Advertisment

'এমনও তো হতে পারে, মমতাকে জেলে যেতে হল'

Exclusive: আসন্ন লোকসভা নির্বাচন, তৃণমূল সরকার, বিজেপির উত্থান এবং বামেদের 'ঘর ওয়াপসি' নিয়ে গৌতম দেবের বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারের প্রথম অংশ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
CPIM Leader Gautam Dev Exclusive Interview

মমতা বন্দ্যাপাধ্যায়ের বাড়িতে সিবিআই-এর চিঠি চলে গিয়েছে, দাবি গৌতম দেবের। এক্সপ্রেস ফটো।

২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে পালাবদলের নির্বাচনের আগে অনেকের মতে বামেদের দুর্গ একা রক্ষা করতেন তিনি। তাঁর ভোকাল টনিকেই নাকি বেঁচে ছিল পার্টি। আবার কারও মতে, তিনি ওসব বলতেন বলেই সিপিএম গো-হারা হেরেছিল। তবে প্রশংসা বা সমালোচনা যাই হোক, তাঁর অস্তিত্ব অস্বীকারের কোনও উপায় নেই। ইদানিং শারীরিক কারণে প্রচার মাধ্যমে তাঁর দেখা মেলে না খুব একটা। কিন্তু নানা সমস্যা নিয়েও দলের কর্মসূচিতে তিনি আজও নিয়মিত। প্রায় রোজই কোনও না কোন সভাতে বা বৈঠকে যাচ্ছেন। আর এর ফাঁকেই আসন্ন লোকসভা নির্বাচন, তৃণমূল সরকার, বিজেপির উত্থান এবং বামেদের 'ঘর ওয়াপসি' নিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র সঙ্গে কথা বললেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সিপিআই-এম নেতা গৌতম দেব।

Advertisment

বহুদিন পর রাজ্যে লাল ঝান্ডা হাতে কৃষক-ক্ষেত মজুরদের চোখে পড়ার মতো পদযাত্রা হল। কতটা উদ্বুদ্ধ করল এই সাড়া?

মানুষের দ্বারা নেতারা উৎসাহিত হন। এই মিছিলে বেশ কিছু মানুষ এসেছেন দেখে ভাল লাগছে। তবে এই সংখ্যক মানুষ দেখে যে আকাশ থেকে পড়েছি এমনটা নয়। এই মানুষগুলো আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। এর থেকে অনেক বেশি মানুষ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। ৮-৯ জানুয়ারির ভারত বনধ বা ব্রিগেডে এর থেকে অনেক বেশি মানুষ আসবেন।

পশ্চিমবঙ্গে এই বনধে সাড়া পড়বে? বর্তমান রাজ্য সরকারের ঘোষিত নীতিই তো বনধ বিরোধিতা। তাহলে?

দেখে নেবেন, এই রাজ্যেই বনধে বেশি সাড়া পড়বে। আর রাজ্য সরকার যদি এই ভারত বনধের বিরোধিতা করে তাহলে বুঝতে হবে তারা আপস করতে চাইছে।

আরও পড়ুন: "বিজেপি-র থেকে ১০০ কোটি টাকা নিয়েছেন প্রকাশ কারাট"

একদিকে বাম কৃষকদের মিছিল আপনাদের নেতৃত্বকে উৎসাহিত করছে, আর অন্যদিকে এই ডিসেম্বরেই মুর্শিদাবাদের নবগ্রামের সিপিএম বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারীর হাত থেকে পতাকা নিয়ে তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন। কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

(দৃশ্যতই অস্বস্তিতে গৌতম দেব। কিছুটা সামলে নিয়ে) সাধারণত, তৃণমূল আর কংগ্রেসের মধ্যে যাতায়াত লেগেই থাকে। কিন্তু, এ ধরনের ঘটনা যখন ঘটেছে তখন দলের অন্দরে এ বিষয়ে কথা বলতেই হবে। তবে বড় ব্যাপার হল, আমরা এখন তৃণমূল থেকে মানুষকে বুঝিয়ে সিপিএমে নিয়ে আসছি।

রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল ছেড়ে কর্মীরা আপনাদের দলে আসছেন?

হ্যাঁ আসছেন। আগে সিপিএম করতেন, এমন বহু মানুষ রাগ-অভিমান করে তৃণমূলে চলে গিয়েছিলেন। তাঁরা এখন চলে আসছেন। সকলে তো আর কায়েমি স্বার্থের জন্য তৃণমূলে যান নি। যাঁরা স্বার্থের জন্য গিয়েছেন, তাঁরা থেকে যাচ্ছেন। এর বাইরে অনেক সাধারণ মানুষ চলে গিয়েছিলেন, তাঁদের ফিরিয়ে আনছি আমরা।

অতীতের এই পার্টি দরদীরা সিপিএম-এর উপর রাগ-অভিমান করেছিলেন কেন?

তাঁরা হয়ত ভেবেছিলেন, পার্টি টাটাদের সঙ্গে বেশি মিশছে। এছাড়া কিছু গন্ডগোল তো ছিলই।

আপনার পার্টি কি সত্যিই টাটাদের সঙ্গে বেশি মেলা মেশা করেছে?

