নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও এনআরসি বিরোধী আন্দোলনকে গণঅন্দোলনে পরিণত করতে মরিয়া তৃণমূল সুপ্রিমো। নতুনভাবে বিরোধী নেত্রীর অবতারে নজর কাড়তে শুরু করেছেন তিনি। কলকাতা থেকে জেলা, বিক্ষোভ মিছিল থেকে সভা-সমাবেশ সব কর্মসূচিতেই সামনের সারিতে মমতা। মোদী সরকারের নয়া আইনের বিরুদ্ধে জাতীয় রাজনীতিতে বিরোধীদের জোট বাঁধার ডাক দিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। ক্রমশ স্পষ্ট, বিজেপি বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
Advertisment
সিএএ ঘিরে দেশজুড়ে প্রতিবাদ তীব্র হয়েছে। কলকাতা সহ বিভিন্ন জেলায় বৃহৎ আকারে মোট ৯টি পদযাত্রা ও সভা করেছে জোড়াফুল শিবির। এর প্রত্যেকটির নেতৃত্বে দেখা গিয়েছে মমতাকেই। মিছিল-মিটিং করেই শেষ হয়নি। আন্দোলনের ঝাঁঝ আরও গাঢ় করতে পড়ুয়া থেকে সাধারণ মানুষকে নির্ভয়ে বিক্ষোভে শামিল হতে অভয় দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এরপর সংসদে ক্যাব নিয়ে ভোটাভুটিতে বিরুদ্ধে ভোটও দিয়েছে বাংলার শাসক দলের সাংসদরা।
'প্রাণ থাকতে বাংলায় সিএএ-এনআরসি লাগু হবে না' বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন রাজ্যের শাসক দলের নেত্রী। এরাজ্যে, ইতিমধ্যেই এনপিআর স্থগিত করে দিয়েছে নবান্ন। ডিটেশন ক্যাম্প ঘিরে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। মমতা সাফ ঘোষণা করেছেন, বাংলায় কোনও ডিটেনশন ক্যাম্প হবে না। প্রতিটি পদযাত্রা বা সভায় নিয়ম করে এখন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। কেন্দ্র বিভেদের রাজনীতির স্বার্থেই সিএএ-এনআরসি করে ভারত ভাগের চক্রান্ত করছে বলে দাবি করেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। কেন ফের নাগরিকত্বের প্রমাণ দেবেন দেশবাসী, এই প্রশ্নই তুলেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।
Advertisment
মমতার মহামিছিল। ছবি: শশী ঘোষ।
'বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য' ভারতের সংস্কৃতি। বাংলা এই ঐতিহ্যের অন্যতম আধার বলে বিবেচিত হয়। দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতা। সব ধর্মের মানুষ এ রাজ্যে মিলেমিশেই থাকেন। ফলে রাজ্যের এই বিশেষ দিকটিকেই মোদী বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে পুঁজি করতে চাইছে তৃণমূল। কলকাতা থেকে জেলা, গত কয়েকদিনে যেখানেই সিএএ বিরোধী মিছিল করেছেন মমতা, সেখানেই সর্বধর্মের প্রতিনিধিকে লক্ষ্য করা গিয়েছে। বারে বারে নেত্রীর মুখে উঠে এসেছে বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজী, মহাত্মা গান্ধী, বিদ্যাসাগর, রামমোহনের নাম। ধর্ম নিরপেক্ষতার বার্তা দিতে কলকাতায় দলের মিছিল কখনও ধর্মতলা থেকে জোড়াসাঁকো, আবার কখনও বিবেকানন্দের বাড়ি থেকে বেলাঘাটায় গান্ধী ভবন পর্যন্ত গিয়েছে। স্বয়ং নেত্রী কাঁসর বাজিয়েছেন। 'ক্যা...ক্যা...ছিঃ! ছিঃ!' রবও তুলেছেন। পুরুলিয়াতেও আদিবাসীদের বার্তা দিতে এবং সর্ব সংস্কৃতির চিত্র তুলে ধরতে বেজেছে ধামসা মাদল।
এছাড়া, সহমর্মিতা জানাতে ম্যাঙ্গালোরে সিএএ প্রতিবাদের জেরে নিহতদের পরিবারকে তৃণমূল আর্থিক সাহায়তা করেছে। উত্তরপ্রদেশে নিহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তৃণমূলের প্রতিনিধিরাও। অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক পথে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে যে তৃণমূল সবার পাশে থাকবে সেই বার্তাও ইতিমধ্যে পৌঁছে দেওয়া গিয়েছে।
নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় বাংলার নানা এলাকায় হিংসা ছড়িয়ে পড়েছিল। মুর্শিদাবাদে তা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। এ সময় শান্তিপূর্ণ পথে আন্দোলন করার আবেদন জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লিতে পড়ুয়াদের আন্দোলন রুখতে পুলিশ দমনপীড়ন চালিয়েছে বলে অভিযোগ। কিন্তু, মমতার আশ্বাস, গণতান্ত্রিক পথে পড়ুয়ারা বিক্ষোভ আন্দোলন করলে তাঁদের ভয়ের কোনও কারণ নেই। অর্থাৎ, কেবল দলগতভাবেই নয়, মোদী সরকার বিরোধিতায় পড়ুয়াদেরও আন্দোলনে এগিয়ে দিতে সাহস যোগাচ্ছেন ছাত্র আন্দোলন থেকে রাজনীতিক ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছানো নেত্রী।
এদিকে মমতা যখন একের পর এক আন্দোলন করছেন, তখনই রাজ্যে সিএএ-র পক্ষে প্রচার করছে বিজেপি। স্বারাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি উড়িয়ে রাজ্য বিজেপি সভাপতি বলছেন, বাংলায় এনআরসি হওয়ার প্রয়োজন। আর তাতেই মোদী সরকারের এনআরসি সংক্রান্ত অবস্থান ঘিরে বিভ্রান্তি বাড়ছে। যদিও গেরুয়া শিবির বলছে, রাজনৈতিক স্বার্থে সিএএ-এনআরসি নিয়ে মিথ্যা রটাচ্ছে জোড়াফুল শিবির।
এমতাবস্থায় ক্রমশ স্পষ্ট যে ফের একবার জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে মোদী বিরোধীতায় কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠছেন মমতা। সৌজন্যে, সিএএ-এনআরসি প্রতিবাদ। এই বিরোধিতা ২০২১-এর আগে দলকে ডিভিডেন্ট দেবে বলেই আশা তৃণমূল নেতৃত্বের।