নেত্রীর অপমান ও সতীর্থদের ব্যক্তি আক্রমণের কথা তুলে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মন্ত্রিত্ব ছাড়ার কথা জানালেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার সকালে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ইস্তফা জমা দেন তিনি। একই সঙ্গে এদিন রাজভবনে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের কাছে গিয়েও ইস্তফাপত্র পেশ করেন। জানা গিয়েছে শুক্রবারই তৃণমূল কংগ্রেসের সাংগঠনিক সব পদ ও দল থেকেও পদত্যাগ করবেন তিনি। শুভেন্দু অধিকারী, লক্ষ্মীরতন শুক্লার পর গত একমাসে তিনজন মন্ত্রী মমতা মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিলেন।
রাজভবন থেকে বেড়িয়ে এসে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'আমি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু আড়াই বছর আগে আচমকা দফতর বদল করে দেওয়া হয়েছিল। অত্যন্ত খারাপ লেগেছিল। সেই সময় ন্যূনতম সৌজন্যটুকুও দেখাননি মুখ্যমন্ত্রী। মন্ত্রী হিসেবে উত্তরবঙ্গে বৈঠক করছিলাম তখন। টিভিতে ব্রেকিং নিউজ দেখে জানতে পেরেছিলাম, আমার দফতর বদল হয়েছে। সে দিনই ইস্তফা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উনিই নিরস্ত করেছিলেন। আমি ওইটুকুনি সৌজন্য আশা করেছিলাম। তারপর আমাকে যখন যে দফতরে কাজ করতে বলেছেন সেটা করেছি। আর গত কয়েক মাস ধরে ক্রমাগত আমায়, আমারই কিছু সতীর্থ ব্যক্তি আক্রমণ করেছেন। আমি পাল্টা কাউকে আঘাত করিনি। এত আঘাত না পেলে হয়তো এমন সিদ্ধান্ত নিতাম না। গত একমাস ধরে দ্বন্দ্বে ভুলছিলাম। আমি ভাবিনি এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদিও শেষ পর্যন্ত নিতেই হল।' মন্ত্রিত্ব ছাড়ার কারণ জানাতে গিয়ে এদিন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়।
তার আগে শুক্রবার সোশাল মিডিয়ায় নিজের ইস্তফাপত্র পোস্ট করে মমতা মন্ত্রিসভা থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা প্রকাশ্যে আনেন ডোমজুড়ের বিধায়ক। এদিন সকালে রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ইস্তফাপত্র পাঠিয়েছেন রাজীব। তাতে ইস্তফার কোনও কারণ ব্যাখ্যা না করলেও চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে, রাজ্যের মানুষের জন্য কাজ করতে পারার সুযোগ পেয়ে অত্যন্ত গর্বিত তিনি। এজন্য কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছেন।
রাজীবের ইস্তফাকে অবশ্য গুরুত্ব দিতে নারাজ তৃণমূল নেতৃত্ব। তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, 'মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের ইঞ্জিন। কে খোথায় গেল তাতে দলের কিছু যায় আসে না। বট গাছ থেকে দু-একটা পাতা ঝরতেই পারে। দলের কর্মীরা কেউ যাচ্ছেন না।'
গত কয়েকমাস ধরেই রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। তৃণমূলের অভ্যন্তরে যে তাঁর কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে, তাও জনসমক্ষে জানিয়েছেন বনমন্ত্রী। বলেছিলেন, ‘স্তাবকতা করলেই নম্বর বাড়ে। ভালকে খারাপ, খারাপকে ভাল বলতে পারি না, তাই আমার নম্বর কম। অন্যদের বেশি। এমন কিছু লোক দলের নেতৃত্বে রয়েছেন যাঁদের মানুষ পছন্দ করে না। কিন্তু তাঁরাই এখন দলীয় সংগঠেনর শীর্ষে রয়েছেন।' এর মধ্যেই রাজ্য মন্ত্রিসভার গত চারটি ক্যাবিনেট বৈঠকেও অনুপস্থিত ছিলেন তিনি।
এর পরপরই 'বেসুরো' রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে নানা জল্পনা শুরু হয়। অস্বস্তি বাড়ে শাসক দল তৃণমূলের। পরে বনমন্ত্রীর সঙ্গে বেশ কয়েকবার তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যেয়র বৈঠক হয়। প্রতিবারই বৈঠক শেষে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, দলের বেশ কিছু বিষয় নিয়ে তাঁর ক্ষোভ অসন্তোষ রয়েছে। যা দলীয় নেতৃত্বকে বলেছেন। কিন্তু সেসবে যে কার্যত কোনও কাজ হয়নি তা এদিন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইস্তফা থেকে স্পষ্ট।
আরও পড়ুন- তৃতীয়বারের জন্য মমতার দখলে বাংলা: জনমত সমীক্ষা
দলের মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকের পরও অবশ্য তাঁর ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। গত সপ্তাহেই ফেসবুক লাইভে নাম না করলেও দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছিলেন, ”এখনও ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি। ধৈর্য ধরে আছি, ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছি। দলনেত্রীও কাজের কথাই বলেন। কিন্তু যখন কাজ করতে গিয়ে বাধা পাই, তখন খারাপ লাগে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। দুঃখ লাগে যে, কিছু নেতা আছে, যখন দিশা দেখাতে চাইছি তখন তারা সেটাকে সমালোচনা করছে।”
ফলে, রাজীবের তৃণমূল ত্যাগের জল্পনা ক্রমশ জোড়াল হতে থাকে। কিন্তু এতদিন রাজীববাবু নিজের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট না করলেও শুক্রবার রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেন তিনি। উল্লেখ্য, গত বুধবারই চন্দননগরের জনসভা থেকে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী 'বেসুরো' রাজীবকে গেরুয়া শিবিরে অহ্বান জানিয়েছেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন