আগে গ্রামে গঞ্জে, আনাচে কানাচে শরীর চর্চার আখড়া ছিল। রসিকতা করে বলা হত, গ্রাম-মফঃস্বলিরা জন্মের পর হামাগুড়ি দেওয়ার আগেই হাফডন, বৈঠক দিতে শিখে যেত। স্বাস্থ্যই সম্পদ, বিশ্বাস করা হত প্রতিটি নিঃশ্বাসে। বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার আগে নাকি ব্যায়ামবীররা রীতিমত শরীরচর্চা করেই খিদে বাড়িয়ে নিতেন। তবে সেই সময় এখন অতীতের দস্তাবেজ হয়ে গিয়েছে।
নতুন প্রজন্মের কাছে শরীর সচেতনতা বৃদ্ধি পেলেও, পুরোদস্তুর বডিবিল্ডার হয়ে ওঠা, পেশাদার হয়ে শরীরচর্চাকে আঁকড়ে ধরা- নৈব নৈব চ! কয়েক জেলায় কোনরকমে টিমটিম করে দেহসৌষ্ঠব প্রতিযোগিতা হলেও, ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিসের গ্ল্যামারের কাছে কার্যত ব্রাত্য হয়ে গিয়েছে। আর অতিমারী, লকডাউন- জোড়া শব্দবন্ধনী গত দু-বছরে শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছে জিম, ব্যায়াম সমিতির ওপরে।
আরো পড়ুন: সবুজ মেরুনে কি নাম লেখাচ্ছেন সুপারস্টার মান্দজুকিচ! বিশাল আপডেট দিলেন কোচ হাবাস
"এদিকে চারশো, ওদিকে চারশো…বডি হচ্ছে ওয়ার্ক অফ আর্ট। মাসলগুলো মন্দিরের কারুকার্য।"- 'জয়বাবা ফেলুনাথ' এর এই সংলাপ স্রেফ রিওয়াইন্ড করে বারবার দেখা যায় গুণময় বাগচির জন্য। বাইসেপ, ট্রাইসেপ, কোয়াড্রাসেপ- শরীর যেন মন্দিরের ভাস্কর্য। শুধু সিনেমাতেই বা কেন বাংলা সাহিত্যেও গুণময় বাগচি, মনোতোষ রায়দের মত চরিত্রের আনাগোনা ছিল অবাধ। তবে বর্তমানে ডোডো পাখির মতই ধীরে ধীরে নিঃসাড়ে বাংলা থেকে বিলুপ্তির পথে দেহসৌষ্ঠব প্রজন্ম।
সর্বভারতীয় স্তরে যাঁরা পোডিয়ামে উঠছেন, তাঁরা সকলেই ভিন রাজ্যের। কেন বাংলা থেকে উঠে আসছে না নতুন মনোহর আইচ, মনোতোষ রায়রা? ফিটনেস ট্রেনার সুব্রত দাস সাফ জানালেন, করোনা অতিমারী কার্যত শেষ করে দিয়েছে খেলার এই বিভাগকে। কীভাবে?
আরো পড়ুন: চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলা ট্রিকভস্কির সঙ্গে ATKMB-র আলোচনা জমলই না! কেন এলেন না সুপারস্টার
অসহায় গলায় তিনি বলতে থাকেন, "বাংলায় এমনিতেই এই দেহসৌষ্ঠব নিয়ে চর্চা গত দশকে অনেকটাই কমে গিয়েছে। করোনা অতিমারী এসে কার্যত এই পেশাকেই ঠেলে দিয়েছে ভেন্টিলেশনে। অধিকাংশ ফিটনেস ট্রেনারেরই নির্দিষ্ট মাসিক উপার্জন নেই। জিমে নির্দিষ্ট মাসিক চুক্তি থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা অনেকটাই কম। লকডাউনে সেই উপার্জন শূন্য হয়ে গিয়েছে জিম বন্ধ করে দেওয়ায়। হাতে গোনা যে কয়েকজন জিমে আসতেন, তাঁরাও উৎসাহ হারিয়েছেন। জিম তালাবন্দি থাকলেও মালিকরা ইলেকট্রিক, ভাড়া গুনছেন নিজেদের পকেট থেকে। এমন পরিস্থিতিতে আরো শোচনীয় অবস্থার মুখে পড়েছেন ট্রেনাররা।"
লকডাউনের ফাঁদে কার্যত সর্বস্বান্ত হয়ে আত্মহত্যা এমনকি মৃত্যুর খবরও প্রকাশ্যে এসেছে গত কয়েকমাসে। নীরাজ তানওয়ার, আলি সুলেমানি থেকে ভারতশ্রী জগদীশ লাড- গোটা দেশ জুড়ে একের পর এক মৃত্যুর খবর সামনে এসেছে। সুব্রত রায় বলছিলেন, "আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অবসাদে ভুগছেন অনেকেই। সেখান থেকেই মুক্তির উপায় খুঁজে না পেয়ে বডিবিল্ডাররা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।"
তিনি বলেছিলেন, রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতাতেও নিজেকে প্রস্তুত করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হয় একজন প্রতিযোগীকে। কখনো কখনো সেই বিনিয়োগের অঙ্ক দাঁড়িয়ে যায় ১ লক্ষ টাকা পর্যন্তও। সুষম খাবার, ট্রেনিং, ফুড সাপ্লিমেন্ট, মেডিসিন- সবমিলিয়ে বিপুল খরচ। প্রতিযোগিতায় নিজের সর্বস্ব উজাড় করে প্রস্তুত করার পর হঠাৎ অতিমারীর ধাক্কায় টুর্নামেন্ট বন্ধ হয়ে গেলেই বজ্রপাতের মুখে পড়েছেন অনেকে। এতেই দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন। সেই ধাক্কা সামলাতে না পারলেই চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।
পেশাদারি ক্ষেত্রে চরম অনিশ্চয়তা, জীবনের ঝুঁকি- এসব নিয়েই রাজ্যে চলছে কোনোরকম নাম কা ওয়াস্তে বডিবিল্ডিং! সুব্রত দাস বলছিলেন, সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের এই বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত। তা না হলে এই ব্যর্থ সরণিতে মৃত্যু মিছিল ক্রমশ বাড়বে। আর সোয়েনস্টাইগার হয়ে হতে চাওয়া যুবকদের স্বপ্নভঙ্গ নিয়মিত অধ্যায় হয়ে দাঁড়াবে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন