Bengali Mountaineer Subrata Ghosh Dies After Conquering Mount Everest: মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের পরেও বাঙালি পর্বতারোহীর মৃত্যু। সুব্রত ঘোষের মর্মান্তিক পরিণতি বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কোথাও কি শৃঙ্গজয়ের মোহ-ই দায়ী তাঁর মৃত্যুর জন্য? বা এভারেস্টে চড়ার এবং সামিট করার টাইমিংয়ে ভুল ছিল রানাঘাটের পর্বতারোহীর? শারীরিক ক্ষমতার ঊর্ধ্বে উঠে শৃঙ্গজয়ের নেশাই কাল হল তাঁর ক্ষেত্রে? এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলার পর্বতারোহী মহলে। এই বিষয়ে আলোকপাত করলেন এভারেস্ট জয়ী বাংলার বিশিষ্ট পর্বতারোহীরা। কোথায় খামতি সে দিকেও নজর দিলেন তাঁরা।
গত বৃহস্পতিবারই খবর মিলেছিল পেশায় শিক্ষক সুব্রত ঘোষের এভারেস্ট জয়ের। একদিন পরই তাঁর দেহ উদ্ধার হয় এভারেস্টের কোলে। শৃঙ্গ থেকে মাত্র ২০০-৩০০ মিটার নিচে দুর্গম হিলারি স্টেপের কাছে সুব্রত ঘোষের নিথর দেহ উদ্ধার হয়। স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি সময় পেলেই যে মানুষটা পাহাড়ে অভিযানে চলে যেত, সেই পাহাড়চূড়াতেই চিরঘুমে চলে গেলেন তিনি। এমন মর্মান্তিক পরিণতিতে শিউরে উঠেছেন অনেকে।
সুব্রতর গাইড চম্পল থাপা শুক্রবার ভোররাতে ক্যাম্প ফোরে (শৃঙ্গের ঠিক আগের ক্যাম্প) ফিরে এসে বেস ক্যাম্পে ওয়াকি-টকির মাধ্যমে এই দুঃসংবাদ জানান। হাই অল্টিটিউডে (অতি উচ্চতা) বুধবার সারারাত চড়াই করেছিলেন সুব্রতরা। বৃহস্পতিবার দুপুর ২টো নাগাদ শৃঙ্গস্পর্শ করেন সুব্রত। ততক্ষণে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন তিনি। শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। তার উপর এভারেস্ট শৃঙ্গের ঠিক ২০০-৩০০ মিটার নিচে পাথুরে দুর্গম হিলারে স্টেপ অতিক্রম করা তখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল তাঁর কাছে। এদিকে, সময় বেশি লাগায় অক্সিজেনও নিঃশেষ হয়ে আসে তাঁর। মৃত্যুর জন্য এটাও একটা কারণ। প্রচণ্ড ঠান্ডায় উচ্চতাজনিত সমস্যা শুরু হয় শরীরে। নিজের শরীরকে টেনে আর নিচে নামার শক্তি ছিল না সুব্রতর। পরিণতি নির্মম মৃত্যু।
আরও পড়ুন এভারেস্ট জয় করে ঘরে ফেরা হল না, পাহাড়েই চিরঘুমে বাঙালি পর্বতারোহী
এবিষয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে এভারেস্ট জয়ী পর্বতারোহী রমেশ রায় বলেছেন, 'কোথাও একটা ভুল হয়েছিল সামিটে। নিজের শারীরিক ক্ষমতার উপর আত্মবিশ্বাস ভাল, কিন্তু অতি আত্মবিশ্বাস বিপদ বাড়ায়। কঠিন পর্বতারোহণের অনেক ধরনের সমস্যা রয়েছে। সবার ক্ষেত্রে সমস্যা এক হয় না, আবার সবার শারীরিক সক্ষমতাও এক নয়। এটা বুঝতে হবে। একটা কথা আছে, সামিট করা জরুরি, তার থেকেও জরুরি বিপদে নেমে আসা। এরকম বহু উদাহরণ রয়েছে, পর্বতারোহীর শরীর আর দিচ্ছে না এবং তিনি নিচে নেমে এসেছেন। তবে শৃঙ্গজয়ের মোহ না কাটাতে পারলে মুশকিল। এখন সুব্রত ঘোষ আর আমাদের মধ্যে নেই। তাই কী ভুলত্রুটি হয়েছিল সেসব কথা অনর্থক। তবে এভারেস্ট বা অন্য আট হাজারি শৃঙ্গের ক্ষেত্রে অনেক জিনিস মাথায় রাখতে হয়। নাহলে নিজের বিপদ এবং পরিবার-পরিজনদেরও যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।'
২০১৬ সালে একসঙ্গেই রমেশ রায়ের সঙ্গে এভারেস্ট জয় করেন বিশিষ্ট পর্বতারোহী রুদ্রপ্রসাদ হালদার। তাঁর কথায়, 'টাইমিং এবং প্ল্যানিংয়ে বিস্তর গলদ ছিল। সাধারণত সাউথ কল (এভারেস্টের দক্ষিণ ভাগ) দিয়ে আরোহণের ক্ষেত্রে বেশি রাত করে বেরনো উচিত নয়। জানতে পেরেছি, সুব্রত ঘোষের দলেই একজন ফিলিপিন্সের পর্বতারোহী ক্যাম্প ফোরেই মারা যান। তাঁকে নিয়ে গরিমসি হয়েছে। অভিযানে বেরোতে বেরোতে অনেকটা রাত করে ফেলেন তাঁরা। প্রায় রাত ১১.৩০টার সময় ক্যাম্প ফোর থেকে শৃঙ্গের উদ্দেশে পাড়ি দেন সুব্রতরা। এটা বিকেল ৫-৬টা হওয়া উচিত ছিল। যাত্রাপথে যত সময় বেশি লাগবে অক্সিজেনও বেশি প্রয়োজন পড়বে। তাই অভিযানের পরিকল্পনা এবং টাইমিংয়ে ভুল ছিল। কে-টু বা কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো এভারেস্ট নয়। এখানে হাঁটাপথ লম্বা। দ্রত আরোহণ করে নেমে আসতে হয়। সময়ের সঙ্গে না এগোলে বিপদ হতে বাধ্য।'
এভারেস্ট জয়ী বিশিষ্ট পর্বতারোহী বসন্ত সিংহ রায়ের ক্লাব মাউন্টেনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ কৃষ্ণনগর-এর সদস্য ছিলেন সুব্রত। কিন্তু এভারেস্ট অভিযানে ক্লাবের সঙ্গে নয়, ব্যক্তিগত উদ্যোগে গিয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমকে বসন্ত সিংহ রায় বলেছেন, আমার কাছেই সুব্রতর পাহাড়ে ওঠার হাতেখড়ি। ক্লাবের তরফে চারটে সফল সামিট করেছিল। গোরিচেন, রামজাক, ব্ল্যাক পিক এবং দেবাচেন শৃঙ্গ জয় করেছিল সুব্রত। মানাসলু অভিযানেও গিয়েছিল তবে সফল হয়নি। যাওয়ার আগে আমাকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিয়েছিল। এভাবে ওঁকে হারাতে হবে ভাবিনি।
এদিকে, নেপাল থেকে সুব্রত ঘোষের দেহ ফিরিয়ে আনতে অথৈ জলে তাঁর পরিবার। বাবা অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী এবং মা ছেলের মৃত্যুতে শোকে ভেঙে পড়েছেন। স্কুলের চাকরি থেকে যেটুকু আয় ছিল তার সবটাই চলে যেত পর্বতাভিযানে। জমানো টাকা বলতে কিছুই আর নেই। এখন নেপাল থেকে দেহ আনতে অনেক খরচ। তাই রাজ্য সরকারের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে আছে পরিবার।