শঙ্কর রায়
মার্ক্স-এর ‘দাস কাপিতাল’ ( ‘পুঁজি: রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনা’- সংক্ষেপে ‘পুঁজি’ )-এর প্রথম খণ্ড প্রকাশনার ১৫০তম বার্ষিকী উদযাপনে ভারতের সরকারি মার্ক্সবাদী (পড়ুন লেনিনবাদী) পার্টিগুলির নিরুৎসাহ অন্তত এই লেখককে বিস্মিত করেনি। গত বছর ১৪ সেপ্টেম্বর তার ১৫০তম বর্ষপূর্তি। সেদিন ‘সিপি আই(এম)-এর প্রভাতী দৈনিক ‘গণশক্তি’, সিপি আই-এর ‘কালান্তর’ ও সিপি আই (এম-এল) লিবারেশনের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘আজকের দেশব্রতী’ নামকাওয়াস্তে ফিচারও প্রকাশ করেনি। সেদিন বা সেই সপ্তাহে কোন সভা-সেমিনার করে নি। অথচ বলশেভিক বিপ্লবের (অর্থাৎ লেনিনিয় সমাজতন্ত্র তথা রাষ্ট্রীয় পুঁজিতন্ত্রের) শতবর্ষ পালনে এই দলগুলি অত্যুৎসাহী। কিন্তু পশ্চিমি দুনিয়ায় ‘পুঁজি’র তিন খণ্ড বিক্রি হার অভূতপূর্ব হারে বাড়ছে, যদিও ক্রেতাদের বড় অংশ বামপন্থী ন’ন। বরং এঁদের বেশির ভাগ বছর দশেক আগেও আধুনিক আর্থ-অর্থ শাস্ত্রের (মানিটারি ইকনমিক্স) ঋত্বিক মিল্টন ফ্রিডম্যান-এর তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অথবা তাঁর গড়ে তোলা শিকাগো স্কুল অফ মানিটারি ইকনমিক্সের পণ্ডিতদের নিদানে ছিল অচঞ্চল নির্ভরতা। সেই অগাধ আস্থায় চিড় ধরাল ২০০৮-এ মার্কিন মুলুকে ‘সাব-প্রাইম মর্টগেজ ক্রাইসিস’, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুঁজিবাদী দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি কাঁপিয়ে তোলে। সেই সংকটের সূত্র ও হেতু অন্বেষণেই তাঁদের মার্ক্সের শরণাপন্ন হওয়া। তার বছর খানেক আগে ফ্রন্টিয়ার সাপ্তাহিকে বিশ্বের সর্বাগ্রগণ্য কতিপয় মার্ক্স-চর্চাকারদের অন্যতম অধ্যাপক পরেশ চট্টোপাধ্যায় গভীর প্রত্যয়ে লিখেছিলেন মার্ক্স শুধু উনবিংশ শতকের অর্থশাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন, এই ধারণা অমূলক। তাঁর অর্থনৈতিক ভাবনা বিশ্লেষণ একবিংশ শতকেও প্রযোজ্য।
গত বছরের ১৫ জুন ‘পুঁজি’-র প্রথম খণ্ডের (জর্মন) প্রথম কপি ২১৮,০০০ ডলারে নিলাম হয়েছিল। যেদিন বইটি জর্মনির হ্যামবুর্গ প্রকাশিত হয়, সেদিনের ছেঁড়া-খোঁড়া, ঝুরঝুরে স্বাক্ষরিত সেই কপিটি মার্ক্স এক প্রিয় কমরেড ইয়োইহান গিয়র্গ ইক্কেরিয়াসকে উপহার দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সঙ্ঘের (যা প্রথম আন্তর্জাতিক নামেও পরিচিত) তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক। পেশায় দর্জি ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক। তার ১৩ মাস আগে বইটি নিলামে বিক্রি হয়েছিল ১২০, ০০০ ডলারে- ১৩ মাসে প্রায় ৮৬ শতাংশ দর বৃদ্ধি। কিন্তু লেনিনের বইগুলি ( ‘সাম্রাজ্যবাদ- পুঁজিতন্ত্রের সর্বোচ্চ স্তর, ‘বস্তুবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদী সমালোচনা’, ‘কী করতে হবে’ ইত্যাদি)-র চাহিদা ক্রমহ্রাসমান। তবু সরকারি মার্ক্সবাদী দলগুলি মার্ক্সের চেয়ে বেশি আঁকড়ে ধরেছে লেনিনকে।
আরও পড়ুন, ভেঙে পড়ল এক অভ্যস্ত সখ্যের সেতু
যে কথা বার বার লেখার জন্য এই প্রতিবেদকের মতপার্থক্য পুরনো বন্ধু-স্বজনের মধ্যে বাড়ছে (আবার অনেকে আমার ভাবনা মুক্তচিত্তে বিচারও করছে), তার সারাংশ এই যে বিংশ শতকে যে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি ছিল, সেগুলির সাথে মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রের বিপুল ব্যবধান। লেনিন বলেছিলেন আগে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, তার পরে তো সাম্যবাদী বিপ্লব, সমাজতন্ত্র সাম্যবাদের নীচের স্তর বাপ্রাক-স্তর । মার্ক্স এমন কথা কোথাও কখনো বলেন নি। মার্ক্স সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদকে সমার্থক বলেছিলেন। মার্ক্স এর অন্য প্রতিশব্দও ব্যবহার করতেন- শ্রমিকদের সাধারণতন্ত্র, মুক্ত ব্যক্তিদের পুনর্মিলনের সমাজ, ইত্যাদি। গোথা কর্মসূচির সমালোচনায় মার্ক্স সাম্যবাদেরই দুই স্তরের কথা বলেছিলেন। প্রথম স্তরে প্রলেতারিয় একনায়কতন্ত্র, দ্বিতীয় স্তরে ‘পূর্ণ সাম্যবাদ’। প্রথম স্তরে বা প্রলেতারিয় একনায়কতন্ত্র-স্তরে মার্ক্স সমাজ-রূপান্তরের প্রাথমিক কর্মসূচির কথা বলেছেন, যেমন জনগণের প্রয়োজন মেটানোর কাজে অত্যাবশ্যক উৎপাদিকা শক্তির পুনর্গঠন ও বুর্জোয়া সংস্কৃতির মোকাবিলার কথা বলেছিলেন। প্রলেতারিয় একনায়কতন্ত্রের উদ্দেশ্য পুঁজিবাদীদের পুনরাবির্ভাবের ভিত্তি প্রতিবিপ্লবী শক্তিকে চিরতরে অশক্ত, অকেজো করে দেওয়া। আর দ্বিতীয় স্তরে মানসিক ও শারীরিক শ্রমের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক অবসান, যাতে শ্রমশক্তি ব্যক্তির সামগ্রিক ও সার্বিক বিকাশের পথ প্রশস্ত করতে পারে। এর ভিত্তিতেই সমবায় সম্পদের উন্মুক্ত বিকাশ সুনিশ্চিত হওয়ার কথা বলেছিলেন। (“In the first phase of communist society as it is when it has just emerged after prolonged birth pangs from capitalist society. Right can never be higher than the economic structure of society and its cultural development conditioned thereby.
