এ লেখার শুরুতে একটু ভ্যানতারা করতেই হবে। কারণ বিষয়টা গৌরচন্দ্রিকায় না বলে নিলে হঠাৎ করে ঘরে কী কী বই রাখা যাবে সে নিয়ে আলোচনায় কেউ উৎসাহী হবেন না। তবে যাঁরা ভাবছেন এই লেখা পড়বেন না, তাঁদের জন্যে সাবধানবাণী। রাতবিরেতে রাষ্ট্র হানা দিতে পারে আপনার শোওয়ার ঘরে। খুঁজে দেখতে পারে বালিশের নিচে ঠিক কোন বইটা নিয়ে আপনি ঘুমিয়েছেন। ফলে শান্তিতে ঘুমোতে যেতে হলে এই লেখা অপাঠ্য হলেও অবশ্যপাঠ্য।
কিছুদিন আগে এলগার পরিষদ-ভীমা কোরেগাঁও মামলায় মাওবাদীদের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন ভার্নন গনজালভেজ মহাশয়। গত মাসের শেষে এই মামলায় বম্বে হাইকোর্টের মহামান্য বিচারপতি মহামান্য সারঙ্গ কোতোয়াল মহাশয় ভার্ননের বাড়ি থেকে পুলিশের বাজেয়াপ্ত করা কিছু কাগজপত্র এবং বই নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। সংবাদমাধ্যম তারপর খবর ছাপে যে আলোচিত বইগুলোর মধ্যে ছিল বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস 'ওয়ার অ্যান্ড পিস'। সকলেই জানেন, এই বইয়ের লেখক অসামান্য রাশিয়ান ঔপন্যাসিক লিও তলস্তয়। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে এই ধরনের একটি বিখ্যাত বই বাড়িতে থাকা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে কেন। পরের দিনই বিচারপতি ভালোভাবে বুঝিয়ে দেন যে তিনি লিও তলস্তয়ের লেখা 'ওয়ার অ্যান্ড পিস'-এর কথা বলেন নি, তিনি বোঝাতে চেয়েছেন 'ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন জঙ্গলমহল: পিপল, স্টেট অ্যান্ড মাওইস্টস' - এই বইটির কথা।
আরও পড়ুন: মাওবাদ: ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন জঙ্গলমহল’ এবং বম্বে হাইকোর্টের মন্তব্য
কলকাতার এক পরিচিত সাংবাদিক বিশ্বজিৎ রায় মহাশয়ের সম্পাদনায় সেতু প্রকাশনী দ্বারা ২০১২ সালে প্রকাশিত পুস্তকটি কিছু (অতি?) বামপন্থী বুদ্ধিজীবীর লেখনীর সমাহার। সাধারণভাবে গবেষক, বিশ্লেষক এবং রাজনীতি সংক্রান্ত তাত্ত্বিক বিষয়ে উৎসাহী বিদগ্ধ পণ্ডিত ছাড়া এই বইটির কথা জনগণের জানার কথা নয়। এ তো আর পাতি (হাঁস অর্থে) বই নয়। তাই প্রথম প্রকাশের পর দ্বিতীয়বার ছাপানো হয় নি। তবে এত আলোচনার মাঝে নিশ্চয় প্রকাশক এবং সম্পাদক ব্যবসায়িক স্বার্থে বইটি পুনঃপ্রকাশের কথা ভাবছেন। ফলে অ্যামাজনের শেষ দু-কপি ছাড়া ভবিষ্যতে পাতিরামে গেলেও পেতেই পারেন।
অন্তর্জাল খুঁজলেই দেখতে পাবেন যে সম্ভবত দু-একটি জায়গায় বইটি কিনতে পাওয়া যাচ্ছে এবং এখনও পর্যন্ত যা খবর, তাতে অবশ্যই এই বইটি নিষিদ্ধ নয়। অর্থাৎ এই বইটি বাড়িতে রাখা অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিৎ কিনা সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। গনজালভেসের উকিল দাবি করেছেন যে তাঁর মক্কেলের বাড়ি থেকে পুলিশ কোনও নিষিদ্ধ বইপত্র বা সিডি, ডিভিডি পায় নি। সে সত্যি-মিথ্যে রাষ্ট্র বিচার করুন। তবে সাবধানে থাকতে গেলে এই পরিস্থিতিতে মূল প্রশ্ন হলো, এমতাবস্থায় গৃহস্থঘরে ঠিক কী কী বই রাখা উচিৎ?
এমনিতে প্রশ্ন করা বারণ, এবং দেশে আজকাল সস্তায় মহাদ্রাক্ষারিষ্ট খরিদ করা যাচ্ছে যাতে একেবারেই প্রশ্ন না পায়। তবু প্রশ্ন যখন উঠেছে তখন এর সবথেকে সহজ উত্তর হলো, বাড়িতে কোনও বই না রাখাই সবচেয়ে ভালো। বই সাজালেই বখেড়া। আবার পড়তে হবে। বইতে ধুলো পড়লে ঝাড়তে হবে। মলাট ছিঁড়ে গেলে আঠা লাগাতে হবে। আগেকার দিনের মতো উনুনের বন্দোবস্ত নেই যে রান্না করতে বই কাজে লাগবে। তুলনায় পাতলা বই হলে অতীতে গ্রীষ্মের দাবদাহে মৃদুমন্দ বাতাস সেবন করা যেত। দেশের তুমুল উন্নতিতে এখন লোডশেডিং হয় না। ফলে সেই হাওয়া নাড়ানোর কাজেও বই অচল। আলমারি কিংবা টেবিল কিছুটা উঁচু করতে গেলে শক্ত মলাটের বই ব্যবহার করা যেতেই পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে সবকটা বই সমান মোটা হতে হবে। এদিকে লেখকগুলো মোটেও সুবিধের নয়। সবাই সন্ধি করে একই সংখ্যক পাতার বই লেখে না। ফলে মাদকদ্রব্য সেবন না করেও আলাদা বেধের বইয়ের নেশায় টেবিল টলে যেতে পারে।
তাই বাড়িতে যদি বই থাকে, আর দেরি না করে আজ সকালেই কাগজওয়ালা ডেকে ওজনদরে বিক্রি করে দিন। সাত কিলো রবীন্দ্রনাথ, দু কিলো নজরুল আর তিনশো গ্রামের মলাট হারানো পাগলা দাশু। খবরের কাগজ কি বাড়িতে সাজিয়ে রাখেন? তাহলে বই বেঁধে রাখা কেন? আজকাল আবার অনেক বই কম্পিউটারে ধরে রাখা যায়। সেগুলো বিদায় করা অনেক সোজা, একেবারে ডিলিট। না না এটা আমাদের দেশের নেতামন্ত্রীদের ডিলিট ডিগ্রির ব্যাপার নয়, কম্পিউটার কিংবা মোবাইল ফোন থেকে তথ্য মুছে দেওয়ার কথা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ‘নতুন ভারতবর্ষে স্বাগত’, ওয়ার অ্যান্ড পিস প্রসঙ্গে বললেন জয়রাম রমেশ
যে দেশে নেতানেত্রী মাত্রেই ডিলিট নিয়ে বসে আছেন আর নামের আগে ডাক্তার, সেখানে পড়াশোনা যথেষ্ট হয়েছে। সকলেরই এত বেশি বেশি ডিগ্রি যে বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে পেলেও শংসাপত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। আর আরও গভীরে গেলে অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই অস্তিত্বহীনতায় ভোগে। বিশ্বনাগরিকদের তাই কষ্ট করে বিদ্যার ভার বহন করার দরকার নেই। বছরে একদিন মা সরস্বতীর আরাধনাই যথেষ্ট। ডোজ বেশি লাগলে মা দুর্গার সঙ্গেও উনি আর একবার আসেন।
ধর্মের পথে জিরাফ সঙ্গে নিয়ে চলতে গেলে গভীরতর ভাবনার কোনও প্রয়োজন নেই। হোয়াটসঅ্যাপে যা আসবে সেটুকু পড়ে নিলেই যথেষ্ট। লিখতে হলে সেটাও মুঠোফোনে। মন দিয়ে পড়লে একটি বিষয় নিয়েই একগাদা জটিল প্রশ্ন জাগবে। তখন তিন তালাক, কাশ্মীর, অ্যামাজনে আগুন, ব্রেক্সিট, সিরিয়া, বিরাট কোহলি, আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি, বৌবাজারে মেট্রোর গর্ত খোঁড়ার জন্যে বাড়িতে ফাটল, তৃণমূল থেকে বিজেপিতে আগত নেতানেত্রীদের দু-দলের সীমানায় খোপ কেটে এক্কাদোক্কা, এত সব বিষয় সামলানো শক্ত।
কিন্তু কিছুই যদি মন দিয়ে না পড়েন, সবটাই যদি আলতো ছোঁয়ায় ফাঁকা কলসির চারপাশে বায়ুস্তরের অনুরণনে গুরুগম্ভীর শব্দ ভাসায়, তাহলে মুশকিল অনেক কম। অনেক নিশ্চিন্তে ভোট দিয়ে ঠিক যেমন আমাদের প্রাপ্য, তেমন নেতা নির্বাচন করতে সমর্থ হবেন তখনই। আর বেশি পড়লেই সংসদীয় গণতন্ত্রকে শুয়োরের খোঁয়াড় মনে হবে। রাতে কম খেলেও তখন বদহজম অবশ্যম্ভাবী। 'ওয়ার অ্যান্ড পিস' পড়ে গোটাটার মানে বুঝতেই বেশ কয়েকদিন নষ্ট। কেউ বলে উপন্যাস, কেউ বলে কবিতার মতো, কেউ বা আবার বলে সময়ের দলিল। থুড়ি, কেউ নয়, লিও তলস্তয়ই হয়তো বলে দেন সে কথা। নেপোলিয়নের রুশ দেশ আক্রমণের পটভূমিতে লেখা ১৮৬৫ থেকে ৬৭-র সেই ধারাবাহিক রচনা বই হয়ে বেরোয় ১৮৬৯ সালে। সময় তো বহমান, তাহলে আর ফালতু দলিলের দরকার কী? সেটা না বুঝে গোঁয়ারের মত তলস্তয়ের 'ওয়ার অ্যান্ড পিস' পড়েন কিছু মানুষ।
আর কী অবাক করার কথা, তার থেকেও লম্বা নামের বই 'ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন জঙ্গলমহল: পিপল, স্টেট অ্যান্ড মাওইস্টস'-ও পড়ে ফেলেন অবুঝ পড়ুয়ারা। ঘরে রেখেও দেন সে বই। যেখানে কিনা লেখা আছে বালাগোপাল, ভারভারা রাও, গৌতম নওলাখা, কিংবা বিনায়ক সেনের মত বামপন্থীদের মতামত। এঁরা দেশপ্রেমিক নাকি দেশদ্রোহী, সে বিচারের দায়িত্ব যাঁরা ক্ষমতায় তাঁদের। বিচার সবসময় ক্ষমতাশালীদের হাতে। আর যাঁরা নিজেদের ক্ষমতার বদলে অনেক বেশি মানুষের ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখেন, স্বাভাবিক নিয়মেই তাঁদের নামে নালিশ বেশি।
তাই এত কথায় কাজ কী? স্বচ্ছ ভারতে বইয়ের জঞ্জাল থেকে মুক্ত হোক আপামর জনসাধারণ। কলমের থেকে গণপিটুনির জোর অনেক বেশি। তাই লেখাপড়া শুধু মুঠোফোনে। এই প্রযুক্তির বর্ষায় তার থেকে বেশি আশা করলে সাত দিনের ফাঁসি। তবু তা সত্ত্বেও যদি মনে করেন বই একটা রাখতেই হবে ঘরে, সেক্ষেত্রে ছড়ায় ছবিতে শিশুপাঠ্য রামায়ণ বৈঠকখানায় সাজিয়ে রাখতে পারেন। বেশি চাইবেন না, কারণ মন দিয়ে 'রামচরিত মানস' পড়লেও সনাতন হিন্দুধর্মের গভীরতর ভাবনায় অনেকটা সময় নষ্ট হবে। চাপ বাড়াবেন না, মাথাটা হাল্কা রাখুন, আর বইমেলার আগে আলগা অবাঙালি উচ্চারণে স্লোগান তুলুন, "বই পোড়ান"।