ময়দান চত্বরের ডাফরিন রোডের ওপর দিয়েই প্রতিদিন শয়ে শয়ে মানুষ হেঁটে যান। ভিন রাজ্যের বাসিন্দাদেরও পা পড়ে এই রাস্তায়। ঠিক পাঁচ রাস্তার মোড়ের কোনাকুনি একটা জায়গায় রয়েছে কলকাতা ক্রীড়া সাংবাদিক তাঁবু। এখান থেকে মিনিটখানেকের দূরত্বেই রয়েছে রাজ্য ভলিবলের পীঠস্থান, ওয়েস্ট বেঙ্গল ভলিবল অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউবিভিএ)। নেটবলের এই ডেস্টিনেশনে এখন সিনিয়র রাজ্য ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপ চলছে। ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাব ময়দানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
গত মঙ্গলবার রাজ্য ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপের হাত ধরে এই ক্লাবে মিলে গেল দুই প্রজন্ম। ভলির টেন্টে তৈরি হল বাংলার এক গর্বের অধ্যায়। আশির দশকে প্রথম আন্তর্জাতিক বাঙালি মহিলা ভলিবল রেফারি শক্তিধারা সাহার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বাসন্তী দাসের, যিনি শক্তিধারার পর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বাঙালি মহিলা ভলিবল রেফারি। এই মুহূর্তে এই রাজ্যের একমাত্র আন্তর্জাতিক মহিলা ভলিবল রেফারি হলেন বাসন্তী। ভারত থেকে বাসন্তী ছাড়া আর তিনজন মহিলা ভলিবল রেফারি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব করেন। মহারাষ্ট্রের অঞ্জলি সরদেশাই ও অঞ্জলি পাটিল ছাড়া রয়েছেন কেরালার সিমি ক্যাথরিন।
আরও পড়ুন: শুরু হচ্ছে প্রো ভলিবল লিগ, কিন্তু কেন নেই কোনও বাংলার দল?
চলছে রাজ্য ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা। ছবি: শশী ঘোষ
শক্তিধারার বয়স এখন সত্তর, চোখে চশমা। রেফারিং করাতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু প্রাক্তন এই ভলিবল প্লেয়ার মেয়েদের ভলিবলের প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর মৈত্রী সংঘ প্রথম ডিভিশন খেলে। শক্তিধারা এখন থাকেন সল্টলেকের জিসি ব্লকে। ওখানেই ভলিবল শেখান। ট্যাংরাতেও একটি ক্লাব আছে তাঁর। সাফ গেমসে ছেলেদের ফাইনালেও রেফারিং করেছেন তিনি। সেবার বাংলাদেশকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। সাফ গেমস ও এশিয়ান গেমস বাদ দিয়েও শক্তিধারার ঝুলিতে রয়েছে দু’টি বিশ্বকাপে রেফারি হওয়ার অভিজ্ঞতা। ইনকাম ট্যাক্সে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার হিসেবে কাজ করতে করতেই নরেন্দ্রনাথ ঘোষের মতো প্রাক্তন ডব্লিউবিভিএ-র প্রশাসকদের অনুপ্রেরণায় বেছে নিয়েছিলেন রেফারিং। ধীরে ধীরে জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন নদীয়ার এই মেয়ে।
শক্তিধারার স্মৃতিতে আজও জ্বলজ্বল করে বিশ্বকাপ। ২০০১-এ অল ওয়ার্ল্ড উইমেনস ওয়ার্ল্ড কাপে গিয়েছিলেন তিনি। এরপর তেহরানে ২০০২ সালে শুধুমাত্র ইসলামিক দেশের মহিলাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ছিলেন তিনি। তেহরানের ঘটনা আজও ভুলতে পারেননি শক্তিধারা।
"তেহরানের কথা কখনও ভুলতে পারব না। জানেন, বোরখা না-পড়ার জন্য বিমানবন্দরে আটকে দিয়েছিল আমাকে। আমি শাড়ির ওপর ব্লেজার পরেছিলাম। এরপর ওদের বোঝাই, আমি বিশ্বকাপে আমন্ত্রিত। আমাকে কী করতে হবে বলুন? ওরা সবটা বুঝে বলল, মাথাটা ঢেকে নিন। ততক্ষণে আয়োজকরা বোরখা নিয়ে আমার জন্য বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করছেন। আমাকে গাড়িতে ঢুকিয়েই কাঁচ তুলে দিয়েছিলেন। তারপর বললেন, পায়ে মোজা পরে মাথাটা যেন ঢেকে রাখি। এটাই ওদেশের নিয়ম। আমার সঙ্গে একজন দোভাষী ছিলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বোরখা পরে মেয়েরা খেলে কী করে? উনি বলেন, মাঠে গেলেই বুঝতে পারবেন। মাঠে গিয়ে দেখলাম, স্টেডিয়ামে একটা বাচ্চা ছেলেরও প্রবেশাধিকার নেই। মাঠের দায়িত্বে মেয়েরাই। গেটে তালা ঝুলিয়েই হয়েছিল খেলা।"
বাংলার আন্তর্জাতিক ভলিবল রেফারি বাসন্তী দাস। ছবি: শশী ঘোষ
অন্যদিকে বাসন্তী দাস অনন্য প্রতিভাসম্পন্ন এক রেফারি। দক্ষিণ দমদম পুরসভায় কর আদায়কারী হিসেবে কাজ করেন তিনি। তাঁর স্বামীও তাঁরই অফিসে কাজ করেন। বাসন্তীর চেয়েও খেলাটা ভালবাসেন তাঁর স্বামী। গত মঙ্গলবার, অর্থাৎ ২৭ নভেম্বর, ছিল তাঁদের ন’বছরের বিবাহবার্ষিকী। স্বামীই তাঁকে জোর করেন, যেন বাসন্তী রাজ্য ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপে রেফারিং করতে আসেন।
আশ্চর্যভাবে, বাসন্তী কিন্তু শুধুই রেফারিই নন, রীতিমতো সার্টিফায়েড পাইলটও। বাবা কার্তিক চন্দ্র দাস ছিলেন বায়ুসেনায়। বাবার অনুপ্রেরণাতেই গ্লাইডার পাইলট কোর্স করেন তিনি। চালিয়েছেন ছোট বিমানও। বাসন্তীও শান্তিধারার মতোই প্রথমে ভলিবল খেলতেন। এরপর ২০০২ সালে ন্যাশনাল পাস করেন তিনি। ২০০৭ সালে ইন্টারন্যাশনালের গণ্ডী টপকান। ডব্লিউবিভিএ-তে বহুবছর ধরেই আসছেন।
রাজ্যের একমাত্র মহিলা আন্তর্জাতিক ভলিবল রেফারি হওয়ার জন্য গর্ববোধ করেন বাসন্তী। বলেন, "শক্তিদি’র পর আমিই বাঙালি মহিলা আন্তর্জাতিক ভলিবল রেফারি। এ বছর এশিয়ান ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপে দেশের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমার স্বামী আর অফিসের সমর্থন না-থাকলে এই জায়গায় আসতে পারতাম না। এই মাঠের কর্তারাও আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। এখন আমার ৪০ বছর বয়স। আন্তর্জাতিক স্তরে রেফারিং করার সর্বোচ্চ বয়স ৫৫। ততদিন পর্যন্ত ফিটনেস ধরে রাখতে চাই। আসলে কয়েকটা সেকেন্ডের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অন্যান্য খেলার মতো প্রযুক্তির সাহায্য নেই। কাজটা খুবই কঠিন। কিন্তু আমি উপভোগ করি। এভাবেই চালিয়ে যেতে চাই।"
শক্তিধারা সাহা ও বাসন্তী দাস ছবি-শশী ঘোষ
শক্তিধারা ও বাসন্তীর মধ্যে দুই প্রজন্মের অন্তর রয়েছে। কিন্তু দু’জনেই একটা বিষয়ে সহমত। ভারতের চেয়ে বিদেশে রেফারিং করাটা অনেক সহজ। দু’জনেই বলছেন, এদেশে খেলোয়াড়রা রেফারিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু বিদেশে রেফারির সিদ্ধান্তের ওপর কথা হয় না। পাশাপাশি তাঁরা এও বলেছেন, শহরের মেয়েদের এই খেলার প্রতি সেরকম আগ্রহ নেই। কিন্তু গ্রামগঞ্জের মেয়েরা ভলিবল খেলতে চায়, অথচ পরিকাঠামো নেই।
ডব্লিউবিভিএ-র সাধারণ সচিব রথীন রায়চৌধুরি গর্ব করেন শক্তিধারা-বাসন্তীর জন্য। বললেন, "এই মাঠ থেকেই ওদের শুরু। শক্তিধারা এখন আর রেফারিং করতে পারেন না। কিন্তু বাসন্তী করছে। দু’জনেই মহিলা। আর দু’জনই এখান থেকে বিদেশের রাস্তায় গিয়েছেন। ওঁদের জন্য ভীষণ গর্ব হয়।"