২০১৯ লোকসভা ও ২০২১ বিধানসভা নির্বাচন। বঙ্গে শূন্য সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট। ব্যাপক করোনা পরিস্থিতিতে ভোট হয়েছে এই রাজ্যে। সেই করোনা আবহে সাধারণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া রেড ব্রিগেডই এখন দলের মূল সম্পদ। এই যুব বাহিনীর সঙ্গে সদ্য হওয়া রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের টিউনিং বঙ্গ সিপিএমকে রাজনৈতিক ফায়দা এনে দিতে পারে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। অভিজ্ঞ মহলের মতে, পাশাপাশি সংখ্যালঘু ভোট টানতে এবার সরাসরি 'গ্রিন সিগন্যাল' দিল সিপিএম।
তৃণমূল তথা সংখ্যালঘুদের একটা বড় অংশের দাবি, ২০২১-এ রাজ্যে সরকার গড়তে সংখ্যালঘু ভোটই ছিল মূল চাবিকাঠি। কিন্তু সংখ্যালঘুদের একাংশের ক্ষোভ, তা সত্বেও তৃণমূল বা রাজ্যের নানা স্তরে সংখ্যালঘুরা সেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না। ভোটজয়ের পর এই অংশ নিজেদের অবহেলিত মনে করছে। এবার সেলিমকে বঙ্গ সিপিএমের নেতৃত্বে এনে সরাসরি সংখ্যালঘুদের বার্তা দিল সিপিএম। অভিজ্ঞমহলের মতে, মুসলিম মুখ সামনে এনে বিজেপিকেও জানান দেওয়া হল যে, কে গেরুয়া শিবিরের মূল প্রতিপক্ষ। বামেদের একাংশ একটা সময় বলতে শুরু করেছিলেন বিজেপির সঙ্গে লড়াই করলে তৃণমূলকে সঙ্গে নেওয়া যেতে পারে। মূল শত্রু কে তা নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল। তবে সেলিম বরাবর মোদী-দিদি আঁতাতের অভিযোগ তুলে সরব হয়েছেন। সেলিম সম্পাদক হওয়ায় তৃণমূল ও বিজেপি দুই দলের বিরুদ্ধে লড়াই এবার জোরদার হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক মহল।
রাজ্য সম্মেলনের শেষ দিন সকাল পর্যন্ত শ্রীদীপ ভট্টাচার্যের রাজ্য সম্পাদক হওয়ার একটা সম্ভাবনা চাউড় হয়েছিল। যদিও শেষমেশ পলিটব্যুরো সদস্য সেলিমের ভাগ্যে শিকে ছেড়ে। সূত্রের খবর, দলে কথিত আছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রিয় পাত্র সেলিম। বাইরে না বের হলেও দলের অভ্যন্তরে এখনও যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে বুদ্ধবাবুর। ব্রিগেডের সভায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যাবেন কীনা তা নিয়ে দলকে এখনও ভাবতে হয়। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে বঙ্গ সিপিএম নেতৃত্ব এখনও মেনে চলে। এক্ষেত্রেও বুদ্ধবাবুর পরামর্শ রয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। সাধারণত সংগঠনের পদাধিকারী নির্বাচনে ডান-বাম কোনও দলই ভোটাভুটি চায় না। সেলিমের নাম আসায় এক্ষেত্রেও ভোটাভুটি এড়ানো গিয়েছে বলেই খবর। সর্বসম্মতিতে সম্পাদক হয়েছেন সেলিম।
আরও পড়ুন- অতীতের ঝলক! শূন্য থেকে শুরুর চেষ্টা, বঙ্গ CPIM-র আস্থা এই পঞ্চপাণ্ডবেই
এদিকে সূর্যকান্ত মিশ্রকে পরাজয়ের বোঝা নিয়ে সরতে হল। টানা পরাজয়, তাছাড়া ভোট শতাংশের ব্যাপক বিপর্যয়ে কার্যত হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল দলের একটা বড় অংশ। এখানে সিপিএমের আর কিছু হবে কী হবে না, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিল রাজনৈতিক মহল। তবে সাম্প্রতিক নির্বাচনে ভোটশতাংশের হার কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিজেপির থেকে এগিয়েছে দল। রাজনৈতিক মহলের বদ্ধমূল ধারণা, সংখ্যালঘু ভোট ঘরে আনতে না পারলে বঙ্গে সিপিএমের ক্ষমতায় আসা দূর অস্ত। সেখানে দাঁড়িয়ে একসময়ের সংখ্যালঘু দফতরের দায়িত্ব সামলানো সেলিমই এখন সিপিএমের সেরা বাজি। সিপিএম প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তাই এই প্রথম সংখ্যালঘু সম্পাদকের ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে দলকে।
ছাত্র রাজনীতিতেই হাতেখড়ি মহম্মদ সেলিমের। তারপর দীর্ঘসময় ডিওয়াইএফআইয়ের দায়িত্ব সামলেছেন। বাম আমলে রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্যও ছিলেন। রাজ্যসভা ও লোকসভা দুই কক্ষেরই সাংসদ ছিলেন সেলিম। বিগত লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে পরপর তৃতীয় স্থানে দৌড় শেষ করেছেন। বছর চৌষট্টির সেলিম চুটিয়ে যুব সংগঠন করেছেন, এখন দলের ছাত্র-যুবরাই তাঁর লড়াইয়ের মূল অস্ত্র বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। সেই লড়াইয়ের ফসল নির্বাচনে কতটা ঘরে তুলতে পারবে সিপিএম সেটাই এখন দেখার।
বিধানসভা ভোটের সময় চর্চা চলেছে, ভাইজানের আইএসএফের সঙ্গে জোট হয়েছে শুধু সেলিমের আগ্রহের জন্য। কিন্তু দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সমর্থন না থাকলে কখনও তা সম্ভব ছিল না বলেই মনে করে রাজনৈতিক মহল। অভিজ্ঞ মহলের মতে, তাছাড়া এনআরসি, সিএএ আন্দোলনের সময় সেলিম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। রাজ্যের সংখ্যালঘু নেতৃত্বের একটা বড় অংশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সুবিদিত। সিপিএমের অভিজ্ঞ বলিয়ে-কইয়ে নেতাদের মধ্যে অন্যতম সেলিম। এটা স্পষ্ট, সংসদীয় রাজনীতিতে শূন্য দলের হারানোর কিছু নেই, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আক্রমনাত্মক ঝুঁকির রাজনীতিতে গেল সিপিএম। 'নো রিস্ক নো গেইন।'