নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে চিন্তিত নন মুসলিমরা। এই বিল পাস হওয়ায় মোটেই ভয় পাননি মুসলিমরা। সিএএ বিক্ষোভ ঘিরে যখন উত্তাল গোটা দেশ, ঠিক সেই আবহে এমন কথাই জানালেন ফুরফুরা শরিফের ত্বহা সিদ্দিকি। সাধনা নিউজ-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একদিকে যেমন মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকারকে চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করেছেন পীরজাদা, তেমনই ‘মমতা সরকার আসার পরেই পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়েছে’ বলে তোপ দেগেছেন তিনি।
‘সিএএ ইস্যুতে মুসলিমরা চিন্তিত নন’
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন প্রসঙ্গে ত্বহা সিদ্দিকি বলেন, ‘‘আমি বাংলায় শান্তিতে আছি। আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে যে বাংলাদেশে যাব? এখানকার মুসলিমরা কেন যাবেন বাংলাদেশে? তাঁরা তো এখানকারই বাসিন্দা। কেন আমার সুন্দর বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাব? আমার ভারতবর্ষ তো শান্তির জায়গা। সত্যিকারের যাঁরা ভারতবাসী, যাঁরা বাংলাবাসী, তাঁরা এখানে বঞ্চিত। ওপার বাংলা থেকে সকলে আসেননি, একটা পরিবারের দু’জন আসেন। দু’জনকে সরকার তাঁদের সুবিধা দিয়েছে। ওখানেও দিয়েছে। বাংলাদেশের (সংখ্যালঘু) মানুষকে সে দেশের সরকার কেমন নিরাপত্তা দিয়েছে, দেখবেন। আবার এদিকে এসেও সুবিধা নিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু, যাঁরা ভারতীয় মুসলিম, বাঙালি মুসলিম, বাঙালি হিন্দু, যাঁরা এদেশের, তাঁরাই কিন্তু বঞ্চিত। এই বিল (ক্যাব) পাস করা হল বলে মুসলিমরা চিন্তিত নন। আমরা এই যে হিন্দু-মুসলমান বিক্ষোভ করছি তা কিন্তু মুসলমানরা ভয় পাচ্ছে বলে করছে, এমনটা নয়। যাতে এপার বাংলায় যাঁরা আছেন (হিন্দু-মুসলিম উভয়কেই), তাঁদের তকমা মেরে বাংলাদেশে না পাঠানো হয়, সে জন্যই এই প্রতিবাদ। এখানে যাঁরা হিন্দু-মুসলিম আছি, আমরা বাঙালি ভারতীয়। কেন হইহই করব? এই সরকারকে বিশ্বাস নেই। পাসপোর্ট থাকলেও ছিঁড়ে দিয়ে কোনও স্ট্যাম্প মেরে দেবে’’।
আরও পড়ুন: ‘একুশে বাংলায় তৃণমূল সরকার, কারণ ভাই-বোনের লড়াই বাহ্যিক’
বিজেপিকে নিশানা ত্বহা সিদ্দিকির
নাগরিকত্ব আইন ইস্যুতে বিজেপিকে আক্রমণ করে ফুরফুরা শরিফের প্রধান বলেন, ‘‘অত্যন্ত দু:খের সঙ্গে বলছি, ভারতের আজ যা পরিস্থিতি তা আমরা কখনও আশা করিনি। বিজেপি সরকার আসার আগে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে শান্তিতে ছিলাম। সিপিএম, তৃণমূল, কংগ্রেস রাজনীতি করে। কিন্তু এরা ধর্মকে নিয়ে খেলে না। ভারতের মধ্যে একমাত্র রাজ্য, যেখানে সম্প্রীতি, একতা, ভ্রাতৃত্ব আছে, তা হল পশ্চিমবঙ্গ। রামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এঁদের অবদানে সম্প্রীতির রাজ্য হয়েছে বাংলা। দেশে এমন একটা দল (বিজেপি) এসেছে যে দল দেশের উন্নয়ন নিয়ে ভাবছে না, দেশে বেকারত্ব কীভাবে দূর হবে তা নিয়ে চিন্তা নেই। সরকারের একটাই লক্ষ্য, একটাই উদ্দেশ্য, হিন্দু-মুসলমান বিভাজন করে ভোটব্যাঙ্ক ভাগ’’।
src="https://www.youtube.com/embed/bv9O62uDx8c" width="100%" height="415" frameborder="0" allowfullscreen="allowfullscreen">
‘তৃণমূল-বিজেপি গট-আপ’
পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি বলেন, ‘‘শুধু আমরাই নই, বাংলার মানুষ বিজেপি সরকারকে বিশ্বাস করতে পারেন না। এবার প্রশ্ন উঠবে, বিশ্বাস না হলে (বিজেপি) ক্ষমতায় এল কী করে? ১৮টি আসন পেল কী করে? কীভাবে আসন পেল? কোনও গট-আপ হয়েছে কিনা জানতে হবে। মেশিনের (ইভিএম) কারসাজি হয়েছে কিনা জানতে হবে। মনে প্রাণে এই সরকারকে কেউ বিশ্বাস করে না’’। এরপরই ফুরফুরা শরিফের প্রধান বলেন, ‘‘বাংলার হিন্দু-মুসলিম সকলে বলছেন, সিপিএম চলে গিয়েছে। সিপিএমের একশটার মধ্যে নিরানব্বইটা দিকই খারাপ। কিন্তু, একটা গুণ ছিল। সিপিএম কিন্তু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে জায়গা দেয়নি। কিন্তু, আজ পশ্চিমবাংলায় যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সেই সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়েছে। এই সরকারের সাম্প্রদায়িক শক্তিকে দমন করার ক্ষমতা কম। আজ ১৮টা আসন পেল কী করে? ভাবা যায়! আজকে এই ১৮টি আসনের পিছনে কোনও কারণ আছে কিনা, বাংলার মানুষ ভাবছে। তৃণমূল-বিজেপি গট-আপ থাকতে পারে’’।
আরও পড়ুন: ‘ভোটার আইডি-রেশন কার্ড লাগবে না’, তাহলে কীভাবে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে? জানালেন দিলীপ ঘোষ
এ প্রসঙ্গে ত্বহা সিদ্দিকি আরও বলেন, ‘‘কিছুদিন আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লিতে গেলেন। একদল মানুষ বলেছিলেন, রাজীব কুমারকে বাঁচাতে যাচ্ছেন। আরেক দল বলেছিলেন, নিজের কোমরের দড়ি খুলতে যাচ্ছেন, ভাইপোর কোমরের দড়ি খুলতে যাচ্ছেন। কিন্তু এখন একদল মানুষ বলছেন, রাজীবকে বাঁচাতে যাননি, নরেন্দ্র মোদী একের পর এক বিল পাস করাবে, খামোশ খেতে বলেছে, তিনতালাক বিল যখন পাস করানো হয়, এই সরকারের সাংসদরা (তৃণমূল সাংসদ) ওয়াকআউট করেন। ৩৭০ ধারা যখন পাস হয়, তখনও সংসদের বাইরে বেরিয়েছিলেন সাংসদরা (তৃণমূল সাংসদ)। সিএবি বিল পাস হল যখন, ৬-৮ জন সাংসদ সংসদেই যাননি। তাতেই সন্দেহ হচ্ছে গট-আপ চলছে’’।
তবে নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে পথে নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তাতে ‘খুশি’ ত্বহা সিদ্দিকি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী, ওঁর আরেকটা দিক রয়েছে। ভারতবর্ষের কোনও মুখ্যমন্ত্রী সিএএ নিয়ে পথে নামেননি। এটা কিন্তু স্বীকার করতে হবে যে উনি পথে নেমেছেন। এতে খুব খুশি। মমতার পথে নামার পরও মানুষ প্রতিবাদ বন্ধ করেনি, তবে উগ্র প্রতিবাদ কমেছে। অবশ্য এ জন্য মমতার একার কৃতিত্ব নেই। বাংলার হিন্দু-মুসলিম ধর্মগুরুদের বিবৃতিও কাজে লেগেছ। যতদিন বিল সংশোধন না করছে, প্রতিবাদ করতে হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে’’।
আরও পড়ুন: ‘মুসলমানরা নেই কেন?’, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে প্রশ্ন তুললেন বিজেপি নেতা-নেতাজির পৌত্র
‘জয়শ্রী রাম ধ্বনি ফিকে হয়ে গিয়েছে’
ফুরফুরা শরিফের প্রধান বলেন, ‘‘কিছুদিন আগে জয় শ্রীরাম ধ্বনি খুব উঠেছিল। মুসলিম দাড়িওয়ালা-টুপিওয়ালা দেখলেই কিছু মানুষের মুখে আসে জয় শ্রীরাম ধ্বনি। আমি হিন্দু-মুসলমান সকলের সঙ্গে মেলামেশা করি। অনেকে আমার বন্ধু। জানি, হিন্দু ভাইরা দুগ্গা মাইকি জয় বলেন, কালী মাইকি জয় বলেন। অথচ এখন সব কালচার চলে গিয়ে শুধু জয়শ্রী রাম! এখন আবার এই আওয়াজ ফিকে হয়ে গিয়েছে। কারণ, বাঙালিদের সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি দিয়ে ব্রেনওয়াশ করতে পারেনি। এখন নতুন চাল চেলেছে এনআরসি। যখনই এনআরসির কথা উঠল, তখনই বড়মার এলাকায় পথ অবরোধ, ট্রেন অবরোধ হল। হিন্দু ভাইরা খেপে গেল, মুসলিমভাইরাও সঙ্গ দিল। তখন যিনি (দিলীপ ঘোষ) গরুর দুধ দিয়ে সোনা বের করছেন, উনি হঠাৎ বললেন, বাংলায় ২ কোটি বাংলাদেশি আছে, তাঁদের ঘাড় ধরে বের করে দেব। মানুষ তখন ক্ষেপে গেল। বিদ্রোহ করতে শুরু করল। এবার দেখল, জিনিসটা উল্টে গেল। তখন বললেন, বাংলাদেশ থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের শরণার্থী করা হবে। মুসলমানদের উদ্বাস্তু হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। অমিত শাহ কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা নিয়ে সংসদে বলেছিলেন, এক দেশ এক আইন। যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একথা বলছেন, সেই তিনিই কী করে বলতে পারেন, বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু-খ্রিস্টানদের জন্য শরণার্থী, আর মুসলিমদের (নাগরিকত্ব) দেওয়া হবে না। এক দেশ, এক আইন কী করে হল! বাংলার হিন্দু-মুসলমানদের ব্রেনওয়াশ করতে পারেনি। এরা জানে, এঁদের শরণার্থীর সার্টিফিকেট নেওয়ার দরকার নেই। কারণ, আমরা ভারতীয়। আমরা ভোট দিই, রেশন কার্ড আছে। হিন্দু ভাইদের আনন্দ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তাঁরা আনন্দিত হননি। কারণ, অন্য কিছুতে বাঁধবে আমাদের। যখনই আমি শরণার্থীর সার্টিফিকেট আনতে যাব, তখনই আমার মুখ দিয়ে বের করে নেওয়া হবে আমি বাংলাদেশি কিনা। আপনার বাবা কত সালে এসেছে, মা কত সালে এসেছেন? এরপর ওই ব্যক্তিকে কীভাবে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে, এটা একটা অন্য ফন্দি’’।
‘প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুঙ্গি পরেন না?’
মোদীর 'পোশাক দেখেই চেনা যায়' মন্তব্য প্রসঙ্গে ত্বহা সিদ্দিকি বলেন, ‘‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিন্দু-মুসমান ভাগ করতে করতে পোশাক ভাগ করছেন। পোশাক দেখে নাকি চেনা যায়! লুঙ্গি, টুপি পরে আছে বলে মুসলমান! যাঁরা টুপির ব্যবসা করছেন, তাঁরা এবার পয়সা লুটেছেন। এই মন্তব্যের পর অনেক টুপি অমুসলিমরাও কিনেছেন। টুপি কিনে মাথায় দিয়ে লুঙ্গি পরে প্রতিবাদ করেছে। ওঁদের একাংশ আবার মুসলিমদের বদনাম করার চেষ্টাও করছেন। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুঙ্গি পরেন না? আমরা দিনরাত পরি। যাঁরা এ ধরনের কাজ করে, তাঁরা রাতে পরেন। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য প্রত্যাহার করা উচিত’’।