এই কলামটি স্বাস্থ্য বিষয়ক হলেও জীববিদ্যা বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের কচ়্কচি সাধারণত এড়িয়ে চলি। এবার একটু সেই পথে হাঁটতে হবে প্রতিশ্রুতি অনুসারে। আসলে COVID-19 এর বৈজ্ঞানিক দিকগুলো নিয়ে বিভ্রান্তি আছে এবং তার ফলে মানুষের কাছে কিছু ভুল বার্তাও পৌঁছচ্ছে, যা ক্ষতিকর হতে পারে। যতটা সম্ভব সহজ করে বিজ্ঞানের কিছু কথা বলার চেষ্টা করব।
Corona virus disease 2019 (COVID-19) একটি ভাইরাস-ঘটিত রোগ। ভাইরাসটিকে SARS-CoV-2 নাম দেওয়া হয়েছে। ইতোপূর্বে Severe acute respiratory syndrome (SARS) নামক যে রোগ হয়েছিল একধরণের করোনাভাইরাসের সংক্রমণে, বর্তমান ভাইরাসটি তার সমগোত্রীয়, কিন্তু কিছু জিনগত তফাৎ আছে, তাই "SARS corona virus"- এর সঙ্গে "2" জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
করোনা সংক্রমিতদের হাসপাতাল থেকে ছাড়া হবে কখন?
ভাইরাস জিনিসটা কী? ভাইরাস হল জীব ও জড়ের মাঝামাঝি একধরণের সংক্রামক পদার্থ। এরা আবশ্যিক অন্তঃকোষীয় (intracellular) পরজীবী। একমাত্র সংক্রামিত জীব-কোষের মধ্যেই এদের জীবনের লক্ষণ পরিস্ফুট হয়। কোষের বাইরে এরা জড়বৎ। কেন এমন হয়, তা বুঝতে গেলে জানতে হবে ভাইরাসের কী আছে আর কী নেই।
দ্বান্দ্বিক লকডাউন
ভাইরাসের আবশ্যিক উপাদান হল নিউক্লিয়াসহীন একটি জেনেটিক পদার্থ (যা DNA বা RNA হতে পারে) এবং তাকে ঘিরে প্রোটিনযুক্ত পুঁতির সমন্বয়ে গঠিত 'capsid' নামক একটি খোলস। DNA না RNA আছে, তার ভিত্তিতে DNA-virus বা RNA-virus বলা হয়। করোনা হল একধরণের আরএনএ-ভাইরাস। ভাইরাসের আরএনএ কেমন, তার নানা রকমফের আছে। সিঙ্গল স্ট্র্যাণ্ড, ডাবল স্ট্র্যাণ্ড, সেন্স (পজিটিভ), অ্যাণ্টিসেন্স (নেগেটিভ), এর টুকরোর সংখ্যা ইত্যাদি। তেমনই ক্যাপসিডেরও আছে নানা গঠনগত বৈশিষ্ট্য। এসব বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন পরিবারভুক্ত ভাইরাসকে পরস্পরের থেকে আলাদা করে৷ আমরা এর খুঁটিনাটিতে ঢুকব না। এটুকু জানলেই চলবে যে প্রোটিন, শর্করা, স্নেহপদার্থ ইত্যাদির বিপাকক্রিয়া বা প্রয়োজনীয় শক্তি আহরণ ও ব্যবহারের জন্য যেসব উৎসেচক প্রয়োজন, তা ভাইরাসের থাকে না, এমনকি তার জিনে সেগুলো তৈরি করার সংকেতও থাকে না। তার ফলে এই সবকিছুর জন্য অন্য জীবকোষের উপরেই ভাইরাসকে নির্ভর করতে হয় এবং কোন ভাইরাস কোন ধরণের জীব-কোষে সবচেয়ে ভালো থাকবে, তাও প্রায় নির্দিষ্ট।
কিছু ভাইরাসের ক্যাপসিড খোলসটির বাইরে একটি স্নেহপদার্থযুক্ত পর্দা (envelope) থাকে। আশ্রয়দাতা কোষের পর্দাকেই একটু নিজের মতো করে সজ্জিত করে নিয়ে (কটা 'গ্লাইকোপ্রোটিন' গুঁজে দিয়ে) ভাইরাস নিজের গায়ে একে পরে নেয় চাদরের মতো। যেহেতু এই চাদর স্নেহপদার্থ দিয়ে তৈরি, তাই কড়া অ্যালকোহল বা ডিটার্জেণ্টের সংস্পর্শে এটা নষ্ট হয়ে যায়। করোনাভাইরাস এরকম চাদর পরে থাকে, তাই বারবার ভালো করে অন্তত কুড়ি সেকেণ্ড সাবান দিয়ে হাত ধুলে ভাইরাস বাবাজি জব্দ।
কোষের মধ্যে বহুসংখ্যক ভাইরাস গজিয়ে ওঠার পর ব্যবহৃত কোষটি ভেঙে তারা বেরিয়ে পড়ে। আশেপাশের অন্যান্য উপযুক্ত কোষে তারা ছড়াতে পারে। কোষের গায়ে যেসব প্রোটিন অণু থাকে, তার কোনোটিকে গ্রাহক হিসেবে ব্যবহার করে ক্যাপসিডের সাহায্যে ভাইরাস সেই কোষের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। তারপর খোলস ছেড়ে তার আরএনএ বা ডিএনএ কোষের ভেতর ঢুকে পড়ে। তারপর শুরু কোষকে বোকা বানিয়ে তারই উৎসেচক ব্যবহার করে, তার মধ্যে সঞ্চিত রসদাদিকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন ভাইরাস-দেহ নির্মাণ এবং পরিশেষে আশ্রয়দাতা (host) কোষকে ধ্বংস করে বেরিয়ে পড়ার চক্র। যেসব করোনাভাইরাস মানুষকে আক্রমণ করে, তাদের মধ্যে SARS-CoV-1 (২০০২ ও ২০০৪ সালের SARS মহামারীগুলোর জন্য দায়ী) এবং SARS-CoV-2 (COVID-19 এর জন্য দায়ী) নামক দুই ভাইরাসই 'Angiotensin converting enzyme-2' ( ACE2) নামক একটি উৎসেচক প্রোটিনকে গ্রাহক হিসেবে ব্যবহার করে কোষে প্রবেশ করার জন্য। যেহেতু ACE inhibitor (যেমন enalapril, lisinopril, ramipril) এবং Angiotensin Receptor Blocker (Losartan, Telmisartan, Olmesartan ইত্যাদি) গোত্রের ওষুধগুলো এই উৎসেচক প্রোটিনের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে, তাই কেউ কেউ এইসব ওষুধের ফলে COVID-19 এর সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে মত প্রকাশ করেন এবং তা শুনে অনেকে হঠাৎ করে নিজেদের প্রেশারের ওষুধ বদলে ফেলেছেন বা বন্ধ করেছেন। ওষুধগুলো খেলে কতটা ক্ষতি হবে তা প্রমাণিত নয়, বদলে ওষুধ হঠাৎ বন্ধ করলে ক্ষতির সম্ভাবনা অনেক বেশি। আমেরিকা এবং ইউরোপের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের বেশ কিছু সংস্থার নিদান, যাঁরা এইসব ওষুধ খাচ্ছেন, তাঁরা খেয়ে যাবেন।
“মৌলিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বের ব্যাপারে চোখ খুলে দিতে পারে এই মহামারী”
এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের শরীরে একটি ভাইরাস কীভাবে পৌঁছবে, তার পদ্ধতি নির্দিষ্ট। যেমন, ডেঙ্গি ভাইরাস আসে কিছু প্রজাতির এডিস মশার মাধ্যমে। SARS-CoV-2 আমাদের শরীরে ঢুকতে পারে নাক-মুখ দিয়ে বা চোখের থেকে নেত্রনালীপথে নাকে আসতে পারে। এই কারণেই নাক-মুখ-চোখ বাঁচাবার চেষ্টা। ভাইরাসটি বাসা বাঁধে আমাদের শ্বাসনালীতে। কোনো সংক্রামিত ব্যক্তির হাঁচি-কাশিতে বা কথা বলার সময় ভাইরাসবাহী বহু জলীয় বিন্দু (droplets) নির্গত হয়। এগুলো ফুট তিনেক অবদি যেতে পারে। এরা সরাসরি আমাদের নাকে-মুখে ঢুকতে পারে অথবা বিভিন্ন জিনিসের উপর পড়তে পারে। দরজার হাতল থেকে পলিথিনের প্যাকেট বা জামা-কাপড়ের উপর ভাইরাসটি বেঁচে থাকতে (অর্থাৎ সংক্রমণ-ক্ষমতা বজায় রাখতে) পারে কয়েক ঘণ্টা থেকে দু-চারদিন অব্দি। এসব কারণেই শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, নাক-মুখ বাহু বা মুখোশে আড়াল করা, চোখ-নাক-মুখে অপ্রয়োজনে হাত না দেওয়া এবং বাইরের জিনিস ছোঁবার পর বা নিজের চোখ-নাক-মুখে হাত দেবার আগে ভালো করে হাত ধোবার পরামর্শ।
SARS-CoV-2 কি বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং দূরের মানুষকে আক্রমণ করতে পারে? একটি গবেষণায় দেখা গেছে পজিটিভ প্রেশার ভেণ্টিলেশন, নেবুলাইজেশন ইত্যাদি চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজের সময় কৃত্রিমভাবে বাতাস-বিস্ফোরণে ভাইরাস-পূর্ণ বিশেষ ধরণের ড্রপলেট তৈরি হতে পারে যা বদ্ধ ঘরের বাতাসে ঘণ্টা পাঁচেক ভেসে থাকতে সক্ষম। ওইভাবে সংক্রামিত হবার ভয় মূলত ওইরকম পরিবেশে কর্মরত চিকিৎসক-নার্সদের। তবে সম্প্রতি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির গবেষকেরা দাবি করেছেছেন যে ছয় ফুট (তিন ফুট নয়) দূরত্ব বজায় রাখার উপদেশটি ১৯৩০ সালের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এবং তা বাতিল করা উচিত। জোরে হাঁচলে বা কাশলে যে ড্রপলেট তৈরি হয়, তা নাকি ২৭ ফিট অব্দি যেতে পারে এবং তা খানিক শুকিয়ে যাবার পর যে সূক্ষ্মতর পদার্থ (droplet nucleus) পড়ে থাকে, তা বাতাসে ভেসে থাকতে পারে কয়েক ঘণ্টা। দুশ্চিন্তার কথা, সন্দেহ নেই। জার্মানির কিছু গবেষক অবশ্য বলছেন যত সহজে এই ইনফেকশন হয় বলে মনে করা হচ্ছে, ততটা সহজে তা নাও হতে পারে। এইসব গবেষণা ঠিক হোক বা না হোক, বাজারে ভালো মাছ কিনতে গিয়ে অন্যের ঘাড়ে হামলে পড়লে সংক্রামিত হতে পারেন এবং আপনার অসাবধানতায় অসুস্থ হতে পারে আপনার গোটা পরিবার।
শরীরে প্রবেশের পর করোনাভাইরাস প্রথমে শ্বাসনালীর উপরের দিকে বাসা বাঁধে। পরে ক্রমশ ফুসফুসে প্রবেশ করে। সংক্রমণ শরীরের কোন অংশে কতটা ছড়াচ্ছে এবং শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা (immunity) কেমন কাজ করছে, তার উপর নির্ভর করে রোগের তীব্রতা। অনেকের দেহে আদৌ কোনো রোগলক্ষণ নাও ফুটতে পারে। এঁদের সুস্থ জীবাণুবাহক (asymptomatic carrier) বলা হয়। অন্যদের ক্ষেত্রে সংক্রমণের পর ভাইরাসের যথেষ্ট সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সময় (incubation period) পেরোলে রোগের লক্ষণ পায়। এই সময়টি এই করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে গড়ে পাঁচদিন, যদিও এক থেকে চোদ্দ দিনের মধ্যে (ক্ষেত্রবিশেষে আরও পরে) রোগলক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। যাঁরা কোনোভাবে সংক্রামিত মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন বা এসে থাকতে পারেন (ভ্রমণ ইত্যাদির কারণে), তাঁদের অনুরোধ করা হচ্ছে এই সময়টুকু অন্যদের থেকে আলাদা থাকতে, যাতে অজান্তে সংক্রমণ না ছড়ায়। অনুরোধ হিসেবে বলা হলেও এটা অবশ্যকর্তব্য। এই অনুরোধ না মানা অপরাধ।
শুরুতে শুকনো কাশি, জ্বর, গায়ে-মাথায় ব্যথা, বমি ভাবি, খিদে কমে যাওয়া, খানিক পেটে ব্যথা আর পাতলা পায়খানা ইত্যাদি হতে পারে। এর সঙ্গে দেখা গেছে ঘ্রাণশক্তি কমে যাওয়া COVID-19 এর এক বিশেষ লক্ষণ। এরপর যখন ভাইরাস ফুসফুসের ক্ষতি (নিউমোনিয়া) শুরু করে, তখন শ্বাসকষ্ট স্পষ্ট হতে থাকে। রোগলক্ষণ শুরু হবার পর দিন দশেকের মাথায় শরীর মরিয়া হয়ে এমন এলোপাথাড়ি গুলি-গোলা ছুঁড়তে শুরু করে যে সেইসব অস্ত্রের ঝড়ে (cytokine storm) আচমকা ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে "Acute respiratory distress syndrome" (ARDS) নামক পরিস্থিতি সৃষ্টির পাশাপাশি অন্যান্য অঙ্গের বিপুল ক্ষতি (multiorgan damage) হয়।
