Advertisment

সাইকেলের রডে বনলতা সেন

আমি জানি সাইকেলের রড ও ক্যারিয়ারে বনলতা সেন বাস করে। আমার বহুদিনের ইচ্ছে ছিল, আমার সাইকেলে বসে থাকবে তেমন কোনও মেয়ে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলঙ্করণ- অভিজিৎ বিশ্বাস

সাইকেলের বিক্রি বেড়েছে। লোকজন ট্রেন-বাসের জন্য বসে না-থেকে সাইকেলে পাড়ি দিচ্ছেন দীর্ঘ পথ। ব্যারাকপুর, বারাসত, বৈদ্যবাটী থেকে বহু লোক সাইকেলে আপিসে আসছেন। সাইকেলে সংক্রমণের ভয় নেই। বরং ফুরফুরে হাওয়া খেলে। শরীর-স্বাস্থ্যও বেশ মজবুত থাকে। সাইকেল ফিরে আসছে দেখে আমি যারপরনাই খুশি।

Advertisment

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন।

কারণ, আমি সাইকেলের পোকা। সাইকেল শুধু দু'চাকার যান নয়। আমি জানি সাইকেলের রড ও ক্যারিয়ারে বনলতা সেন বাস করে। আমার বহুদিনের ইচ্ছে ছিল, আমার সাইকেলে বসে থাকবে তেমন কোনও মেয়ে। আমি প্যাডেলে পা দিয়ে পেরিয়ে যাব সোনাডাঙার মাঠ, বীরু রায়ের বটতলা। সে মাঝে মাঝে আমার দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে হাসবে। সেই হাসি আমার রাতের আলো। আমার কুলুঙ্গির সাঁঝবাতি। কিন্তু সে আর হয়নি। জীবনে কত কী হয়নি। এটাও তেমনই একটা। আধদামড়া কিছু পুরুষ বসে আমার সাইকেলের হাওয়া নষ্ট করেছে। আমি শুধু কয়েক আলোকবর্ষ পথের দিকে কতকাল চেয়ে আছি।

পড়ুন, অনিমেষ বৈশ্যের কলাম- লকডাউন ও মহম্মদ রফির ভাই

আগে গ্রামে বিয়েতে সাইকেল দেওয়ার চল ছিল। খাট-বিছানা-বালিশ-রেডিওর সঙ্গে একটা সবুজ রঙের সাইকেলও পাঠিয়ে দিতেন মেয়ের বাবা। সাইকেল দেয়নি বলে বিয়ের পিঁড়ি থেকে ছেলে উঠিয়ে নেওয়ার হুমকিও দিতেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাবা। 'খোকা উঠে আয়' গোছের হুমকি ছিল কিছু বাবার প্রিয় শব্দগুচ্ছ। সাইকেলের হ্যান্ডেলে ডায়নামো লাগানো থাকলে তার কদর ছিল বেশি। আর ফুল চেনকভার থাকলে তার খাতিরই আলাদা। জামাই বাবাজি রাতবিরেতে এখানেওখানে যায়। পথে সাপখোপ, শিয়াল, শুয়োর কত কী আছে! আলো ছাড়া চলে? একটা গোল চাকতি পিছনের চাকার সঙ্গে ঠেসে থাকত। সাইকেল চললে ঘর্ষণে জ্বলে উঠত আলো। ডায়নামোর মিহি আলোর কুচি আজও লেগে আছে গ্রামের পথেঘাটে। সাইকেল আসলে সময়ের দিকচিহ্ন, সাইকেল আসলে নবীন কিশোরের ভুবনডাঙার মাঠ। কিন্তু এখন আর কেউ সাইকেল দেয় না। সাইকেল চালালে ঠিক প্রেস্টিজও থাকে না। সাইকেল এখন ত্রাণসামগ্রী, যা সরকার ফোকটে দেয়। যে জিনিস ফোকটে মেলে, বড়লোকের তাতে উৎসাহ নেই।

পড়ুন, অনিমেষ বৈশ্যের কলাম- উত্তমকুমার অথবা বটুরামদার কাঁচি

আগে গ্রামের ডাক্তারবাবুরা সাইকেলে রোগী দেখতে যেতেন। রাতবিরেতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তারবাবুকে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে নিয়ে আসতেন গ্রামের কোনও মদ্দ-জোয়ান। ডাক্তারবাবু সাইকেল থেকে নামলে যতটা কাছের লোক মনে হয়, গাড়ি থেকে নামলে তা হয় না। সপ্তপদী ছবিতে উত্তমকুমার ছিলেন ডাক্তার। সাইকেলের পিছনে ওষুধের বাক্স নিয়ে 'বাবাসাহেব' গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। ঋষির মতো দেখতে লাগত তাঁকে। কিন্তু এখন ডাক্তারবাবু সাইকেলে চেপে রোগী দেখতে যাচ্ছেন, এ দৃশ্য দেখা যায় না। সাইকেলের সঙ্গে কালের চাকাও ঘুরেছে।

বহুদিন আগে শীর্ষেন্দুর একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটির নাম সাইকেল। গল্পের চরিত্র ঘটু, বউ চাইত না। সে চাইত সাইকেল। ঘটু ছিল কলমিস্ত্রি। গ্রামের এক মাতব্বর গোছের লোকের মেয়ের বিয়ে। বিয়ের আগে সেই বাড়িতে চাপাকল বসাতে হবে। ঘটু সেখানে কাজ করছিল রাতদিন এক করে। বিয়ের ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। সাঁঝেরবেলায় বিয়ে। মুড়ি ও গরম বোঁদে খাওয়ার পর হঠাৎ শুরু হল শোরগোল। মেয়ে পালিয়েছে। কী ভাবে পালাল? মেয়ে কুয়োপাড়ে মুখ ধুতে গিয়েছিল। সেখানে এক যুবক সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে মেয়েকে রডে তুলে হাওয়া। কলমিস্ত্রি ঘটু ওই খবর শুনে চেগে উঠল। সে ভাবল, একটা সাইকেল থাকলে কত কী করা যায়!

পড়ুন, অনিমেষ বৈশ্যের কলাম- করোনা, ঘূর্ণিঝড় ও নিমাইয়ের বৌ

সেটা তখন আশির দশকের মাঝামাঝি। সাইকেল আমাদের রক্তে ফুটেছে। পাড়ার মোড়ের মাথায় সাইকেলের দোকান। সেখানেই দিনরাত আড্ডা। হঠাৎ কে এসে বলল, 'সাইকেলে দিঘা যাবি?' সাইকেলে দিঘা? সে তো প্রায় দুশো কিলোমিটার রাস্তা। হাড়মাস ভাজা ভাজা হয়ে যাবে না তো? কেনা ওঁরাও ছিল সাইকেল মিস্ত্রি। তার দোকানেই আমাদের আড্ডা। সবার আগে সে বলল, 'হ্যাঁ যাব, যাব। সঙ্গে যন্ত্রপাতি নিয়ে যাব। পথে সাইকেল লিক হলে আমি আছি তো?' কেনার কথায় সবাই লাফিয়ে উঠল। সবাই বলল, 'হ্যাঁ যাব।' কে যেন বলল, 'থানা থেকে পারমিশন নিতে হবে। আমরা যে চোর-ডাকাত নই সেটা দারোগা লিখে দেবেন।' তা পারমিশন জোগাড় হল। একদিন সকালে তেরো জন মিলে চললাম দিঘায়। চে গেভারার মোটর সাইকেল ডায়েরি তখন সবে পড়েছি। এবং ওই বয়সে যা হয়, বইটার তীব্র বদহজম হয়েছে। ভাবলাম, চে-র মতোই চলতে চলতে কত কী দেখব, কত বঞ্চিত এবং নিপীড়িতের সঙ্গে মোলাকাত হবে। আমরা অতঃপর দেশের হাল হকিকত সব বুঝে যাব। তা শেষ অব্দি হল কী? বালি ব্রিজ পেরিয়ে মুম্বই রোডে উঠতেই ভোরের হিমেল বাতাস গায়ে লাগল। মন বেশ ফুরফুরে। কেউ হেঁড়ে গলায় গান ধরল। দু'পাশে নয়ানজুলি। শালুক ফুটে আছে। সাইকেলে আমি একা। সামনের রডে বা পিছনে কোনও বনলতা সেন নেই। তা কবেই বা ছিল। বেলার দিকে কার যেন জল তেষ্টা পেল। জায়গাটার নাম কুলগাছিয়া। জেলা হাওড়া। কেউ একজন নেমে রাস্তার ধারে একটা বাড়িতে জল খেতে গেল। কিন্তু সে আর আসে না। তার পর আর একজন গেল। সে-ও আর আসে না। তার পর আরও একজন। গিয়ে দেখা গেল একটি সুশ্রী মেয়ে বালতি থেকে সবাইকে জল দিচ্ছে। এবং কেউই আর ফেরার নাম করছে না। চে-র ডায়েরিতে এসব কি ছিল? মনে পড়ছে না। সন্ধে নাগাদ পৌঁছলাম নন্দকুমারে। পা টনটন করছে। শরীর আর চলছে না। থানায় গিয়ে বললাম, 'আমাদের একটা থাকার জায়গা দিন। দারোগাবাবু লোক ভালো। তিনি একটি ইস্কুলে আমাদের থাকার জায়গা করে দিলেন। তেরো জন নবীন যুবা স্কুলের বেঞ্চে নিদ্রা গেলাম। পরদিন সকালে উঠে আবার যাত্রা শুরু। দিঘা পৌঁছতে দুপুর পেরিয়ে গেল। অনন্ত জলরাশি দেখে যখন আমরা মুগ্ধ, তখন ঝাউবনে একটা শোরগোল শোনা গেল। তাকিয়ে দেখি, কিছু ছাত্রছাত্রী দিঘায় বেড়াতে এসেছে। সঙ্গে কয়েকজন মাস্টারমশাই। একজন আমাদের বললেন, 'আপনারা কোথা থেকে এসেছেন?' আমার বন্ধু বিশুর পা ফুলে ছিল। সে বলল, 'আমরা সাইকেলে ভারত ভ্রমণে বেরিয়েছি। পথে একটু চা খেতে নামলাম।' আমরা তো অবাক। বিশু বলে কী? খানিক বাদে দেখি ওই ছেলেমেয়েরা হাতে খাতা নিয়ে হাজির। অটোগ্রাফ চাই। সমুদ্রের দিক থেকে হু হু হাওয়া আসছে। ঝাউবন দুলছে। আর ভারতপথিক বিশু অকাতরে অটোগ্রাফ বিলোচ্ছে।

সাইকেলে চড়লে কত কী না হয়!

এক ক্লিকেই অনিমেশ বৈশ্যের সব কলাম এখানে

corona virus Tin Chokka Putt
Advertisment