Advertisment

২২ গজের লড়াই: প্রথম ব্লেড ক্রিকেটার শুভ্র জোয়ারদারের কথা

প্রথম ব্লেড ক্রিকেটার বলে ডাকা হয় তাঁকে। শুভ্র জোয়ারদার। পা নেই, তবু ক্রিকেট খেলে চলেছেন। খেলবেনও। তাঁর অদম্য জেদের কাছে হার মেনেছে বাধা। শুভ্রর সঙ্গে কথা বলেছেন শ্রেয়সী তালুকদার

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Physically Challenged Cricket

দুর্ঘটনার ‘গল্প’ শোনাতে আর গলা কাঁপে না তাঁর, কিন্তু ক্রিকেটের কথা বলতে গেলে গলা কাঁপে (ছবি সৌজন্য - শুভ্র জোয়ারদার)

বাইক অ্যাক্সিডেন্টের কয়েক ঘন্টা আগে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন দলকে। দুর্ঘটনার মুহূর্ত তাঁর জীবন বদলে দেয়। বা বলা যায়, বদলে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু পেরেছে কি? ‘ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড’ বলে কম্পিটিটিভ ক্রিকেট খেলা যাবে না একথা তিনি মানতে চাননি। তাই শুধু জোর ‘কদম’-এ ক্রিকেট খেলছেন তাই নয়, ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেট*কে একটু একটু করে শিরোনামে আনছেন। একা নিজের জন্যে নয়, লড়ছেন আরও অনেকের জন্য। শুভ্র জোয়ারদার। ঝুলন গোস্বামীর পর, কলকাতাকে দেওয়া বিবেকানন্দ পার্কের আরও এক উপহার। সিঙ্গাপুরে ব্র্যাড হজের থেকে টিপস নিয়ে এসেছেন। এই সিজনে কলকাতা লিগে খেলবেন শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ ‘সক্ষম’ ক্রিকেটারদের সঙ্গে। দুর্ঘটনার ‘গল্প’ শোনাতে আর গলা কাঁপে না তাঁর, কিন্তু ক্রিকেটের কথা বলতে গেলে গলা কাঁপে। উত্তেজনায়।

Advertisment

শুরু

আমি স্কুলে থাকতেই ক্রিকেটে জড়িয়ে পড়ি। আমি জগবন্ধু ইন্সটিটিউশনের ছাত্র। ২০০০ সালে ক্লাস এইটে পড়াকালীন প্রথম স্কুল ক্রিকেট খেলি। সত্যি বলতে কি, এইভাবেই আমার ক্রিকেটে প্রথম হাতেখড়ি।

আরও পড়ুন, অকল্যান্ডে ডিআরএস বিতর্ক, প্রশ্নের মুখে প্রযুক্তি

স্কুল ক্রিকেটে হাতেখড়ি?

সেরকম ঠিক না। আমি তখন খেলার ছলেই শুরু করি। স্কুল থেকেই অনূর্ধ্ব -১৫, অনূর্ধ্ব-১৬ ইত্যাদি খেলি। তারপরে যখন ভাল পারফর্ম করি, লোকজন সেটা নিয়ে কথা বলতে শুরু করে, তখন আস্তে আস্তে ক্রিকেট খেলাটাকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করি।

ক্লাব ক্রিকেটে পা

২০০২ সালে প্রথম ক্লাব ক্রিকেট খেলি। আমার স্কুলের স্পোর্টস টিচার আমাকে প্রথম বলেন যে আমি ক্লাব ক্রিকেটে চেষ্টা করতে পারি। আমার প্রথম ক্লাবে ঢোকা ওনার হাত ধরেই। আমার প্রথম ক্লাব ছিল অবসর। এরপর হেরম্বচন্দ্র কলেজে ভর্তি হই। অবশ্য কলেজ ক্রিকেট সেভাবে আমি খেলিনি। মূলত ক্লাব ক্রিকেটেই মনোযোগ ছিল। তারপর থেকে বিভিন্ন ক্লাবে খেলি। অলরাউন্ডার হিসেবে মোটামুটি ভালোই পারফর্ম করতে থাকি। অবশেষে ২০০৮ সালে এক্সেলসিয়র ক্লাবে সই করি।

টার্নিং পয়েন্ট

আমি বরাবরই মেরে খেলতাম। তাই সাধারণত ক্লাব ক্রিকেটে শুরুর দিক থেকেই আমার ব্যাটিং অর্ডার নিচের দিকে থাকত। এক্সেলসিয়রে এসে এই ট্রেন্ড বদলায়। আমাকে বলা হয়, আমি যেখানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, সেই পোজিশনেই খেলতে পারি। এই ক্লাবে এসে আমি স্বাধীনভাবে খেলা শুরু করি। ম্যাচের সিচুয়েশান অনুযায়ী চারেও নেমেছি। এই সময়েই একের পর এক ভাল পারফরম্যান্স আসতে থাকে অলরাউন্ডার হিসেবে। সে বছর ডিস্ট্রিক্ট লেভেলেও খেলি। ফার্স্ট ডিভিসন ক্লাবগুলো থেকে ডাক আসা শুরু হয়। তখন আমি কুড়ির কোঠায়। অনূর্ধ্ব-২২ বাংলা দলে আমার সুযোগ পাওয়ার একটা জোরালো সম্ভাবনা অনেকেই দেখেছিলেন। ঠিক সেই সময়ে, সিজন চলাকালীন আমার অ্যাক্সিডেন্ট হয়।

