জরুরি অবস্থার প্রতিবাদে যাঁরা মুখর হয়েছিলেন, সে তালিকার শুরুতেই থাকবে জর্জ ফার্নান্ডেজের নাম। সে সময়ে দেশের অন্যতম ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ছিলেন তিনি।
প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সস্পর্ধিত ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছেন বারবার। জরুরি অবস্থার শেষে ১৯৭৭ সালে গঠিত মোরারজি দেশাই সরকারের শিল্পমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন, ১৯৮৯-৯০-এ ভিপি সিং সরকারের সময়ে তিনি ছিলেন রেলমন্ত্রী এবং ১৯৯৮-২০০৪-এর বাজপেয়ী সরকারের সময়ে তিনি ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
আরও পড়ুন, প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজের জীবনাবসান
১৯৩০ সালের ৩ জুন ম্যাঙ্গালোরে এক রোমান ক্যাথলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জন্মের দিনই তাঁর মা রাজা পঞ্চম জর্জের অনুকরণে তাঁর নাম রেখেছিলেন জর্জ।
ফার্নান্ডেজের কিশোরবেলা কেটেছে সংঘাতের মধ্যে দিয়েই। যে সেমিনারিতে ক্যাথলিক যাজক হওয়ার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, সে জায়গা ছেড়ে কাজের খোঁজে বম্বেতে যখন পৌঁছন, তখন তাঁর বয়স ১৮। সে সময়ে তাঁর রাত কেটেছে রাস্তায়, দিনের বেলাগুলো হোটেলে কাজ করতেন তিনি।
সে সময়েই সমাজবাদী নেতা রাম মনোহর লোহিয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পড়েন জর্জ। জড়িয়ে পড়েন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে এবং সোশালিস্ট পার্টির সঙ্গেও। সেই তাঁর রাজনীতিযাত্রার শুরু।
৫-এর দশকে হোটেল ও রেস্তোরাঁয় কর্মরত শিল্পশ্রমিকদের অধিকারের দাবিতে সরব হন তিনি। একই সঙ্গে হয়ে ওঠেন ট্যাক্সিচালক ইউনিয়নের পোস্টার বয়। .
১৯৬৭ সালের সাধারণ ভোটে কংগ্রেস নেতা এস কে পাটিলকে হারিয়ে রাতারাতি জাতীয় ক্ষেত্রে পরিচিত নাম হয়ে ওঠেন তিনি। জায়েন্ট কিলার হিসাবে নাম হয়ে যায় তাঁর।
১৯৭৪ সালে দেশ জোড়া রেলকর্মীদের ধর্মঘট ছিল তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারের অন্যতম মুখ। জর্জ ফার্নান্ডেজ যখন সারা ভারত রেলওয়েমেন্স ফেডারেশন (AIRF)-এর সভাপতি। কর্মক্ষেত্রের দুরবস্থার দূর করার জন্য শ্রমিকদের সে ধর্মঘট চলেছিল ২০ দিন ধরে। সে ধর্মঘটের জেরে সারা দেশ অচল হয়ে পড়েছিল।
ইন্দিরা গান্ধীর প্রবল সমালোচক জর্জ ফার্নান্ডেজ জরুরি অবস্থা চলাকালীন, ১৯৭৬ সালে গ্রেফতার হন। তাঁর বিরুদ্ধে রেল ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এ মামবা বরোদা ডিনামাইট ষড়যন্ত্র বলে পরিচিত হয়ে আছে। হাতে হাতকড়া, পায়ে শিকল বাঁধা জর্জ ফার্নান্ডেজ ও তাঁর অনুগামীরা পুলিশ প্রহরা জেলে চলেছেন, এই ফোটো তখন ঘরে ঘরে দেখা যেত।
জরুরি অবস্থার গোটা সময়টাই তাঁকে জেলে কাটাতে হয়। এমনকি ১৯৭৭ সালের লোকসভা ভোটের সময়েও তাঁকে ছাড়া হয়নি। তা সত্ত্বেও, জেল থেকেই ভোটে লড়ে মুজঃফরপুর লোকসভা কেন্দ্রে জিতে যান জর্জ। ফের একবার হয়ে ওঠেন পোস্টার বয়। এবার জনতা পার্টির।
মোরারজি দেশাই তাঁর হাতে শিল্পমন্ত্রকের দায়িত্ব তুলে দেওয়ার পরেপরেই কোকা কোলা এবং আইবিএম-কে ভারত ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিলেন তিনি। ভিপি সিং মন্ত্রিসভায় রেলমন্ত্রী হিসেবে কাজ করার সময়কেও মানুষ মনে রাখবেন। সে আমলেই সূচনা হয়েছিল কোঙ্কণ রেলের।
১৯৯৮ সালে পোখরানে ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষা এবং কার্গিলের যুদ্ধ হয়েছিল ফার্নান্ডেজ প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকার সময়ে। তখন বাজপেয়ী সরকারের আমল। কিন্তু ফার্নান্ডেজের রাজনৈতিক জীবনের ট্র্যাজিক অধ্যায় ২০০৪ সালে, যখন কফিন গেট কেলেঙ্কারির জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পদ থেকে তাঁকে ইস্তফা দিতে হয়।
তবে দুটি তদন্ত কমিশন তাঁকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়। বারাক মিসাইল কেলেঙ্কারি এবং তেহলকা কাণ্ডেও তাঁর নাম উঠেছিল। ২০০৯-১০ সালে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে শেষবার তাঁকে সংসদে দেখা গিয়েছিল। তবে অ্যালঝাইমার্সের কারণে ক্রমশ জনজীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন তিনি।