তিন বছর ধরে ঘরে ঘুমাতে পারেন না বাড়ির কোনও পুরুষ। আতঙ্কে বাড়ি লাগোয়া মাচাতেই মাসের পর মাস রাত জেগে কাটাচ্ছেন 'নিহত' বিজেপি কর্মী ত্রিলোচনের বাবা ও দুই দাদা। অভিযুক্তরা এখনও মাঝে মধ্যেই বাড়ির সামনে বাইক নিয়ে রাউন্ড দিয়ে হুমকি দেয় বলে ত্রিলোচনের পরিবারের অভিযোগ। একইসঙ্গে ওই ঘটনার পর বাড়ির অপর দুই ভাইয়ের বিয়ের সম্বন্ধ একের পর ভেঙে যাচ্ছে। কোনও মেয়েকে এই বাড়িতে বিয়ে দিতে চাইছে বলেই জানালেন পরিবারের সদস্যরা।
Advertisment
তুলনামূলক ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভাল ফল করেছিল বিজেপি। বিশেষত জঙ্গলমহলে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল অনেকটাই রাজনৈতিক ইঙ্গিতবাহী। বামজমানার পতনের আভাস দিয়েছিল ২০০৮-এর গ্রামপঞ্চায়েত নির্বাচন। পঞ্চায়েত ভোটের পর পরই ঘটেছিল সুপুরডিহির ঘটনা। পুরুলিয়ার বলরামপুর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে সুপুরডিহি গ্রাম। ৩০ মে ২০১৮ সালে ২০ বছরের ত্রিলোচন মাহাতর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছিল বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। তাঁকে অপরহরণ করে খুন করা হয়েছিল বলেই অভিযোগ করা হয়েছিল।
সুপুরডিহি গিয়ে দেখা গেল বাড়ির রং সম্পূর্ণ গেরুয়া। বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া ত্রিলোচন মাহাতর কংক্রিটের মূর্তি। বাড়ির পাশে বাঁশের মাচা। ঘর থাকতেও এই মাচাই এখন ত্রিলোচনের পরিবারের আস্তানা। এটাই যেন বাঁচার রসদ। বাড়ি থেকে ৭৫ মিটারের মধ্যে ঘটনার তিন দিন পর থেকে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পুলিশ পিকেট থাকলেও রাতা পাহারা চলে প্রতিদিনই। ত্রিলোচনের দাদা বিষ্ণুপদ বলেন, "রাত কেটে যায় ওই মাচাতেই। মা ছাড়া বাড়ির সকলে ওখানেই রাতে থাকি। পাড়ার কয়েকজনও চলে আসে।" কেন রাতে মাচায় কাটাতে হয়? বিষ্ণুপদর জবাব "সেদিনের ঘটনার পর এখনও আতঙ্ক আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ফের আমাদের ওপর হামলা হতে পারে। অভিযুক্তরা এখনও হুমকি দিয়ে চলেছে, পুলিশকে জানিয়েছি। তবে পুলিশ অভিযোগ নিতে চাইছে না।"
এক্সপ্রেস ফটো-পার্থ পাল
Advertisment
ত্রিলোচনের দুই দাদা বিষ্ণুপদ ও বিবেকানন্দ। ঘটনার পর দুভাইয়ের বিয়ে হওয়া নিয়ে একটা সামাজিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। পেশায় রংমিস্ত্রি বিষ্ণুপদ বলেন, "আমাদের দুভাইয়ের বিয়ে হওয়া নিয়ে সমস্য়া হচ্ছে। মেয়ের বাড়ির লোক পছন্দ করলেও বিয়ে পর্যন্ত গড়াচ্ছে না। যখনই জানতে পারছে ভাই খুন হয়েছিল, তখন কেউ রাজি হচ্ছেন না। এমন চার-পাঁচবার ঘটেছে।" বিষ্ণুপদর মা পানা মাহাত বলেন, "আমাদের আর সুখ হবে না। পাত্রী পক্ষ আমাদের বাড়িতে বিয়ে দিতে চাইছে না।" বাড়ির পাশে বাঁশের মাচা দেখিয়ে বিষ্ণুপদ বলেন, "সারা রাত কেটে যায় ওই মাচাতেই। বাবা, দাদা সবাই এখনও রাত জেগে পাহারা দিই। আবার যদি হামলা চালায়। অভিযুক্তরা মাঝে-মধ্যেই বাইক নিয়ে ঘুরে যায়। হুঁমকিও দেয়।" বিষ্ণুর কথায়, দাদা বিজেপি প্রার্থী হবে বলে দলের কাছে আবেদন করেছিল। কিন্তু দল করেনি। তবু আমারা বিজেপিকে জেতানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ব।
বলরামপুর কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল ত্রিলোচন। বিষ্ণুপদ জানায়, সন্ধ্যে ৬টা ৪০ মিনিটে ফোন করে ভাই জানিয়েছিল তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। তখন পুলিশকে জানানো হয়েছিল। মা পানাদেবী বলেন, "বুধবার পরীক্ষা ছিল। মঙ্গলবার জেরক্স করে ফিরছিল না ছেলে। কেন ফিরছিল না তা জানতে তখন ফোন করি। ছেলের সঙ্গে কথা হয়, ও বলে আধঘণ্টা পর ফিরব। আধঘণ্টা পর যখন মেজছেলে ত্রিলোচনকে ফোন করে তখন ছেলে বলে আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মেরে ফেলবে। তারপর রাতভর খোঁজা হয়েছে। সেদিন ভোরে থানাতে অভিযোগ করতে গেলে দূর দূর করে পুলিশ তাড়িয়ে দিয়েছিল। পরে খুনের মামলা রুজু করা হয়েছিল।"
এক্সপ্রেস ফটো- পার্থ পাল
ত্রিলোচনের বাবা ৬২ বছরের হরিরাম মাহতর বক্তব্য, "পুলিশ বলেছিল সকালে ছেলেকে পাওয়া যাবে। সকালে ছেলের সন্ধান মিলেছিল। তবে ধড়ে তখন প্রাণ ছিল না। ঝুলন্ত দেহ মিলেছিল।" ৩০মে বুধবার সকালে ছোলাগাড়া গ্রামে দেহ মিলেছিল ত্রিলোচনের। ত্রিলোচনের মৃতদেহের পাশে কাগজে লেখা ছিল, '১৮ বছর বয়সেই বিজেপির রাজনীতি এবার তোর প্রাণনীতি হল। তোকে ভোট থেকেই এই কাজটা করার চেষ্টা করি। পারিনি। আজ তোর প্রাণ শেষ।' এছাড়া তাঁর চি-শার্টেও লেখা ছিল ১৮ বছর বয়সেই বিজেপি করার কথা। ঘটনার তদন্ত বর্তেছিল সিআইডির ওপর। পুরুলিয়া জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতোর ছেলে সন্দীপ মাহাতোকে এই ঘটনায় গ্রেফতার করেছিলেন তদন্তকারীরা। জেলার এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক বলেন, "সুপুরডিহি গ্রামে পুলিশ পিকেটিং রয়েছে। তাছাড়া বিশেষ পুলিশের দল সেখানে রোজ টহল দেয়। আমাদের নজরে রয়েছে ওই গ্রামে।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন