরকার দেখিয়েছেন, গান্ধী-আন্দোলনের বেশ কয়েক বছর আগে, বাংলার স্বদেশী আন্দোলনে ব্যবহৃত নানা রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে গান্ধী-বর্ণিত সত্যাগ্রহের পূর্বলক্ষণ সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, সত্যাগ্রহের কৌশল ভারতের বামপন্থী-সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনেও যথেষ্ট ব্যবহৃত হয়েছে। খুব সরল ভাবে বললে, সত্যাগ্রহ মানে অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা, অন্যায় আইন অমান্য করা (যে কাজ নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ১১টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা কম বেশি করেছেন), প্রতিফল হিসেবে কপালে শাস্তি জুটলে সেই শাস্তি মেনে নেওয়া, কিন্তু আবার প্রতিরোধ করা। ঠিক মতো সংগঠিত হলে সত্যাগ্রহ গণ-প্রতিরোধের আকার ধারণ করে। কিন্তু পারতপক্ষে তা হিংসার আশ্রয় নেয় না। কারণ হিংসার লড়াইয়ে সংগঠিত রাষ্ট্রশক্তির পাল্লা অনেক ভারি’।
সত্যাগ্রহীরা তাদের সত্য পায় কোথা থেকে? যখন মনে হয়, বিশ্বাস তৈরি হয় যে রাষ্ট্রের ‘কোনও আইনের’ চেয়েও বড় কোনও সত্য তাঁদের আছে, আইন যার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলছে না, তখন সত্যাগ্রহীদের ধর্ম হয়ে ওঠে কর্তব্যবোধ। তাদের ধর্ম হয়ে ওঠে মানবতা। আমাদের সামনে এখন এই দুই ধর্মের লড়াই। ধর্মান্ধতার রাজনীতি বনাম কর্তব্যবোধের ধর্ম। ধর্মান্ধতার রাজনীতি বনাম মানবধর্মের রাজনীতি।
একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় সত্যের সঙ্গে মানবধর্মের মতো একটা চিরসত্যের সঙ্ঘাত বেঁধেছে। শেষ বিচারে চিরসত্য যদি পরাজিতই হয়, তাহলে ‘চিরসত্য’ শব্দটার জন্মই হত না।
(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)
এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে ক্লিক করে