নাসিরুদ্দিন শাহ, সঞ্জয় মঞ্জরেকর, বিষেণ সিং বেদী। এবং আরও কেউ কেউ দেশি-বিদেশি। একে একে মুখ খুলতে শুরু করেছেন কেষ্টবিষ্টুরা। যা এতদিন গুঞ্জনের পর্যায়ে ছিল, হঠাৎই যেন কোলাহলে পরিণত। বিষেণ বেদী বলে দিচ্ছেন, "ও যা করছে মাঠে, আমাদের সময়ে এই আচার-আচরণ অকল্পনীয় ছিল।" নাসিরুদ্দিন শাহের টুইট আলোড়ন ফেলছে আসমুদ্রহিমাচলে, "বিরাট কোহলি পৃথিবীর সবচেয়ে অসভ্য প্লেয়ার। গ্রেট ব্যাটসম্যান ঠিকই। কিন্তু সেই গ্রেটনেস ম্লান হয়ে যায় মাঠে ওর ভাবভঙ্গি আর দুর্ব্যবহারে।"
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, সুন্দরী নারীর অন্য কোন খুঁত না পেলে রূপের গর্বের অবতারণা করতে হয়। বিরাটের ক্ষেত্রে কি তাই ঘটছে? ভারত অধিনায়কের ব্যাটে ভাঙছে একের পর এক রেকর্ড, স্বয়ং শচীন তেন্ডুলকরের একশো আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির এভারেস্টছুঁই পরিসংখ্যানও বিরাটের দাপটে আর সম্পূর্ণ অরক্ষিত দেখাচ্ছে না আগামীতে। ক্রিকেটের তিনটে ফরম্যাটেই অচিন্ত্যনীয় প্রভুত্ব কায়েম করছেন ধারাবাহিক, সেই শচীন-আমলের মতো টিম সঙ্কটে পড়লেই 'যতক্ষণ বিরাট, ততক্ষণ ভারত' রিংটোন বাজছে অবধারিত। খেলায় কোনো খুঁত পাওয়া যাচ্ছে না বলেই কি মাঠে উগ্র থেকে উগ্রতর শরীরী ভাষার অভিযোগে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে শচীন-পরবর্তী যুগে ভারতের শ্রেষ্ঠতম ব্যাটসম্যানকে?
আরও পড়ুন: “বিরাট কোহলি বিশ্বের সবচেয়ে অসভ্য প্লেয়ার”
এক কথায় এ প্রশ্নের উত্তর হয় না। বিশুদ্ধবাদীরা বলবেন, 'ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা', তথাকথিত 'জেন্টলম্যান্স গেম'। হ্যাঁ, ভদ্রলোকের খেলা ছিল বটে একসময়। আর নেই। ক্রিকেট কেন, কোনো খেলাই আর সেই অর্থে 'ভদ্রলোকের খেলা' নয়। যুগ পাল্টেছে। চিন্তাভাবনা পাল্টেছে। 'স্পোর্টসম্যান স্পিরিট' খুব ভাল জিনিস। শুনতে ভাল। কিন্তু সারসত্যিটা মেনে নেওয়া ভাল, আজকের খেলার দুনিয়ায় যে কোন মূল্যে জেতাটাই আসল। বাকি সব গৌণ।
বিজিতকে যেহেতু কেউ মনে রাখে না, তাই 'স্পোর্টসম্যান স্পিরিট' বন্ধক রাখতে হলে হোক, আজকের পেশাদার ক্রীড়াবিদের কাছে জয়ই পূর্ণ সত্য। বাকি যা কিছু আছে, সব খণ্ড সত্য। কথাই তো আছে, প্রেমে এবং যুদ্ধে কোনো কিছুই অন্যায় নয়। এবং ভাবের ঘরে চুরি করে লাভ নেই, খেলাও বর্তমান দুনিয়ায় তো যুদ্ধই। 'মারি অরি পারি যে কৌশলে'। তা মাঠে মরিয়া স্লেজিং বা আগ্রাসনকে রণকৌশলের অঙ্গ হিসাবে দেখতে দোষ কোথায়? আজ থেকে নয়, বহু বছর আগে থেকেই ক্রিকেট মাঠে স্লেজিংয়ের আমদানি যে অস্ট্রেলিয়ানরাই করেছেন, সেটা তো ঐতিহাসিক সত্য। তা সেই অজিদের বিরুদ্ধে চলতি সিরিজে বিরাট যা করছেন, জেতার জন্যই তো করছেন, বিপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টির জন্যই তো করছেন। তাহলে কিসের এত 'গেল গেল' রব? কিসের এত সমালোচনা, কিসের এত অভিযোগ 'অসভ্যতার'?
আরও পড়ুন: দ্রাবিড়-ধোনিও পারেননি, অধিনায়ক হিসেবে করে দেখালেন কোহলি
'গেল গেল' রব, কারণ যাঁকে ঘিরে অভিযোগ, যাঁর বিরুদ্ধে এত সমালোচনার তীর, তিনি রাম-শ্যাম-যদু-মধু নন। তিনি বিরাট কোহলি, এ যুগের সর্বোত্তম ব্যাটসম্যান এবং একশো তিরিশ কোটির দেশে জনপ্রিয়তম খেলায় ভারতের অধিনায়ক। পারফরম্যান্স ছাড়াও চ্যাম্পিয়নদের একটা দায় থাকে। 'রোল মডেল' হওয়ার দায়, দায় রাজমুকুটের সামাজিক মর্যাদা রক্ষার। সেই দায় বাইশ গজে কতটা পালন করছেন বিরাট, যিনি দেশে-বিদেশে অসংখ্য বালক-কিশোর-যুবক ক্রিকেট শিক্ষার্থীর 'আইডল'? যাঁর প্রতিটি নড়াচড়া অন্ধের মতো অনুসরণ করতে চায় এই প্রজন্মের অগণিত উঠতি ক্রিকেটার? তারা কী শিখছে?
যা দেখছে, তাই শিখছে। দেখে-শিখে ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি হওয়া দুঃসাধ্যই, কিন্তু ভাবভঙ্গি অনুকরণ করতে আর কী এমন কষ্ট? মাঠে আগ্রাসনে অন্যায় কিছু নেই। অন্যায় নেই উত্তপ্ত কথাচালাচালির স্লেজিংয়ে। হয়েই থাকে। কিন্তু বিরাটের আগ্রাসন তো ক্রমশ দৃষ্টিকটুরকম বেআব্রু হয়ে পড়ছে যত দিন যাচ্ছে। তরুণ ক্রিকেটার দেখছে আর ভাবছে, কোহলির মতো হতে গেলে বোধহয় জোরালো অ্যাপিল নাকচ হয়ে গেলে বিচিত্র মুখভঙ্গি করতে হয়, এবং আবেদনে ইতিবাচক সাড়া পেলে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তেড়ে যেতে হয়। দেখছে, মাঠের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও কীভাবে তার রেশ টেনে নিয়ে যেতে হয় মাঠের বাইরেও, বিপক্ষের অধিনায়কের সঙ্গে প্রথাগত হাত মেলানোর সময় চোখে চোখ মেলানোর ন্যূনতম সৌজন্যটাও শিকেয় তুলে রাখতে হয়।
আরও পড়ুন: বিরাট কোহলির থেকে শুধুই শিখতে চান বাংলার প্রয়াস
উল্লাসের প্রকাশভঙ্গি সবার সমান হবে না, জানা কথা। এটাও কিন্তু জানা কথা, সর্বোচ্চ মানের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িও টানতে হয় সেই প্রকাশভঙ্গির বহিরঙ্গে। সেই দাঁড়িটা টানতে না পারলে পাড়ার গলি-ক্রিকেটের চুলোচুলি ঝগড়াঝাঁটিতে পরিণত হয় ব্যাপারটা। বিরাট কবে বুঝবেন, তাঁকে, ভারতের অধিনায়ককে, কতটা মানায়, আর কতটা মানায় না?
মাঠে যখন ব্যাট হাতে শাসকের ভূমিকায়, তখন বিরাট রাজাধিরাজ, যাঁর সামনে নতমস্তকে কুর্নিশ ঠুকছে ক্রিকেটদুনিয়া। পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগ দিতে পছন্দ করেন না। সুযোগ দেনও না।
প্রিয় বিরাট, আপনাকে 'অসভ্য' বলার সুযোগটাও না হয় না-ই বা দিলেন!