এছাড়াও নানারকম রোগলক্ষণ থাকতে পারে। প্রথমেই কারো শ্বাসকষ্ট হতে পারে আবার অনেক রোগীর রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ পঁচাত্তর শতাংশে নেমে যাবার পরেও শ্বাসকষ্ট থাকে না। হৃদপিণ্ড বা মস্তিষ্কও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে কিছু ক্ষেত্রে। হৃদপিণ্ডের প্রদাহ (myocarditis) মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। বুকের এক্স-রে করলে দুদিকের ফুসফুসেই (কিছু ক্ষেত্রে একদিকে) ভাইরাল নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা যেতে পারে, কিন্তু অক্সিজেনের ঘাটতি সর্বদা এক্স-রে চিত্রের দূরবস্থার সঙ্গে সমানুপাতিক নয়। স্টেথোস্কোপ দিয়ে শ্বাসের আওয়াজ শুনলে সম্পূর্ণ বোকা বনে যেতে পারেন চিকিৎসক। রক্তে লিমফোসাইট কমে নিউট্রোফিল বেশ বেড়ে যাওয়া বা ইন্টারলিউকিন-৬ নামক রাসায়নিকটির বৃদ্ধিতে অশনিসংকেত হিসেবে ধরা হয়। এসব বিষয়ের গভীরে যাবার প্রয়োজন নেই সব পাঠকের।
শরীরে SARS-CoV-2 এর অস্তিত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হবার জন্য শ্বাসনালীর উপরের অংশের (Nasopharynx, যা নাকের পিছনে থাকে) দেওয়াল থেকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা রস (swab) পরীক্ষা করা হয়। Polymerase chain reaction (PCR) ভিত্তিক বিশেষভাবে অনুমোদিত পদ্ধতিতে ভাইরাসটির আরএনএ বিশ্লেষণ করার প্রক্রিয়াটিই সম্ভবত সেরা। সহজতর এবং সস্তা কিছু পরীক্ষা ব্যাপক হারে জনগণের স্ক্রিনিং করতে কার্যকর। রক্তেও কিছু পরীক্ষা করা যায়, যা মহারাষ্ট্র শুরু করার অনুমতি পেয়েছে। রক্তে যেহেতু ভাইরাসটি পাওয়া যায় না, বদলে খোঁজা হয় তার বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যাণ্টিবডি, তাই সংক্রমণ হওয়ামাত্র এই পরীক্ষায় সঠিক ফল আসা অসম্ভব। অ্যাণ্টিবডি তৈরি হতে কদিন সময় লাগে। রোগলক্ষণহীন জীবাণুবাহকদের খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে এই পদ্ধতি। অবশ্য রোগের বিভিন্ন লক্ষণ আর বিভিন্ন পরীক্ষার ফল দেখে ভাইরাস পরীক্ষার আগেও অভিজ্ঞ চিকিৎসক আন্দাজ করতে পারবেন যে রোগীর COVID-19 হয়েছে। রোগীর সংখ্যা যদি খুব বেড়ে যায়, তখন চিকিৎসকের আন্দাজকেই মান্য ধরে নিয়ে চিকিৎসা চালাতে হবে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অনুমোদনের অপেক্ষা না রেখেই।
সাধারণত আমরা বলি অমুক ব্যক্তির ভাইরাস সংক্রমণ আছে বা নেই। বাস্তব এরকম সাদা-কালো নয়। সংক্রামিত কোনো ব্যক্তির শরীরে প্রচুর ভাইরাস, কারো শরীরে কম। এইচ-আই-ভি বা হেপাটাইটিস-বির চিকিৎসার অঙ্গ হিসেবে শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ (viral load) মাপা হয় বিভিন্ন সময়ে। PCR পদ্ধতিতে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার সময় এর পরিমাণ অনুমান করা যায়। যে ব্যক্তির শ্বাসনালীতে এই ভাইরাসের পরিমাণ বেশি, সেই ব্যক্তির ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষমতা (infectivity) বেশি। অন্য কিছু ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও এমনটাই হবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
ভাইরাস শরীরের কতটা ক্ষতি করতে পারবে তা ভাইরাস আর শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার লড়াইয়ের দ্বারা নির্ধারিত হয়। বার্ধক্য, ডায়াবেটিস, কিডনির অসুখ, ক্যান্সার এবং অন্যান্য বিভিন্ন অসুখে যেহেতু প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, তাই এই ধরণের রোগীদের শরীরে COVID-19 ধ্বংসলীলা চালায় সহজেই। এছাড়াও শরীরের বিভিন্ন বিপাকক্রিয়া এবং সেরে ওঠার ক্ষমতা কমে যায় এইসব পরিস্থিতিতে এবং উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ইত্যাদিতেও। তাই এঁদের ক্ষেত্রে গুরুতর অসুস্থতা আর মৃত্যুর হার বেশি।
সংক্রামিত হবার সময় একবারে কতটা ভাইরাস শরীরে ঢুকল (infective dose), তার সঙ্গে রোগের তীব্রতার সম্পর্ক COVID-19 এর ক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত নয়। বিজ্ঞানের সাহায্যে একটি অনুমান করা হয়। যেহেতু SARS-CoV-2 -এর সঙ্গে আমাদের শরীরের কোনো পূর্বপরিচয় নেই, তাই ভাইরাস এবং ইমিউনিটি উভয়কেই দৌড় শুরু করতে হয় একসঙ্গে। ভাইরাস বংশবৃদ্ধি করতে থাকে এবং ইমিউনিটিও তাকে চিনে নিয়ে তার বিরুদ্ধে মিসাইল (antibody) তৈরি করে তাকে সবংশে নিধন করার চেষ্টা করে। ধরা যাক প্রথমে এক লক্ষ ভাইরাস দেহে প্রবেশ করলে তারা যে হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে ক-বাবুর ইমিউনিটি তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে এবং এর ফলে কাশি, জ্বর জাতীয় কিছু উপসর্গ হয়, কিন্তু ফুসফুসের দুর্গটিকে ধসিয়ে দেবার আগেই ক-বাবুর সেনাবাহিনী ভাইরাসকে কব্জা করে ফেলে। অনুমান করা যায় যে মাত্র দশ হাজার ভাইরাস প্রথমে এলে ক-বাবুর হয়ত কোনো উপসর্গই হবে না, আবার আক্রমণকারীর সংখ্যা প্রথমেই একশ কোটি হলে তিনি হয়ত মারাত্মকভাবে অসুস্থ হবেন। জার্মানিতে হওয়া COVID-19 নিয়ে প্রথমদিকের কিছু ছোট পরীক্ষায় এই অনুমানের সত্যতা কিন্তু প্রমাণিত হয়নি। তবে দেখা গেছে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে COVID-19-এ মৃত্যুর হার অন্যদের তুলনায় বেশি এবং অনেক কম বয়সের চিকিৎসকেরাও মারা যাচ্ছেন। এ থেকে অনেকেই মনে করছেন ইনফেক্টিভ ডোজ আর অসুখের ভয়াবহতার মধ্যে বাস্তবে সম্পর্ক আছে। একজন সংক্রামিত ব্যক্তির সন্নিধানে দশ মিনিট কাটিয়ে আপনি যতগুলো ভাইরাস পেতে পারেন, COVID-19 ওয়ার্ডে কাজ করা চিকিৎসক-নার্সেরা দীর্ঘ সময় রোগীদের সঙ্গে নিয়মিত কাটিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি ভাইরাস উপহার পান। এর ফলে তাঁদের ইমিউনিটি অসম যুদ্ধে পেরে ওঠে না এবং রোগ হয় ভয়ঙ্কর। পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (PPE) নামক বিশেষ পোশাক তাই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, শুধু চিকিৎসক-নার্সদের প্রাণ বাঁচাতেই নয়, তাঁদের সংস্পর্শে আসা অন্য মানুষদের বাঁচাতে এবং এই যুদ্ধে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ার সেনাবাহিনীটিকে অক্ষত রাখার জন্যেও।
অনেকে বলছেন, COVID-19 আসলে ইনফ্লুয়েঞ্জা। মিথ্যে হৈচৈ করা হচ্ছে। কথাটা ভুল। করোনাভাইরাস আর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দুটি আলাদা পরিবারভুক্ত (যথাক্রমে Coronaviridae এবং Orthomyxoviridae) ভাইরাস। উভয়েই শ্বাসনালীতে সংক্রমণ ঘটায় ঠিকই, কিন্তু তফাৎ অনেকটা কৃষ্ণনগর লোকাল আর বালিগঞ্জ ডিপোর ট্রামের মতো। ইনফ্লুয়েঞ্জার নরহত্যা করার প্রবণতা অনেকটাই কম। তাছাড়া ইনফ্লুয়েঞ্জার বিরুদ্ধে কিছু ভ্যাক্সিন আর ওষুধ আছে, যা করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে নেই।
ওষুধ নেই মানে? শ্যামবাবু যে টিভি দেখে চার পাতা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন আর অ্যাজিথ্রোমাইসিন কিনলেন! এই ওষুধগুলো নির্দিষ্ট প্রয়োজনে নির্দিষ্ট মানুষের উপর প্রয়োগের জন্য অনুমোদিত এবং তা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারেই হওয়া উচিত। এই ওষুধগুলোর কার্যকরিতা আহামরি নয় এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে, যেমন হৃদস্পন্দনের জন্য জরুরি বৈদ্যুতিক কর্মকাণ্ডে "QT prolongation" নামক একধরণের মারাত্মক গোললাল ঘটাতে পারে। এমনও হতে পারে শ্যামবাবু রাত্রিবেলা দুরকম ওষুধ পছন্দমতো ডোজে খেয়ে শুতে গেলেন এবং সকালে আর জাগলেন না, কারণ করোনা আসেনি কিন্তু ওষুধের প্রভাবে তাঁর হৃদস্পন্দন থেমে গেছে।
ভ্যাক্সিন কি পাওয়া যেতে পারে? অবশ্যই পেতে পারি। গবেষণা চলছে। পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে দাবি করেছেন, তাঁদের আবিষ্কৃত টিকা ইঁদুরের শরীরে করোনাভাইরাসরোধী অ্যাণ্টিবডির জন্ম দিচ্ছে সফলভাবে। আশাপ্রদ খবর, কিন্তু মানুষের উপর পরীক্ষা হয়ে কার্যকর ও নিরাপদ প্রমাণিত হয়ে ছাড়পত্র পেয়ে ভারত-ভ্রমণে আসতে তার কয়েক মাস তো লাগবেই। ততদিন আমাদের লড়তে হবে অন্যভাবে।
করোনাভাইরাস কি খুব বড়? মুখোশে আটকে যায়? না, ভাইরাসটি ছোট। মুখোশে ভাইরাস আটকায় না, আটকায় ড্রপলেটগুলো, যার মধ্যে অজস্র ভাইরাস থাকে। এন-৯৫ মুখোশ খুব চেপে নিয়মানুসারে পরে থাকতে পারলে ভালো কাজ করে, কিন্তু সেভাবে পরে থাকা বেশ কষ্টকর। তাছাড়া সংক্রামিত রোগীর কাছে কাজ করা চিকিৎসাকর্মী অথবা প্যাথোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট ছাড়া অন্য কারো এই মুখোশ পরার প্রয়োজন নেই। সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক পরা যেতে পারে, কিন্তু ফাঁকা রাস্তায় বা বাড়ির ছাদে মাস্ক পরে ঘোরার প্রয়োজন নেই। আবার মাস্কের ভরসায় ভিড়ের মধ্যে গিয়ে নিজেকে অপরাজেয় অমর ভাবলে করোনাভাইরাস সোৎসাহে আপনার শরীরে আসার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারে। যাঁদের হাঁচি-কাশি হচ্ছে, তাঁদেরই অনুরোধ করা হচ্ছে মুখোশ পরতে। তাহলে তা অন্যদের মধ্যে ছড়াবে না৷ এই কাজটা অনেক সহজ। বৃদ্ধ চর্মকার হবুচন্দ্র রাজাকে বলেছিলেন, "নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।"
(কৌশিক দত্ত আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক)
এই কলামের গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন