মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথার অবিস্মরণীয় সংলাপ, ‘তোমার মন নাই কুসুম’-এর সঙ্গে এই লেখার একটা ক্ষীণ সম্পর্ক আছে। তবে কুসুমের মন এখানে আম বাঙালির প্রতিনিধি। সেই সূত্র ধরেই সদ্য বরোনো তিন বিধানসভা কেন্দ্রের ফল নিয়ে প্রশ্ন, বাঙালি ভোটার কি দ্রুত মন পাল্টাচ্ছে?
গত বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের যে তিনটি উপ নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়েছে তা দেখে এমন মনে হওয়ার সঙ্গত কারণ আছে। কেন? তা নিয়েই এই বিশ্লেষণ।
১৯৫২ থেকে ১৯৬৭, এই সময়ে যত ভোট হয়েছে আমাদের রাজ্যে সেখানে মোটামুটি ভোটারদের কংগ্রেসমুখী ঝোঁক ছিল স্পষ্ট। প্রায় ১৫ বছর এই ধারা কম-বেশি ছিল। তার পর ছবিটা বদলাতে শুরু করল ১৯৬৭ থেকে। ১৯৭৭-এ গিয়ে সেটা একটা পূর্ণ রূপ পেল। এবার সেটা চলতে থাকল। যেখানে বড় অংশ ভোটারের ভোটদানের ঝোঁক ছিল বামপন্থীদের দিকে। এই ঝোঁক চলল কয়েক দশক ধরে। অর্থাৎ বাংলার ভোটাররা সহজে কোনও দলকে ছেড়ে যায় না। অনেকটা সময় দেয়। আবার ছেড়ে গেলে, সহজে সেই দলের কাছে ফেরে না। হৃদমাঝারে যাকে একবার রাখবে, তাকে সহজে ছাড়বে না। আর যখন ছাড়বে তখন সোনারই হোক আর পেতলেরই হোক, সে গৌরকে ফেরানোর চান্স প্রায় শূন্য।
আরও পড়ুন, তিন কেন্দ্রের উপনির্বাচন: আরও তলানিতে বাম-কংগ্রেস ভোট
এটা কোনও বিজ্ঞান অবশ্যই নয়। বরং বলা যায় ভোটারদের আচরণ ও মানসিকতায় একটা ‘নিয়ম’ খুঁজে বের করার চেষ্টা। ২০১১তে যখন খুব সামান্য ভোটের ব্যবধানে তৃণমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের জোটের কাছে বামফ্রন্ট পরাজিত হল, তখন অনেক বামপন্থী নেতাই ভেবেছিলেন দ্রুত তাঁরা ক্ষমতায় ফিরে আসবেন। কারণ প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান খুবই কম ছিল। বাম নেতারাও অনেকে তেমন ভেবেছিলেন। ২০১১ সালের মে মাসের ১৩ তারিখ, যেদিন ভোটের ফল প্রকাশিত হয়েছিল, সেদিন একটি টিভি চ্যানেলকে সিপিএম নেতা গৌতম দেব আলিমুদ্দিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘রাস্তার রাজনীতির জয় হয়েছে, রাস্তার রাজনীতি দিয়েই আমরা আবার ফিরে আসব’। যদিও কয়েক বার টিভিতে গৌতম দেবের ওই বাইট চলার পর আলিমুদ্দিন থেকে ফোন করে অনুরোধ জানানো হয় গৌতম দেবের ওই বক্তব্য সম্প্রচার না করতে।
বাংলার ভোটারদের ভোটদানের প্রকৃতি সম্পর্কে আগে যে কথা বলা হল, তার সপক্ষে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ২০১১-এ বামফ্রন্টের ভোট ছিল ৪২ শতাংশ। তৃণমূল এবং কংগ্রেস জোটের ভোট ছিল ৪৭ শতাংশ। বিজেপির সাড়ে ছয় শতাংশ। ৮ বছর পর, ২০১৯-এর নভেম্বরে তিন বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে, কালিয়াগঞ্জ, খড়গপুর সদর এবং কররিমপুরে বামপন্থী এবং কংগ্রেসের মোট ভোট কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে সর্বনিম্ন সাড়ে ছয় শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ১৪.৮ শতাংশ। দুই দলের ভোট সমান সমান ধরলে (এমন ধরার পিছনে যুক্তি আছে, তবে এখানে সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না) বামেদের ভোট দাঁড়ায়, সর্বনিম্ন সোয়া তিন শতাংশ আর খড়গপুর সদরে সর্বোচ্চ, ৭. ৪ শতাংশ। এ থেকে অনুমান হয়, বামপন্থীদের সুদীর্ঘ সময় ধরে সমর্থনের পর, এখনও বাংলার ভোটাররা ফের বামমুখী হতে এখনও প্রস্তুত নয়।
কথাটা সত্যি সর্বভারতীয় দল কংগ্রেস সম্পর্কেও। কংগ্রেস এই রাজ্যে ক্ষমতার বাইরে আছে প্রায় ৪২ বছর। মাঝে কখনও কয়েকটা দিন বা দু’চার মাস এদল সেদলের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় ছিল, সেটা ধরা হচ্ছে না।
এবারে প্রশ্ন, এতক্ষণ বাংলার ভোটারদের ভোট দানের যে ট্রেন্ড বা ঝোঁকের কথা বলা হল, তা কি বদলে যাচ্ছে? ভোটদানের চরিত্রে কি কোনও পরিবর্তন আসছে? বাংলার ভোটাররা কি খুব দ্রুত মন পাল্টাচ্ছেন? গণতন্ত্রের পক্ষে সেটা অবশ্য খুবই শুভ লক্ষণ, তবে নেতা নেত্রীদের কপালে ভাঁজ ফেলে দিতে পারে, যদি সত্যিই তেমন হয়। কেন এই কথা, এবারে সেই প্রসঙ্গ। ভোটারদের ‘মন কি বাত’ অনুধাবন করার চেষ্টা।
ধরা যাক কালিয়াগঞ্জ আসন। এই আসনটির জন্ম ১৯৬২ সালে। তার পর থেকে বিধানসভার সব ক’টি নির্বাচন এবং উপনির্বাচন ধরে এই আসনে ভোট হয়েছে ১৪ বার। তার ভেতর ১১ বার এই আসন জিতেছে কংগ্রেস। তিনবার জয়ী হয়েছে বামফ্রন্ট। এই যে তিনবার বামফ্রন্ট জিতল, প্রত্যেক বারই জিতেছে খুব কম ভোটের ব্যবধানে। অন্য দিকে ১৯৭৭-এ প্রবল কংগ্রেস বিরোধী হাওয়ায় কংগ্রেস মাত্র ৫০০ ভোটের ব্যবধানে এই আসন জিতলেও, বাকি প্রায় প্রত্যেকটি নির্বাচনে কিন্তু হয় মাঝারি নয় বড় ব্যবধান ব্যবধান কংগ্রেস জয়ী হয়েছিল।
অর্থাৎ আম ভোটার কংগ্রেসকে এক আধ বার ত্যাগ করলেও, কার্যত ছেড়ে যায়নি, বার বার ফিরে এসেছে। ২০১৬-এর বিধানসভা ভোটে দুই পরস্পরের শত্রু এক জোট হয়ে গেল, এই আসনে বামফ্রন্টের সঙ্গে জোট বেঁধে কংগ্রেস প্রার্থী সাড়ে ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ৪৬, ৬০২ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হলেন। তৃণমূলের ভোট ছিল ৩১ শতাংশ। বিজেপির ভোট ছিল ১৩ শতাংশ। তিন বছর বাদে লোকসভা ভোটে এই বিধানসভা আসনে সব হিসেব এবং ভোট দানের পরম্পরা ভুলে ভোটাররা ঢেলে ভোট দিলেন বিজেপিকে। বিজেপি ভোট পেল ৫২ শতাংশ। প্রায় তিন বছর আগে বিধানসভায় কংগ্রেস-বামফ্রন্টের প্রাপ্ত ভোটের সমান। বিধানসভার তুলনায় তৃণমূলের ভোট কমে হল ২৭ শতাংশ।
আরও পড়ুন, আর এনআরসি নয়
জোট না থাকলেও, দেখা গেল কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট, দু’পক্ষ মিলিত ভাবে পেল মাত্র ১৬ শতাংশ (৮ শতাংশ কংগ্রেস, ৮ শতাংশ বামফ্রন্ট) ভোট। ২০১৯-এ, তিন বছরের মধ্যে একটা বড় পরিবর্তন ঘটে গেল। বিজেপি উঠে এল প্রথম স্থানে। বাকি তিন দলের ভোট কমল। এর পর মাত্র ছ’মাস পরে এই কেন্দ্রে উপনির্বাচন। এখানে দেখা গেল বিজেপি তার প্রথম স্থান হারিয়েছে, ভোট কমেছে প্রায় দশ শতাংশ। তৃণমূল কংগ্রেস ছ’মাস আগের ২৭ শতাংশ থেকে ভোট বাড়িয়ে পেল ৪৩.৬ শতাংশ ভোট। বাম কংগ্রেসের ভোট সামান্য বেড়ে হল ১৮.৮ শতাংশ। এই যে ২০১৬ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে তিনটি নির্বাচনে বেশ বড় ব্যবধানে তিন রকম ফল, এমনটা কালিয়াগঞ্জে আগে কখনও ঘটেনি। এনআরসির মতো বড় বড় ভোটের ইস্যু অতীতেও এসেছে। তাতেও কালিয়াগঞ্জে বা বলা যায় বাংলার ভোট বাক্সে এমন ওঠা-নামা দেখা যায়নি।
অবশ্যই আরও দেখতে হবে, আরও বিশ্লেষণ প্রয়োজন, কিন্তু প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, রাজনীতির ক্ষেত্রে বাংলার ভোটাররা আগের মতো রয়ে-সয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না, আগের মতো অত থিতু নয়, বরং বলা যায় একটু দ্রুত সিদ্ধান্ত বদলে যাচ্ছে। বঙ্গ রাজনীতির ভাষায় কেউ বলতেই পারেন, তাহলে কি ভোটাররা এখন স্যাটা-স্যাট সিদ্ধান্ত বদল করছেন? কালিয়াগঞ্জ আসনের ইতিহাস থেকে যে ছবিটা আমরা পাচ্ছি, ততটা স্পষ্ট না হলেও, তার কাছাকাছি ধরনের ঘটনা কিন্তু ঘটেছে খড়গপুর সদর বিধানসভা কেন্দ্রেও।
খড়গপুর সদর আসনের জন্ম ১৯৭৭ সালে। জরুরি অবস্থা পরবর্তী সে বছরটা অন্যরকম ছিল। খড়গপুর সদর ১৯৭৭-এ পায় জনতা পার্টি। তার পর থেকে ৮২, ৬৭, ৯১, ৯৬, ২০০১, ২০০৬এবং ২০১১-র বিধানসভা ভোটে ভালো ব্যবধানে আসনটি দখলে রাখে কংগ্রেস। সিপিএম দ্বিতীয় স্থানে। ২০১৬ তে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে আসনটি দখল করে বিজেপি। কংগ্রেস-বাম জোট পায় প্রায় ৩৬ শতাংশ ভোট। তৃণমূল ২২ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে থাকে। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে এই কেন্দ্রে বিজেপির ভোট বেড়ে হয় ৫৭ শতাংশ তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটও বাড়ে। তৃণমূল প্রায় ৩০ শতাংশ ভোট। তৃতীয় স্থানে চলে আসে কংগ্রেস-বামের মিলিত ভাবে প্রাপ্ত ভোট।
এই যে খুব অল্প সময়ে ভোটের হারে দ্রুত ওঠা-নামা, এখান থেকেই ভোটারদের মানসিকতা বদলে যাওয়ার প্রশ্নটি উঠে আসছে। করিমপুরে অবশ্য তেমন পরিবর্তনের ইঙ্গিত নেই। কিন্তু তিনটির মধ্যে দু’টি আসনের ক্ষেত্রে যে নতুন ধরনের ঝোঁক দেখা যাচ্ছে, তা মোটেই নজর এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়।
আরও পড়ুন, হতভাগা ইভিএম! হারলে নন্দঘোষ, জিতলে জোটে না প্রশংসা
কিন্তু কেন এমন ঘটছে? অনেকে নানান কারণ বললেও, একটি বিষয়ে দেখা যাচ্ছে প্রায় সকলেই একমত। সেটা হল ভোটারদের উপর সোশাল মিডিয়ার প্রভাব। যে প্রভাব ক্রমাগত বাড়ছে। যা ভোটারদের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করছে।
২০১৪ থেকে ভোটারদের উপর সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রভাব ফেলার সক্রিয় প্রচেষ্টার শুরু। সেই প্রক্রিয়া এখন বলা যায় তুঙ্গে। আর এখন, কোনও রাজনৈতিক দল কী বলল সেটাই সিদ্ধান্ত গ্রহণের একমাত্র সূত্র আর নেই। খেলাটা এখন দলীয় নেতাদের আইটি সেলের হাত থেকে অনেকটাই বেরিয়ে গিয়েছে। ভুল-ঠিক মিলিয়ে এত অসংখ্য তথ্য ২৪ ঘণ্টা ধরে সোশাল মিডিয়ার মধ্যে দিয়ে একজন ভোটারের কাছে আসছে এবং বার বার ঠকতে ঠকতে যখন ভুল-ঠিক বাছাইয়ের কিছুটা ক্ষমতাও সে অর্জন করে ফেলছে, তখন তার আনুগত্যের, কোনও একটি নির্দিষ্ট দলের থানে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকার মেয়াদ, ক্রমেই কমতে থাকবে। যত সীমিতই হোক, যত ভুলই থাকুক না কেন, তথ্যের সর্বজনীনতা স্বাধীন চিন্তার বড় শর্ত।
হোয়্যাটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির পরিচালকেরা যতই ষড়যন্ত্র করুন, তথ্যের দরজা একবার খুলে যাবার পর তার ছাত্র-ছাত্রীরা দু’একবার ভুল করবে, কিন্তু বার বার ফাঁদে পা হয়তো দেবে না। এমন একটা ইঙ্গিত অন্তত পাওয়া যাচ্ছে। অনেক খারাপের একটা অন্যতম ভাল দিক হতে পারে এটা।
(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)
এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে ক্লিক করে