না করলেও, অন্তত সেরকমটাই প্রচার করা হয়েছিল। আর তাতেই মানুষের রাগ হয়েছে। এছাড়া, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে নানা বিচ্যুতি তো হয়েছেই।

অর্থাৎ, মান-অভিমানের পালা চুকিয়ে রাজ্য সিপিএম-এ এখন ঘর ওয়াপসি চলছে?

হ্যাঁ। পার্টি এই অংশটাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে। বুথ স্তর থেকে সংগঠন মজবুত করার জন্য সাধারণ কর্মীরা খুবই বড় ভূমিকা পালন করেন। তাই তাঁদের কথা শুনে, তাঁদের বুঝিয়ে দলে ফেরাতেই হবে।

আরও পড়ুন: মরুরাজ্যে খরা কাটিয়ে লালফুলের জোড়া

দীর্ঘদিন যাবৎ আপনাদের নাম আক্রমণ তালিকা থেকে মুছে দিয়েছিল ক্ষমতাসীন তৃণমূল। কিন্তু কৃষক পদযাত্রার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিশানায় ফিরে এলেন আপনারা। এটাকে কি সাফল্য হিসেবে দেখছেন?

মমতার কথা দিয়ে যদি সাফল্য বা ব্যর্থতা বিচার করতে হয়, তাহলে তো খুব মুশকিল। মমতা সম্পূর্ণ 'আনপ্রেডিক্টবল'। উনি পুরোপুরি নিজের হিসাবে চলেন। কখন সিবিআই চিঠি পাঠাবে, তার উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেন। ফলে, বলা খুব মুশকিল।

আপনি কী বলতে চাইছেন? সিবিআই-এর চিঠির উপর নির্ভর করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতি করেন?

হ্যাঁ। ওঁর বাড়িতে চিঠি চলে গিয়েছে। তিরিশের বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে চিঠি গিয়েছে ছবি বিক্রি নিয়ে।

কোন ছবি বিক্রির কথা বলতে চাইছেন?

ওই যে টাউন হলে যে ছবি বিক্রি করেছিলেন, সেই বিষয়েই চিঠি গিয়েছে। নিলামে কত টাকা উঠেছে জানতে চাওয়া হয়েছে। ৬ কোটি টাকা তো তৃণমূলের তহবিলে জমা করেছেন। আর আমার কাছে খবর আছে, ২০ কোটি টাকা উঠেছিল। বাকি টাকা কোথায় গেল?

আরও পড়ুন- ‘ঋতব্রত একটা না দুটো মহিলার সঙ্গে ফূর্তি করেছে, আর কী করে ভালবাসব?’

আপনার এই ব্যক্তিগত গোয়েন্দা সূত্রের মাধ্যমেই ২০১১-র ভোটের আগে আপনি রহস্য গল্পের মতো পোড়া কুপন দেখাতেন, ডেলোর বৈঠকের কথা বলতেন, এবং তৃণমূল যে ভীষণ একটা দুর্নীতি চালাচ্ছে সে কথা বলতেন। আপনাকে তখন ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং তাচ্ছিল্য করতেন বহু মানুষ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল আপনার কিছু ইঙ্গিত মিলে যাচ্ছে। কী বলবেন?

(দৃশ্যতই খুশি) দেখুন, আমরা তো আর ব্যক্তিগত আক্রমণের জন্য বলতাম না। হাতে নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ নিয়েই কথা বলতাম। এও বলেছিলাম, সাহস থাকলে আদালতে যাক, আমরা প্রমাণ করে দেব। এখন তো সব দেখাই যাচ্ছে। আরেকটা নতুন কথা বলতে চাই...

নতুন কথা মানে? আপনার গোয়েন্দা সূত্র কি আবার নয়া দুর্নীতির গন্ধ পেয়েছে?

হ্যাঁ। এই যে মমতা ব্যানার্জি বিদেশ সফরে যান, তা কার পয়সায়? কজন যান? বিদেশে সাত-দশ দিন থেকে, শিল্পোদ্যোগীদের সঙ্গে কটা মিটিং করেছেন? ক'ঘণ্টা শপিং করে কাটিয়েছেন? ক'ঘণ্টা খেয়ে কাটিয়েছেন? ট্রফি-উপহার কিনতে কতটা সময় কাটিয়েছেন? বিদেশে উনি কত টাকা খরচ করেছেন? প্লেনের পাইলটকে উনি উপহার দিচ্ছেন। পাইলটকে উপহার দেওয়ার কী আছে? উনি কি নিজেকে রাজা বা রানি মনে করেন? এই টাকাগুলো কে দিয়েছে? মমতা ব্যানার্জির যদি ক্ষমতা থাকে, তাহলে হিসাব দিন।

আরও পড়ুন: একা বিমান টেনে চলেছেন লাল রথ, ফের প্রমাণ করল বীরভূম

এটা একটু অদ্ভুত প্রশ্ন নয়? উপহার দেওয়া ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বা পছন্দ। এ বিষয়ে কি আপনি প্রশ্ন করতে পারেন?

আরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মাইনে পান মাত্র কয়েক হাজার টাকা। তিনি কোথা থেকে পাবেন এত টাকা?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর যাবতীয় আয় ব্যয়ের হিসাব নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছেন। তাও আপনি এই প্রশ্ন তুলছেন কেন?

না, না। নির্বাচন কমিশনে হিসাব জমা দেওয়ার পর তো সিবিআই ধরেছে। বাড়িতে চিঠি এসেছে। উনি বলছেন, ছবি বিক্রি করে টাকাটা উঠেছে। কিন্তু, এত টাকা উঠল কী করে?

রাজ্যে সিবিআই-কে আটকানোয় চন্দ্রবাবু নাইডুকে সমর্থন করছেন, অথচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই একই কথা বললে আপনারা ভিন্ন সুর। এটা কি দ্বিচারিতা নয়?

আপাতভাবে দু'রকম অবস্থান মনে হলেও আদপে তা নয়। আচ্ছা, কোথায় লেখা আছে যে সব বিষয়েই এক রকম মত প্রকাশ করতে হবে? আমি যদি জানি, কেউ সত্যিই চুরি করেছে, তাহলে সে কথা বলব না? (ক্রমশ উত্তেজিত হচ্ছেন, টেবিল চাপড়াচ্ছেন) মমতা সারদার টাকা নিয়েছেন, বড়লোকদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, এ বিষয়ে যদি আমি নিশ্চিত হই, তাহলে বলব না কেন?

আরও পড়ুন- ‘বুদ্ধিজীবীদের ওপর ভরসা করে রাজনীতি করা যায় না’

আচ্ছা, আপনার যুক্তি যদি মেনে নিই, তাহলেও একটা প্রশ্ন থাকছে। তৃণমূল-সিবিআই ইস্যুতে আপনাদের এমন পদক্ষেপে অ-বিজেপি বিরোধী ঐক্য কি দুর্বল হবে না?

আরে মমতা বিজেপি-বিরোধী থাকছেন কোথায়? মমতা তো মোদীর সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিতে নেমেছেন। তাছাড়া মাস কয়েক আগে মমতা অন রেকর্ড বলেছেন, মোদীর বদলে আডবাণী বা জেটলি বা সুষমা স্বরাজ প্রধানমন্ত্রী হোন, তাহলে সমর্থন দেব। ব্যক্তি মোদী একটা ফ্যাক্টর হলেও, সেটা বড় কথা নয়। মতাদর্শটাই আসল। ফলে এই যদি মমতার কথা হয়, তাহলে কী করে বিশ্বাস করব?

আরও পড়ুন: “আমাদের তো মোদী আছেন, ওদের?”

আপনি মতাদর্শের কথা বলছেন, অথচ রাজ্যে কৃষক মিছিলে মমতা সরকারকে আক্রমণ করছেন আপনারা, আর দিল্লির কৃষক পদযাত্রার মঞ্চে আপনাদের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে একসঙ্গে বক্তৃতা করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিনিধি দীনেশ ত্রিবেদী। এটা দু'রকম অবস্থান নয়?

কোথায় বলা আছে যে, রাজ্যে যা হবে, জাতীয় স্তরেও তাই হতে হবে? তাছাড়া পার্লামেন্টে ফ্লোর কো-অর্ডিনেশন হবে না, কোনও ইস্যুতে একসঙ্গে আলোচনা হবে না, এমনটা তো কোথাও ঠিক হয়নি। হতেই পারে।

তার মানে বিজেপির বিরুদ্ধে মমতার সঙ্গে একযোগে লড়তে আপনাদের মতাদর্শগত ছুঁতমার্গ নেই?

সে প্রশ্ন যখন আসবে তখন উত্তর দেব। প্রয়োজন হলে একসঙ্গে লড়তে হবে। কিন্তু, মমতাকে তো সে লড়াইয়ে পাবেন না। উনি তো বিজেপিকে সমর্থন জানানোর জন্য তলে তলে প্রস্তুত।

আরও পড়ুন- 'আমার অমিত শাহকে ফোন করার প্রয়োজন পড়ে না'

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি হাজতে ঢোকাচ্ছে, আর আপনি বলছেন মমতা বিজেপিকে সমর্থন করতে প্রস্তুত!

নিশ্চয়ই তাঁরা কিছু করেছিলেন তাই জেলে যেতে হচ্ছে। আরে বাবা, কেসের তো একটা স্বাভাবিক চলন থাকে। সেই জন্যই এসব হচ্ছে। যদি ধরপাকড় ঠিকভাবে চলে, তাহলে আর আঁতাতের কথা বলব না। এমনও তো হতে পারে, মমতাকে জেলে যেতে হল। সেদিন আর বলব না।

পড়ুন, গৌতম দেবের বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারের শেষ কিস্তি 

Mamata Banerjee CPIM
Advertisment