Advertisment

মমতার জন্য সরষে পাবদা আনাতেন সোমেন দা

নিজে চিত্তরঞ্জন পার্কে যেতেন মাছ কিনতে। নিজে বাজার করতে কী ভালোবাসতেন! বলতেন, কলকাতায় কোলে মার্কেটে তো যেতে পারি না, গেলেই লোকে ধরবে। মন দিয়ে বাজারটা করতেই পারি না। তাই দিল্লি এসে একটা ভয়ঙ্কর বাজার হতো।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

সোমেন মিত্রের আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে তখন মমতা যেতেন।

হাওড়া শিবপুর ট্রামডিপো থেকে ১৬ নম্বর সরকারি বাসে চেপে সাত সকালে চলে আসতাম আমহার্স্ট স্ট্রিট। ১৯৮৫-৮৬ সালের কথা। একটা পুরোনো ভাঙাচোরা দোতলা বিশাল বাড়ি। ঊনবিংশ শতাব্দীর অট্টালিকা। তখন রাতের বেলা মনে হত ভূতের বাড়ি। নিবু নিবু হলুদ বাল্ব জ্বলতো অসংখ্য ছোট ছোট ঘরে। এ বাড়ির দোতলায় ঘেরা বারান্দা। ওপর থেকে দেখা যেত শ্যাওলা ধরা উঠোন। দোতালায় একটা ছোট ঘরে সোমেন দা থাকতেন।

Advertisment

সোমেন মিত্র। সকলের ছোড়দা। তখন অবিবাহিত ছোড়দা, সে ঘরে দেয়ালের ধারে একটা ছোট খাটে শুতো। পাশে আর একটা খাটে শুতো রঘু দা। ভালো নাম- দেব কুমার দত্ত। ছোটবেলার বন্ধু। ব্যাঙ্কে কাজ করতেন। সোমেন মিত্রর রুমমেট।

আমি খুব সক্কাল বেলা পৌঁছে যেতাম। কারণ, নিচে বড় বৈঠক খানায় সক্কাল বেলা নানা জেলা থেকে নানা ধরনের আবেদনকারী আর সাক্ষাৎ প্রার্থীর ভিড়। চান টান সেরে সোমেন দা সেখানে নেমে এলেই ব্যাস, ১২ টা পর্যন্ত ওঁর সঙ্গে একান্তে কথা বলাই অসম্ভব। অনেক সময় এমন হত, ওপরে গিয়ে দেখতাম, সোমেন দা আদুর গায়ে লুঙ্গি পরে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন। রঘু দা উঠে পড়েছে কারণ তাকে ব্যাঙ্কে যেতে হবে। ঘরে একটা রঙিন টিভি সেট একটা কাঠের বাক্সের মধ্যে, তখন আমাদের সবার বাড়িতে যে ভাবে টিভি রাখা হত। আমার দায়িত্ব পড়ত সোমেন দা'কে ঘুম থেকে ওঠানো। চা দিয়ে গেছে কিন্তু সেটা ঠান্ডা কাল হয়ে গেছে। তার পর নিদ্রা ভঙ্গ। গাত্রত্থান।

তখন রাজীব গান্ধী মায়ের আকস্মিক মৃত্যুর জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী। প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। কিন্তু রাজীব প্রণববাবুকে কোণঠাসা করার জন্য প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন। আর সোমেন মিত্র প্রিয় বিরোধী কংগ্রেস গোষ্ঠীর নেতা। আমরা সাংবাদিকতায় আসার আগে শুনেছি, সিদ্ধার্থ রায় যখন মুখ্যমন্ত্রী, সোমেন মিত্রকে সেই রাজনৈতিক মর্যাদা দেওয়া হত না। ফাটাকেষ্ট আর কালীপুজোর সঙ্গে সোমেন দা'র নাম উচ্চারিত হত। কিন্তু ধীরে ধীরে যুব কংগ্রেস সভাপতি হয়ে জেলায় জেলায় নিজস্ব সংগঠন তৈরি করে সোমেন মিত্র স্বমহিমায় নিজের রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত করলেন। আমরা দেখলাম কী ভাবে রাজ্য রাজনীতিতে তিনি আরো এগোলেন। রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি হলেন।

চুরাশি সালে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল। আমরা বলতাম, প্রিয় দা'র হ্যাট্রিক। প্রথম হাওড়ার লোকসভা সাংসদ, তারপর কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী, তারপর খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। সোমেন মিত্র বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস নেতা। ৮৪ সালে মমতা বন্দোপাধ্যায় সাংসদ। মমতার সঙ্গেও সোমেন দা'র ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠে এ সময়। অনেক সময় মমতার সঙ্গে আমহার্স্ট স্ট্রিটের সেই ভাঙা চোরা বাড়িতে গেছি। দিদির সম্মানে দুপুরে কলেজস্ট্রিটের মিনি রেস্টুরেন্ট থেকে নানা রকমের মাছ আনলো সোমেনদা। পাশেই একটা ছোটো খাবার ঘর ছিল। একটা ফ্রিজ ছিল সে ঘরে। সরষে পাবদা আনতেন সোমেন দা! মমতা দি' অবশ্য তখনো আজকের মতোই কম খেত।

সোমেন দা'র সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল সতীর্থ সাংবাদিক এখন তৃণমূল বিধায়ক প্রবীর ঘোষাল। প্রবীর সোমেন দা'কে ডাকতো 'বড়বাবু' বলে | আবার প্রবীরকে সোমেন দা'র সঙ্গে আলাপ করায় প্রবীণ সাংবাদিক মিহির গাঙ্গুলি। মিহির দা'র সঙ্গে থাকতো গাঢ় গেরুয়া পাঞ্জাবি পরিহিত সাংবাদিক রণেন মুখার্জি। মিহির দা'ও বলত 'বড়বাবু' | ওদের দেখে আমিও ডাকতে শুরু করলাম 'বড়বাবু' বলে | শেষ যেদিন দেখা হল, কথা হল সেটা দিল্লির এইমস হাসপাতালের ঘর। তখন সোমেন দা' শয্যাশায়ী। সেদিনও ডাকলাম- "বড়বাবু...!" বাদল দা', মানে বাদল ভট্টাচার্য ছিল। বাদল দা' ছিল সোমেন দা'র দীর্ঘদিনের বন্ধু। আমি গেছিলাম বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের সঙ্গে। বাদল দা' বলল, "দেখো দেখো কারা এসেছে...সেই পুরোনো আমহার্স্ট স্ট্রিট টিম"!

আব্দুল মান্নান তখন সোমেন দা'র খুব ঘনিষ্ঠ। হাজি মহসিন স্কোয়ারে কংগ্রেস দফতরে প্রিয় দা'র ঘর দোতলায়, আর এক তলায় মান্নান দা'র সেবাদল চেয়ারম্যানের অফিস। আমি আর প্রবীর মাঝে মাঝে রাতে কিড স্ট্রিটে এমএলএ হস্টেলে ছ'তলায় মান্নান দার ঘরে থেকে যেতাম। মান্নান দা' অবিবাহিত, অঙ্কের মাস্টার। ঘরে বসে ছাত্রদের খাতা দেখত। সকাল বেলা আমরা তিনজন যেতাম সোমেন দা'র বাড়ি। তখনই খুব কাছ থেকে দেখলাম, জেলায় জেলায় সোমেন দা' কীভাবে নিজস্ব টিম তৈরি করে ফেললেন! হাওড়াতে উৎপল ভৌমিক থেকে শুরু করে শংকর মালাকার থেকে নদীয়ার শংকর সিংহ, মান্নান হোসেন থেকে রাজীব দেব, কলকাতার তাপস রায়, আরো কত কত চরিত্র। একটা কথা সবাই স্বীকার করেন, সোমেন দা'র মতো সংগঠক কমই হয়।

সোমেন দা’র হাত ধরেই কংগ্রেস রাজনীতিতে পদার্পণ করেছিলাম, একটা অধ্যায় সমাপ্ত হল: অধীর চৌধুরী

দিল্লিতে সোমেন দা' থাকতেন গুলমোহর পার্কে টুটু বোসের ডুপ্লে বাড়িতে। নিজে চিত্তরঞ্জন পার্কে যেতেন মাছ কিনতে। নিজে বাজার করতে কী ভালোবাসতেন! বলতেন, কলকাতায় কোলে মার্কেটে তো যেতে পারি না, গেলেই লোকে ধরবে। মন দিয়ে বাজারটা করতেই পারি না। তাই দিল্লি এসে একটা ভয়ঙ্কর বাজার হতো। একা তো খাওয়া যাবে না, তাই ডাকো যারা যারা দিল্লিতে আছে। বাংলার রিপোর্টারদেরও ডাকো...

প্রদীপ ভট্টাচার্য খেয়ে ওখানেই হাঁটা শুরু করে দিতেন হজমের জন্য। আনন্দবাজারে তখন ছিল ভাতৃপ্রতিম সুদীপ্ত সেনগুপ্ত। ওর একটা মন্তব্য এখনো মনে পড়ে। বলেছিল, এতো মাছ খাওয়া হল না যে মনে হচ্ছে একটা প্রজাতি যুদ্ধ হল। মানুষ জাতির সঙ্গে মৎস্য প্রজাতির যুদ্ধ।

সোমেন দা বিয়ের পর জীবনযাত্রা অনেক বদলে ফেলেন। রাজনৈতিক নেতার পাশাপাশি ভাল স্বামী, ভাল বাবা হয়ে ওঠেন। আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িটা ছিল কার্তিক বোসের পাথলোজিকাল ল্যাবরেটরি। কার্তিকবাবু মারা যাওয়ার পর তার ছেলেকেও নিয়মিত বাড়ি ভাড়া দিত সোমেন দা। আর ব্যাচেলর মানুষটা বাড়িতে থাকতে দিয়েছিল বহু স্থানীয় দোকানী, মজুর, আর পুরোনো ভাড়াটেকে। কার্তিক বোস ভাবত প্রোমোটারদের হাতে চলে যাওয়ার চেয়ে এ বাড়ি সোমেন দা'র কাছে থাকাই ভাল।

সোমেন দা নিজেদের ভাইদেরও বাবার মতো দেখত। যশোর থেকে উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসা মানুষটির শৈশব কেটেছে অনেক দুঃখ অনেক যন্ত্রনায়। শিখা মিত্র সোমেন দা'র জীবনে এক নতুন মাত্রা দেয়। দিল্লিতে মতিবাগের বাংলোতে সাংসদ সোমেন মিত্রকে দেখেছি মন দিয়ে টিভিতে সিনেমা দেখছে, আর বৌদি রান্না থেকে বাড়ির বাগানে নতুন নতুন ফুল থেকে সবজি লাগানো, সব একা হাতে সামলাচ্ছে।

রাজনীতিতে সবসময় কভি খুশি কভি গম। কখনও উত্থান, কখনও পতন। সোমেন দা' সাংগঠনিক নির্বাচনে মমতাকে পরাস্ত করে রাজ্য সভাপতি হয়েছেন। সীতারাম কেশরীর সমর্থন নিয়ে কংগ্রেস অধিবেশন করেছেন নেতাজি ইনডোরে। আর মমতা বাইরে সভা ডেকে প্রমাণ করে দিলেন, আসল কংগ্রেস তিনি। সেই মমতার সাংসদ হয়েই দিল্লি এলেন সোমেন দা', আবার দল ছেড়ে কংগ্রেসে ফিরে দলের রাজ্য সভাপতি হলেন!

রাজনীতির এই রামধনুর নানা রঙ থাকবে, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে হুট করে চলে গেল সেই মজাদার হৃদয়বান মানুষটি। খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা, ডিভিডি এনে হিন্দি ছবি দেখা, খেলার মাঠ, কালীপুজো আর ঘুম! সাংবাদিক মিহির গাঙ্গুলি একবার বলেছিল, বড়বাবুর ঘুম? আসলে উনি জানেন, কখন ঘুমোতে হয়, আর কখন জেগে যেতে হয়।

এটাই ছিল সোমেন মিত্রর রাজনীতির স্টাইল!

পড়ুন, জয়ন্ত ঘোষালের সবক’টি কলাম এখানে

Mamata Banerjee Delhi Theke Bolchi
Advertisment