In a higher phase of communist society, after the enslaving subordination of the individual to the division of labor, and therewith also the antithesis between mental and physical labor, has vanished; after labor has become not only a means of life but life's prime want; after the productive forces have also increased with the all-around development of the individual, and all the springs of co-operative wealth flow more abundantly -- only then can the narrow horizon of bourgeois right be crossed in its entirety and society inscribe on its banners: From each according to his ability, to each according to his needs)।
লেনিন গোথা কর্মসূচির সমালোচনা’বিকৃত করেছিলেন । মার্ক্স সূত্রায়িত করেছিলেন ‘বস্তুতান্ত্রিক দ্বন্দ্ববাদ’ ও ‘ইতিহাসের বস্তুতান্ত্রিক ব্যাখ্যা। জিয়র্জি প্লেখানভ (লেনিনের একদা শিক্ষক)১৮৯১ সালে Neue Zeit পত্রিকায় একেবারে উলটে দিলেন – ‘দ্বান্দ্বিক বস্ততন্ত্র’। একই ভাবে বিকৃত সূত্রায়ন ‘ঐতিহাসিক বস্ততন্ত্র’। মার্ক্স যে কোন রাষ্ট্রের বিরোধী ছিলেন। বন্ধু ডঃ লুফ্বিগ কুগেলম্যানকে ১৮৭১ সালের ১২ এপ্রিল একটি চিঠিতে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ‘অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার’এর শেষ অধ্যায়ের কথা, যে তিনি রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই চূর্ণ করার পক্ষে । অন্য আরেকটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নয়। অথচ লেনিন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, কমিউন রাষ্ট্র ইত্যাদি তত্ত্ব হাজির করেছিলেন। লেনিন বলেছিলেন মার্ক্সবাদ সর্ব শক্তিমান, কারণ তা সত্য অর্থাৎ মার্ক্সবাদের পরে আর কিছু নেই। মার্ক্স ও এঙ্গেলস উভয়েই এরকম আপ্ত বাক্য ব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক করেছেন।
আরও পড়ুন, কবিতা থেকে মিছিলে
মার্ক্সের আশঙ্কা হয়ত ছিল, তাঁর তত্ত্ব (থিওরি, ইডিওলজি নয়-মার্ক্স ইডিওলজির ঘোর বিরোধী ছিলেন, ‘’জর্মন মতাদর্শ'’ গ্রন্থে ইডিওলজিকে ডার্ক রুমের নেগেটিভের সাথে তুলনা করেছিলেন) বিকৃতভাবে ব্যাখ্যাত হবে। প্রথম আন্তর্জাতিকের সময়ে (মে, ১৮৮০) মার্ক্স তাঁর জামাতা পল লাফার্গকে ( লরার স্বামী) ও জুল গিদেকে সতর্ক করেন “এটুকু নিশ্চিত জানি, আমি মার্ক্সবাদী নই”। ( “ce qu'il y a de certain c'est que moi, je ne suis pas Marxiste” – ঠিক এই কথাগুলি এই ভাষাতেই)। প্রথম আন্তর্জাতিকে ফরাসি সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে বাকুনিনপন্থীদের বিতর্ক চলছিল ( বাকুনিন ১৮৭০ দশকেই প্রথম আন্তর্জাতিক থেকে বহিষ্কৃত হন, কোন্দলবাজির জন্য)। এঁরা দুজন ফরাসি সমাজতন্ত্রীদের নেতৃত্বে ছিলেন । তাঁদের মার্ক্সবাদী হিসাবে তকমা দিলেও তাঁরা এ নিয়ে মুখ খোলেননি। মার্ক্স ক্ষুব্ধ হয়েই একথা বলেছিলেন।
মার্ক্সবাদের যে নানা ধারা গড়ে উঠছে ও নানা তর্ক –বিতর্ক উৎসারিত হচ্ছে, তা সশ্রদ্ধায় ও পরমতসহিষ্ণুতার সঙ্গে চর্চিত হোক। সাবেকি মার্ক্সবাদের প্রবাহগুলির বাইরে একাধিক স্বতন্ত্র ধারা বিকশিত হচ্ছে ,সেগুলি নিয়ে চর্চা ও অধ্যয়নের এটাই সময় আর তার জন্যে সবাইকে মার্ক্সবাদী বা মার্ক্স-অনুগামী হতেই হবে তা নয়। যদিও লেনিনবাদীদের এই সাহস নেই। তারা একদিক থেকে মার্ক্স-ভীত।
আরও পড়ুন, নন্দীগ্রামে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিলেন লেখক-শিল্পীরাও