রাজ্যে চারটে পুরনিগমে ভোটগ্রহণের বাকি আর মাত্র ১২ দিন। প্রচার চলছে জোরকদমে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিনই করোনা বিধিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোয় অভিযুক্ত তৃণমূল কংগ্রেস, বাম ও বিজেপি প্রার্থীদের একটা বড় অংশ। তৃণমূল প্রার্থীদের এমনও দাবি, 'আমি তো আর এত লোককে আসতে বলিনি।' ভাবটা এমন যেন হেমিলটনের বাঁশিওয়ালা। তবে শনিবার তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তিগত মতামত দিতে গিয়ে করোনা আবহে ভোট নিয়ে যে কথা বলছেন তাতে তোলপাড় রাজনৈতিক মহল। দলের সেই পথ অনুসরণ করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
বিধাননগর, আসানসোল, চন্দননগর ও শিলিগুড়িতে পুরভোটের প্রচার চলছে। আগামি ২৭ ফেব্রুয়ারি রাজ্যের বাকি পুরসভাগুলিতে ভোট হওয়ার কথা রয়েছে। ইতিমধ্যে রাজ্যে করোনা সংক্রমিত হচ্ছে হুহু করে। এই অবস্থায় পুরভোট স্থগিত করতে হাইকোর্টে মামলা চলছে। এখনও পর্যন্ত তৃণমূল কংগ্রেস চার পুরনিগমের ভোট পিছানোর কথা বলেনি। বরং কেন ভোট হবে না, তা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের নানা স্তরের নেতৃত্ব জোরালো সওয়াল করেছেন। সেখানে দলের সাধারণ সম্পাদক তথা ডায়মন্ডহারবারের সাংসদ নিজের সংসদীয় এলাকায় ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সামাজিক সভা-সমাবেশ করতে নিষেধ করেছেন। একই রাজ্যের একটি সংসদীয় এলাকায় কড়া বিধিনিষেধ, এটা লক্ষ্যনীয় বিষয়। এদিকে এই জেলার থেকে অন্য বেশ কয়েকটি জেলায় সংক্রমণ তীব্র আকার নিয়েছে। সেখানকার তৃণমূল সাংসদরা এদিন অভিষেকের ঘোষণার পর কী সিদ্ধান্ত নেন সেদিকে নজর রেখেছে রাজনৈতিক মহল।
আরও পড়ুন- ‘আগামী দু’মাস সব কর্মসূচি বন্ধ হোক’, করোনা আবহে ভোট প্রসঙ্গে বললেন অভিষেক
উল্লেখ্য, করোনা সংক্রমণে দক্ষিণ ২৪ পরগনার থেকে একাধিক জেলার হাল বেশ খারাপ। শনিবার রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের হিসেব অনুযায়ী কলকাতা বাদে বাকি জেলাগুলির মধ্যে এগিয়ে উত্তর ২৪ পরগনায় ৩,২৮৬ জন সংক্রমিত হয়েছে। হাওড়া ও পশ্চিম বর্ধমানে দৈনিক সংক্রমণ ১ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। হাওড়ায় ১,৪৮৩ ও আসানসোলে ১০০৬। হুগলিতে সংক্রমিতের সংখ্যা ৮৮১ ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৮৭৮। এরপরই রয়েছে বীরভূম ও পূর্ব বর্ধমান জেলা। সেক্ষেত্রে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাজুড়ে নয়, শুধু ডায়মন্ড হারবার সংসদীয় জেলায় কড়া বিধিনিষেধ! সব থেকে বড় বিষয় উত্তর ২৪ পরগনার সংক্রমণের হার কলকাতার পরেই। ডায়মন্ডহারবারের সংসদীয় কেন্দ্রে থেকে অনেক বেশি সংখ্যক পুরসভা রয়েছে উত্তর ২৪ পরগনায়। অভিজ্ঞ মহলের মতে, বাকি জেলাগুলির দলীয় সাংসদদের তৃণমূলের অন্যতম শীর্ষ নেতার সিদ্ধান্তে অনুপ্রাণিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
‘কোনও একটি রাজনৈতিক দলকে খুশি করার জন্য নির্বাচন করা ঠিক নয়। আগামী দু’মাস সব রাজনৈতিক, ধর্মীয় কর্মসূচি বন্ধ রাখা হোক। তবে এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। এভাবেই অভিষেক করোনা আবহে ভোট নিয়ে মতামত দিয়েছেন। অভিজ্ঞ মহলের মতে, দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ্যে ব্যক্তিগত মতামত দিলেও তার গুরুত্ব রয়েছে। ওই মহলের প্রশ্ন, বৃহত্তর ক্ষেত্রে তা ব্য়ক্তিগত থাকে কি? রাজনীতির সঙ্গে রণকৌশল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাহলে তৃণমূল কংগ্রেসও কী এই পরিস্থিতিতে ভোট স্থগিত রাখার আবেদনে সামিল হবে? সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক মহলে।
আরও পড়ুন- ‘লোককে খুশি করতেই এখন ভোট বন্ধের কথা’, অভিষেককে কটাক্ষ দিলীপের
রাজ্যের করোনা গ্রাফ ক্রমশ উর্দ্ধমুখী। শনিবার প্রায় ১৯ হাজার ছুঁই ছুই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। বাজারহাট, দোকানপাট সপ্তাহে তিন দিন বন্ধ, বাকি তিন দিন খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে একাধিক পুরসভা। এমনকী আজ, রবিবার বিভিন্ন পুরএলাকায় বাজার বন্ধের সিদ্ধান্ত স্থানীয় প্রশাসনিক স্তরে ঘোষণা করা হয়েছে। একাধিক মেলা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াচ্ছে তা চোখ-কান খোলা রাখলেই স্পষ্ট। এই অবস্থায় পুরভোট নিয়েও সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। একে বিধানসভা ভোটের পর দ্বিতীয় ঢেউয়ে সর্বনাশ হয়েছে বাংলার। পুরসভা নির্বাচনের পর কলকাতা তৃতীয় ঢেউয়ে নাজেহাল। রাজনৈতিক মহলের মতে, পরিস্থিতি অনুযায়ী তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
অন্যদিকে আদালতের নির্দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় গঙ্গাসাগর মেলার প্রস্তুতি তুঙ্গে। হাটে-বাজারে কান পাতলে এই মেলার আয়োজন নিয়ে নানা কথা বলছেন সাধারণ মানুষ। অভিজ্ঞ মহলের বক্তব্য়, করোনা ঝড়ের মুহূর্তে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে জানুয়ারির তিন তারিখ পর্যন্ত যেভাবে রাজ্যজুড়ে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল তার ব্যাখ্যা কি আছে? ডায়মন্ডহারবারে এমপি কাপ, পার্কস্ট্রিটে বড় দিনের উৎসব, হুগলিতে ভিড় ঠাসা খেলার ময়দানে তৃণমূল সাংসদ-মন্ত্রীদের উপস্থিতি, ভোট ময়দানে দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন পেশের উল্লাস, সবই ঘটেছে করোনা ঝড়ের প্রাকমুহূর্তে। রাজনৈতিক মহলের মতে, শেষমেষ এটাই দেখার বিষয় যে অভিষেকের বক্তব্যের পর দলগত ভাবে কী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়।