ত্রিপুরার রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান হওয়ার পরই তীব্র পতন। উত্থানকে সঙ্গী করে ঘাসফুল শিবির কখনও ধারাবাহিক ভাবে বাঙালি অধ্যুষিত ওই রাজ্যে নিজের জমি পাকা করতে পারেনি। এ যেন এক পা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে আসা। তৃণমূল কংগ্রেস ত্রিপুরায় লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির থেকে অনেক আগে নির্বাচনী লড়াই শুরু করেছিল। শুধু তাই নয়, রীতমতো সেখানকার শাসকদলকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। সে সব এখন অতীত। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে যেভাবে দলে ভাঙন শুরু হয়েছে সেক্ষেত্রে তার ফল আদৌ সুখকর হবে না বলেই ধারনা রাজনৈতিক মহলের।
কংগ্রেস থেকে সুধীররঞ্জন মজুমদার তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর দলে জোয়ার এসেছিল। সে তিন দশক আগের কথা। বঙ্গে দল গঠনের পরের বছরই ত্রিপুরায় ভোট রাজনীতিতে দাগ কেটেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ১৯৯৯ লোকসভা নির্বাচনে প্রথমবার লড়াই করেই ২৬.৪০% ভোট পায় তৃণমূল। দলীয় প্রার্থী সুধীররঞ্জন মজুমদার ১,৭৪,১৫৪ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকে। কংগ্রেস ১৯৯৯-তে অনেকটা পিছনে থেকে তৃতীয় হয়।
ত্রিপুরায় তখনও বিজেপির নাম-নিশানা কিছুই ছিল না। সিপিএম সাংসদ সমর চৌধুরীর মৃত্যুর কারণে উপনির্বাচন হয় ২০০২ সালে। সেই নির্বাচনে কিন্তু এক ধাক্কায় তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট নেমে আসে ৩৩,৩৫৩-তে। ভোট পায় মাত্র ৪.৮৮%। কংগ্রেস তিন গুন ভোট বৃদ্ধি করে ফের দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে। এই নির্বাচনে এনসিপির মতো দলের প্রার্থী ছিল। তখনও বিজেপি ছিল না ভোটের ময়দানে।
সুধীররঞ্জন মজুমদার তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর ত্রিপুরায় দলের ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটে। সুধীরবাবু লোকসভা নির্বাচনে দলকে লাইমলাইটে এনেছিলেন। কিন্তু তাঁকে দল সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি বলেই অভিমত রাজনৈতিক মহলের। ত্রিপুরা তৃণমূলের বর্ষীয়ান জনৈক নেতার কথায়, শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করার জন্য ৭ দিন কলকাতায় অপেক্ষা করেছিলেন সুধীরবাবু। কিন্তু বৈঠক না হওয়ায় অপমানিত হয়ে ত্রিপুরায় ফিরে গিয়েছেন। ফিরে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। মৃত্যুর আগে কংগ্রেসের বিধায়কও হয়েছিলেন তিনি। ওই নেতৃত্বের দাবি, এককথায় দুঃখেই তৃণমূল ছেড়েছিলেন সুধীররঞ্জনবাবু।
ধারাবাহিকতার অভাব ত্রিপুরার তৃণমূলে কতটা তা নির্বাচনের ফলগুলিতেই প্রমাণ। ২০০৪ লোকসভা নির্বাচনে এই আসনে ফের তৃণমূল তৃতীয় স্থান পায়। ভোট পায় ৬৭,৩৭৯। শতাংশের হারে ৯.৬১। ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনে এই আসনে প্রার্থী দেয়নি তৃণমূল কংগ্রেস। দলের আগ্রহ ছিল না বলেই অভিমত তৃণমূলের একাংশের। ওই বছর ত্রিপুরা পূর্ব আসনে বিজেপি প্রথমবার প্রার্থী দিয়ে মাত্র ২.৭২ শতাংশ ভোট পায়।
২০১৪-এর লোকসভা নির্বাচনে রতন চক্রবর্তী প্রার্থী হন ঘাসফুল শিবিরের। তাঁর ভোটপ্রাপ্তি ১,১৭,৭২৭। শতাংশের হিসাবে ১০.৯৭। বিজেপি প্রার্থী পায় ৫৪,৭০৬ ভোট। শতাংশের হিসাবে ৫.১০। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তখন শাসন ক্ষমতায়। নির্বাচন বয়কট করার পক্ষে ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। রিগিং-এর অভিযোগ ছিল বিজেপির বিরুদ্ধে। বিজেপি প্রার্থী ৫১ শতাংশের ওপর ভোট পেয়ে জয়ী হয়। তৃণমূল প্রার্থী মামন খান পান মাত্র ৮,৬১৩ ভোট। শতাংশের হিসাবে ০.৭৮।
ত্রিপুরা পূর্ব লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী ভৃগুরাম রিয়াং ২০১৪-তে ৭৭,০২৮ ভোট পায়। শতাংশের হিসাবে ৮.০৮। প্রথমবার নির্বাচনে লড়াই করেও তৃণমূল কংগ্রেস এই কেন্দ্রে তৃতীয় স্থান পায়। বিজেপি চতুর্থ স্থানে ছিল। অথচ বিজেপি এই কেন্দ্রে ১৯৯১ সাল থেকে লড়াই করে আসছে। ২০১৯-এ এখানেও জয়ী হয় বিজেপি। তৃণমূল ত্রিপুরায় ০-তেই রয়ে গিয়েছে।
সুরজিত দত্ত, রতন চক্রবর্তী ও আশিসলাল সিং তৃণমূল করতে শুরু করার সময় ফের উত্থান ঘটতে থাকে তৃণমূলের। ২০১৪-তে দুই লোকসভা কেন্দ্রেই দলের ভদ্রস্থ ফল হয় বলে ত্রিপুরা তৃণমূলের দাবি। তাঁদের বক্তব্য, ওই সময় মাত্র ২১ দিনের প্রস্তুতিতে দুই আসনে লড়াই করতে হয়েছিল। তারপর মুকুল রায় কংগ্রেসের দলছুট বিধায়কদের নিয়ে আসায় ফের পরশি রাজ্যে তৃণমূলে ডামাডোল শুরু হয় বলেই দলের একাংশের দাবি। আশিসলাল সিং দলে থাকলেও গুরুত্বহীন হয়ে পড়েন।
আরও পড়ুন- মাথা মুড়িয়ে তৃণমূলে এসেছিলেন, ‘পরকীয়া’ অভিযোগে ঘাস-ফুলও ছাড়লেন সেই আশিস দাস
নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি। অন্যদিকে সুরজিত দত্ত, রতন চক্রবর্তীরা বিজেপিতে চলে যান। অথচ যে বিধায়করা তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরাও চলে গেলেন বিজেপিতে। দল একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ল। আশিসলাল সিংকে দল সভাপতির দায়িত্ব দিলেও সংগঠন তখন এতটাই ভঙ্গুর হয়ে যায় যে ২০১৮ বিধানসভা নির্বাচনে গোহারা হারে তৃণমূল কংগ্রেস। ২৪ আসনেই জামানত জব্দ হয় প্রার্থীদের। নেতৃত্ব স্থানীয়রা ত্রিপুরায় প্রচারে গেলেও দল সেভাবে আর্থিক সাহায্য করেনি বলেও দাবি করেছেন তৎকালীন ত্রিপুরা তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
এরপর ফের পুরসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে ত্রিপুরার রাজনীতির ময়দানে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে তৃণমূলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। পুরভোটে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে বিজেপির সঙ্গে। ভোট শতাংশের হারে দাগ কাটে তৃণমূল। তারপরই ৬ মাস চুপচাপ। বিজেপি বিধায়ক আশিস দাস মাথা মুণ্ডন করে দলে এসেও চুপসে ছিলেন। তাঁকে দলের কোনও কর্মসূচিতেই দেখা যায়নি।
শেষমেশ গুরুত্ব না পেয়ে দলই ছাড়লেন তিনি। প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি আশিসলাল সিংকেও দেখা যাচ্ছে না দলের কোনও কর্মকাণ্ডে। এসব কিসের ইঙ্গিত? রাজনৈতিক মহলের প্রশ্ন, ত্রিপুরায় আদপে কি চাইছে তৃণমূল কংগ্রেস? ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে এই ডামাডোলে ফললাভ হবে বিজেপির? এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে ত্রিপুরা রাজনৈতিক মহলে।