সেদিনও ম্যাচ উইনার

সেদিন ম্যাচ ছিল দেশপ্রিয় পার্কের মাঠে গ্রিয়ারের সঙ্গে। শেষ দিন এক উইকেট বাকি ছিল আর জিততে দরকার ছিল ১০০ রান। আমি ৮২ রানে অপরাজিত থাকা অবস্থায় এক্সেলসিয়র ম্যাচটা জিতে যায়। সেদিন রাতেই অ্যাক্সিডেন্ট হয়। বাইকে ছিলাম। যাদবপুর থানা থেকে প্রিন্স আনোয়ার শাহ কানেক্টার যাওয়ার ব্রিজ থেকে নামার মুখে একটা টাটা সুমোর সঙ্গে ধাক্কা লাগে।

লড়াই শুরু

আমাকে ডাক্তাররা বলেই দিয়েছিলেন ক্রাচ ছাড়া হাঁটা সম্ভব হবে না। আর্টিফিসিয়াল লিম্ব লাগালেও, যেহেতু পা এর অনেকটা অংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ক্রাচ ছাড়া পুরোপুরি হাঁটাচলা করা যাবে না। ওঁদের কথা শুনি। কিন্তু পাশাপাশি নিজে খোঁজখবর করতে থাকি। অবশেষে একটি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ হয়, মূলত ইংল্যান্ডের কোম্পানি কিন্তু এখানে টাই-আপ সেন্টার আছে। তারপর একদিন বেহালায় একটি টাই-আপ সেন্টারে ট্রিটমেন্ট হয়। তারপর দিন দশেক পর থেকেই, সেপ্টেম্বর নাগাদ আমি মোটামুটি হাঁটাচলা শুরু করি স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু তারপরে ওরাও আমাকে কোন হাই অ্যাক্টিভিটির কাজ করতে, খেলাধূলা করতে বারণ করে। কিন্তু আমারই মন মানছিল না। তাই পুরোটাই নিজের জেদের বশে আবার একটু একটু করে ক্রিকেট খেলা শুরু করি।

আবার শূন্য থেকে

ক্রিকেট থেকে দূরে থাকব না, এটাই আমার মনে হয়েছিল। তাই নিজেই আস্তে আস্তে নতুন করে শুরু করি। বাচ্চাদের সঙ্গে পাড়াতে টুকটাক খেলা শুরু করি, ‘গলি’ ক্রিকেট খেলে অভ্যস্ত হতে শুরু করি। কয়েকদিন পর থেকে বিবেকানন্দ পার্কের পঙ্কজ পালের কোচিং ক্যাম্পে যাওয়া শুরু করি। শুরুতে আমাকে সবাই বারণ করেন। কোচও বারণ করেন। তারপরে কয়েকদিন আমার প্র্যাকটিস দেখার পরে উনিই আমার সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন কীভাবে খেলা আরও বেটার হতে পারে বা কোন শটগুলোয় জোর দেওয়া উচিত। আমার বাড়ির লোকজনের থেকেও আমি এই ব্যাপারে সহযোগিতা পাই, কেউ আমাকে কোনদিন বাধা দেননি। মাস দুয়েক পর আমি ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলা শুরু করি।

ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেট

অজিত ওয়াদেকারের একটি অ্যাসোসিয়েশনের খোঁজ পাই যারা ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেটারদের নিয়ে কাজ করে। সেখানে যোগাযোগ করি। প্রথমে ওরা জানায় যে পুরো একটা পায়ে লিম্ব, এরকম খেলোয়াড় ওদের হয়ে কখনো খেলেনি এবং এরকম একজন খেলোয়াড়কে সুযোগ দেওয়া হয়ত সম্ভব নয়। আমি তখন ওঁদের অনুরোধ করি আমার একটা ট্রায়াল নিতে। ট্রায়াল হয় এবং আমি সুযোগ পাই।

প্রতিযোগিতার খোঁজে

ওখানে খেলাটা হত ক্যাম্বিস বলে। আমি ওদের হয়ে দুটো সিজন খেলি। কিন্তু ক্রিকেটার হিসেবে অসম্পূর্ণ লাগছিল। টেনিস বল বা সফট লেদার বলে খেলে আমি অভ্যস্ত ছিলাম না। আমি ক্রিকেটটা কম্পিটিটিভ লেভেলে খেলেছি বরাবর। এখানে সেই প্রতিযোগিতার অভাব ছিল। আমি মানিয়ে নিতে পারছিলাম না।

