-রবিউল ইসলাম বিদ্যুৎ, ঢাকা
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে বাংলাদেশের আবেগ চিরন্তন। পদ্মাপাড়ে ইস্টবেঙ্গলের নিজস্ব সমর্থক গোষ্ঠীই রয়েছে। নব্বইয়ের দশকের নস্টালজিয়া এখনও গঙ্গা-পদ্মাপাড়কে মিলিয়ে দেয়। যার কমন ব্র্যাকেটের নামই ফুটবল-প্রেম!
বাংলাদেশের ফুটবলাররা কলকাতার ময়দানে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন একসময়। ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতে মুন্না, আসলামরা ইতিহাসের একটুকরো হয়ে গিয়েছেন। আত্মার আত্মীয় হয়ে গিয়েছেন দুই দেশের ফুটবল মহলেই। তবে শতবর্ষ পেরোনো লাল-হলুদ এখন অস্তিত্ব সংকটে। বিনিয়োগকারী সংস্থার শর্তে চুক্তি করতে দ্বিধায় ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রশাসকমন্ডলী। চুক্তি সই হলে নাকি ক্লাবটাই বিক্রি হয়ে যাবে! রটে গিয়েছে এমনটাই।
আর এই খবর ছড়িয়ে পরার সঙ্গে সঙ্গে সমর্থকরা ক্ষোভ উগরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। সেই বিক্ষোভের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বাংলাদেশেও। সমর্থকদের দমন করতে ময়দানে পুলিশ লাঠিও চালিয়েছে! প্রিয় ক্লাবের এহেন দূর্দশায় মন খারাপ প্রাক্তন ফুটবলার শেখ মোহাম্মদ আসলামের। বাড়িতে বসেই কলকাতার যত ইস্টবেঙ্গল-কেন্দ্রিক খবর, দেখছেন ততই মুষড়ে পড়ছেন। গুমরোচ্ছেন একা-একাই।
আরও পড়ুন: এক্সিট ক্লজে আরও নমনীয়তা চাইছে ইস্টবেঙ্গল, প্রাক্তনদের সঙ্গে বৈঠকে নারাজ শ্রী সিমেন্টও
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে সেই দুঃখের ঝাঁপি উপুর করে তিনি বলছিলেন, “ইস্টবেঙ্গল টিম করতে না পারলে, মাঠে যদি লাল-হলুদ জার্সি না দেখা যায়, দুই বাংলার মানুষই দুঃখ পাবেন। এটা মানা যায় না কোনওভাবেই। ওপার বাংলায় ইস্টবেঙ্গল ক্লাব আসার পর ফুটবলে যে অবদান রেখেছে সেটা সকলের জানা। আর ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ মানে বিরাট যুদ্ধ। এই যুদ্ধের উত্তেজনাটাই ভারতের ফুটবলকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।"
হতাশা আর বিষণ্নতায় ডুব দিয়ে তিনি আরও বলতে থাকেন, "দুই দেশের ফুটবলে ইস্টবেঙ্গলের অবদান অস্বীকার করার কোনও জায়গাই নেই। আমাদের সময় এখানে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের উত্তেজনা ফুটবলে অতিমাত্রা যোগ করেছিল। সেই জিনিসটা ছিল কলকাতায় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্ম না হলে বাংলার ফুটবল এত তরতাজা হত কিনা, তা নিয়ে আমার ঘোরতর সংশয় রয়েছে। দুই বাংলার প্রচেষ্টাতেই কিন্তু ওপার বাংলায় জম্পেশ ফুটবল আয়োজন হয়েছিল সত্তর, আশি, নব্বই দশকে। যেটা এখনো মানুষের স্মতিপটে রয়ে গিয়েছে। তারা অজান্তে হলেও হাতড়িয়ে বেড়ায় ওই জনপ্রিয়তা কোথায় গেল?"