Physically Challenged Cricket প্রথমে ওরা জানায় যে পুরো একটা পায়ে লিম্ব, এরকম খেলোয়াড় ওদের হয়ে কখনো খেলেনি এবং এরকম একজন খেলোয়াড়কে সুযোগ দেওয়া হয়ত সম্ভব নয় (ছবি সৌজন্য- শুভ্র জোয়ারদার)

এরপরে দু বছর ক্রিকেট থেকে দূরে ছিলাম। ২০১৩ সালে বন্ধুবান্ধব মিলে একটি কর্পোরেট টিম তৈরি করি এবং বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেলা শুরু করি। এই সময়ে বেশ কিছু ভাল লিগে খেলি, কিছু টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড়ও হই। এরপরে জানতে পারি অন্য একটি সংস্থার কথা, যারা ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেট ডিউজ বলেই খেলে এবং আন্তর্জাতিক লেভেলে টুর্নামেন্টে অংশ নেয়।

২২ গজ, আরও একবার

ডিজেবেল স্পোর্টিং সোসাইটির সঙ্গে যোগাযোগ করি। এরা মূলত আগ্রার সংস্থা এবং বাংলায় এদের কোন সংস্থা ছিল না। তাই আমি প্রথমে বাংলার হয়ে খেলিনি। এদের একটা চ্যালেঞ্জার কাপ হয়। সারা দেশ থেকে ৬০ জন ক্রিকেটারকে বেছে নিয়ে, তাদের নিয়ে টিম বানিয়ে টুর্নামেন্ট খেলা হয়। ২০১৫ সালে সেই টুর্নামেন্টে আমি অংশ নিই এবং সেরা খেলোয়াড় হই। এই চ্যালেঞ্জার কাপের পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করেই আমি ওদের ভারতীয় দলে ডাক পাই। তারপর থেকে আমি এই সংস্থার হয়ে দেশে ও বিদেশে টুর্নামেন্ট খেলছি, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং সিঙ্গাপুরে খেলেছি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব করছি।

ক্রিকেট আইকন

শচীন তেন্ডুলকার অবশ্যই। শচীনকে দেখেই ক্রিকেট খেলার প্রতি আস্তে আস্তে টান আসে এবং খেলতে ইচ্ছে করে। এই যে এতটা এগিয়ে আসা, এক্ষেত্রে শচীন বড় ইন্সপিরেশান। তবে অধিনায়ক বলতে আমি সৌরভ গাঙ্গুলিকে বুঝি। ওই আক্রমণাত্মক অধিনায়কত্ব, বিরোধী দলের ওপর প্রেশার তৈরি করা দাদাকে দিয়েই সম্ভব। এখন যেহেতু নিজে অধিনায়ক তাই এটা বুঝতে পারি।

পরবর্তী পদক্ষেপ

ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ইতিমধ্যেই বাংলার ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেটকে নিজেদের আওতায় আনতে চেয়েছে। আমার সঙ্গে গত ৩রা ডিসেম্বর সেইমত কথাবার্তা হয়ে গেছে। শুধুই সময়ের অপেক্ষা। ওদিকে বিসিসিআইও উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। খুব তাড়াতাড়িই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অধীনে চলে যাব আমরা। অনেক দেশেই এখন ক্রিকেট বোর্ডগুলো এভাবেই কাজ করছে - এ ধরনের ক্রিকেটকে মান্যতা দিয়েছে অফিসিয়ালি, নাহলে বাইরে থেকে সবরকম সহযোগিতা করছে।

কলকাতা লিগ ২০১৯

এবারের কলকাতা লিগে সেকেন্ড ডিভিশনে আমি খেলব পুরনো ক্লাব এক্সেলসিয়র এর হয়ে। বিরোধী দলের অধিনায়কের সম্মতি অনুযায়ী আমাকে রানার দেওয়া হবে।

প্রথম ‘ব্লেড ক্রিকেটার’

আসলে ব্লেড নিয়ে এতদিন অনেকেই দৌড়েছেন। যেমন অস্কার পিস্টোরিয়াস- কে ব্লেড রানার বলা হত। কিন্তু ক্রিকেটে কেউ কোনদিন আগে ‘ব্লেড’ এর ব্যবহার করেননি। তাই আমাকে মিডিয়াই এই নামটা দিয়েছে। ভালোই লাগে শুনতে। আসলে এই ছোট ছোট ব্যাপারগুলোই এগিয়ে যাওয়ার রসদ যোগায়।

(*বর্তমানে ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড কথাটি সচরাচর ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু ক্রিকেটের ক্ষেত্রে এই কথাটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাংলায় শুভ্রদের সংস্থাটির নাম ‘ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল’ এবং শুভ্র জোয়ারদার এই কথাটি ব্যবহার করেছেন ইন্টার্ভিউ এর সময়ে। সে কারণেই এই অধুনা অপ্রচলিত পরিভাষাটি লেখায় ব্যবহার করা হয়েছে।)

cricket Cricket Association Of Bengal
Advertisment