সত্তর-আশির দশকের ধুলোপড়া স্মৃতি এখনও মন ভালো করে দেয় ফুটবল প্রেমিকদের। কলকাতায় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান মারকাটারি ম্যাচ, আর বাংলাদেশে আবাহনী-মোহামেডানের শ্বাসরুদ্ধকারী ম্যাচ! হৃদকম্প নিয়ে হাজির হত লাখো লাখো সমর্থকদের কাছে। গোটা দেশ দু'ভাগে ভাগ হয়ে যেত।
স্মৃতির সরণিতে হাঁটতে হাঁটতে লাল হলুদের একসময়ের প্রাণভ্রমরা আসলাম বলছিলেন, “বাংলাদেশ সমর্থকরা রেলের লাইন ধরে হেঁটে খেলা দেখতে আসত। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ট্রেনে চড়ে মানুষ আসত। একই অবস্থা ছিল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচেও। সেই অভিজ্ঞতা আমি চাক্ষুস করেছি। মানুষের ঢল থামানোর জন্য ঘোড়া দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হতো। বর্তমানে এই সংস্কৃতিই যেন উবে গিয়েছে। ওপার বাংলায় এখন নামকরা কোনো ফুটবলার নেই। কারণ কৃশানু, বিকাশ, ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়রা এখনও মনের মনিকোঠায় আজীবন বন্দি হয়ে গিয়েছেন। সেই ধরনের কোনো ডাকসাইটে প্লেয়ার সেভাবে উঠে আসছে না। কলকাতায় ফুটবল খেলার মান কমে গিয়েছে। সেই সঙ্গে পাঞ্জাব সহ ভারতের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে নতুন তারকার উদয় হচ্ছে।”
ফুটবলের উত্তেজনা তৈরি হয় সমর্থকদের জন্য। সমর্থকরাই কিন্তু মাঠের প্রাণ। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সমর্থকরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পৃথিবীজুড়ে। শতবর্ষী ক্লাবের সঙ্গে তাদের আবেগ জড়িত। কলকাতার সমর্থকরা বিনিয়োগকারী সংস্থার শর্ত দেখে বিক্ষোভে ফেটে পরেন। যা থামাতে পুলিশকে লাঠিও তুলতে হয়েছে। এটা গর্হিত কাজ হয়েছে বলে মনে করছেন আসলাম।
আরও পড়ুন: শুক্রবার মহা-বৈঠকের দিনেই চড়া দুঃসংবাদ! ট্রান্সফার ব্যানের শাস্তি ইস্টবেঙ্গলে
তিনি সাফ বলেছেন, “পুলিশের তরফে যাঁরা এমন করেছেন এমনটা মোটেই উচিত হয়নি। কারণ এই সমর্থকদের তৈরি করার জন্য যুগে যুগে ফুটবলাররা উঠে এসেছেন। যেমন কৃশানুর নামে, ভাস্করের নামে, মানস দা'র নামে, প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে ফ্যান-ফলোয়ার্স রয়েছে। এঁরা সমর্থকদের মুগ্ধ করেছে বলেই তো ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্য মানুষের এত আবেগ। তাদের বাধা দেওয়াটা খুবই গর্হিত কাজ। আমি মনে করি সুন্দরভাবে সভা-সেমিনারের মাধ্যমে সমর্থকদের সতর্ক করে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু লাঠি পেটা এবং পুলিশ দিয়ে মারপিট করা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার।”
সবমিলিয়ে ক্লাব প্রশাসকের চেয়ারে যারা বসে আছেন তারা দায়ভার এড়াতে পারেন কী? আসলামের সোজা কথা, “তাদের ব্যর্থতার দায়ভার কাঁধে নিয়ে সম্মানের সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। যারা যোগ্য লোক তাদের ওই চেয়ারে বসানো উচিত। আশা প্রশাসনে বদল হলে ক্লাবের শ্রীবৃদ্ধি পাবে এবং নতুন আঙ্গিকে দল গঠন করতে পারবে। লিডারশিপ একটা বড় ফ্যাক্টর। এখন যে সচিব আছেন আমি সারাজীবন দেখেছি পল্টু দাশের আজ্ঞাবহ ছিলেন। তার কাছ থেকে ওইভাবে লিডারশিপ আশা করা যায় না।”
এখানেই না থেমে আসলাম ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলে গেলেন, “ক্লাবের শতবর্ষী পূর্তিতে উনি অন্তত জানাতে পারতেন যে, “ আসলাম তোমরা আসো।” কিভাবে সে আমাদের ভুলে যান, বলেন? এটা কোনও কথা! ইস্টবেঙ্গলকে চ্যাম্পিয়ন করার জন্য আমি রক্ত পর্যন্ত ঝরিয়েছি। আর মুন্নার (মোনেম মুন্না) অবদান তো ভোলা যায় না। আপনি রাতারাতি সব ভুলে গেলেন!”
নিজের সময়কার ক্লাব প্রশাকদের কথা বলতে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে পরেন আসলাম। এত বছর আগের কথা তিনি একটুও ভোলেননি। আসলাম বলছিলেন, “আমাদের সময়ে সম্পর্কটা ছিল বাপ-বেটার। আমাদের কোনওরকম ব্যথা বা ইনজুরি হলে যে পরিচর্যা যে স্নেহ পেয়েছি সেটা অবিশ্বাস্য। একটা প্লেয়ারের কোনও অসুবিধে হলে গভর্নিং বডি ঝাপিয়ে পরেছে। প্রখ্যাত মানুষগুলো তখন গভর্নিং বডিতে ছিল এবং টিম পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আমাদের পল্টু দাশ। গড়গড়ি দা ছিলেন সেক্রেটারি। এঁদের যে স্নেহ যে ভালোবাসা পেয়েছি আমরা তো টাকা পয়সাও চাইতেই পারতাম না। এত আদর করত আমাদের! ওদের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। তখন মনে হতো ইস্টবেঙ্গল এপার বাংলার প্রতিনিধিত্ব করছে এরকম একটা আবহ ছিল।”
অভিমান, আর আহত আবেগ নিয়েই একমনে বলে যান আসলাম। এই বার্তা কী ক্লাবকর্তাদের কানে পৌঁছবে?
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন