সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, নাম শুনলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত আসে তাঁর। প্রশংসার ঝাঁপি খুলে বসেন। থামতেই চান না। তবে সৌরভের কাছ থেকে যে সরাসরি ঐতিহাসিক টেস্ট দেখার আমন্ত্রণ চলে আসবে তা ভাবতেও পারেননি হাসিবুল হোসেন শান্ত। যে আইসিসি ট্রফিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বকাপের গ্রহে পদার্পণ বাংলাদেশের, সেই টুর্নামেন্টে ফাইনালের নায়ক শান্ত। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লিখে থাকা নাম কলকাতায় পা রাখছেন কিছুদিন পরেই। তাঁর আগেই ওপার বাংলা থেকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে কুর্নিশ করছেন তিনি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-বাংলাকে শান্ত সরাসরি বলে দিচ্ছেন, "বিশ্বাসই করতে পারছি না আমাদের এ রকম সম্মান দেওয়া হবে। কখন কল্পনাও করতে পারিনি। এটা দাদা বলেই সম্ভব। নামি ক্রিকেটার ছিলেন। তার চেয়েও বড় দাদা বিশাল হৃদয়ের মানুষ, আমাদেরকেও মনে রেখেছেন। এর চেয়ে বড় সারপ্রাইজ আর কী হতে পারে!"
২২ নভেম্বর কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে প্রথমবার বাংলাদেশ-ভারত গোলাপি বলে টেস্ট খেলতে নামছে। তার আগে ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের (বিসিসিআই) সদ্য নিযুক্ত সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলি এলাহি কাণ্ড করে ফেলেছেন। ইডেনের ঐতিহাসিক টেস্টকে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, উপমহাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী রুনা লায়লাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট খেলা সব ক্রিকেটারই আমন্ত্রণ পেয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেককে দেওয়া হবে সংবর্ধনা।
আরও পড়ুন নেতা সৌরভের প্রথম প্রতিপক্ষই অভিষেক টেস্টে নামা বাংলাদেশ, কোথায় এখন তাঁরা
সৌরভের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক অবশ্য সেই ২০০০ থেকেই। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে ঐতিহাসিক স্কোয়াডে প্রথম একাদশে ছিলেন শান্ত। সেই টেস্টেই ভারতীয় দলের অধিনায়ক হিসাবে অভিষেক হয়েছিল সৌরভ গাঙ্গুলির। বাংলাদেশের একমাত্র জোরে বোলার সম্পর্কে আগেভাগেই খোঁজ রাখছিলেন কলকাতার ‘মহারাজা’। সেই স্মৃতি হাতরাতে গিয়ে শান্ত বললেন, "আমার সাথে দাদার (সৌরভ গাঙ্গুলি) সে রকম কথা হয়নি। হাই-হ্যালো হয়েছে। তবে বুলবুল (আমিনুল ইসলাম বুলবুল) ভাইকে নাকি দাদা বলেছিলেন, 'তোমাদের ওই জোরে বোলারটা কোথায়?' পরে বুলবুল ভাই এসে আমাকে জানায় যে, 'তোঁর সম্পর্কে দাদা জানতে চেয়েছেন।"
সৌরভ গাঙ্গুলি বিসিসিআইয়ের সভাপতি হওয়ার পর এপার বাংলার মতো ওপার বাংলাতেও উচ্ছ্বাসের জোয়ার। সভাপতি সৌরভের আয়োজনেই এত ঢাকঢোল পিটিয়ে ইডেন টেস্টের আয়োজন। আর এ কারণেই শান্ত বলছেন, "দাদা না থাকলে এসবের কিছুই হতো না। বাংলাদেশ-ভারত সিরিজেই যে দিন-রাতের টেস্টের আয়োজন, সেটা হয়তো সম্ভব হত না। দাদার মতো এত বড় হৃদয়ের মানুষ কম আছেন। ক্রিকেট মস্তিস্ক যেমন প্রখর, তেমনই মানুষকে সম্মান দিতে জানেন। বোর্ড সভাপতি হয়েই দাদা তাঁর কাজ দিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। আমি নিশ্চিত সামনে আরও চমক অপেক্ষা করছে।"
আরও পড়ুন ভারতের কাছে হেরে তিন মাস ঘুমোননি মুশফিকুর, দিল্লি দখলের পরে জানালেন বাবা
বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন সূর্য উঠেছিল ১৯৯৭-এর আইসিসি ট্রফিতে। তার আগে বহুবার বিশ্বকাপ যোগ্যতা অর্জন পর্বে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল বাংলাদেশের। কিন্তু সেবার আকরাম খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করল। সেই জয়ের সৌজন্যেই সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার ছাড়পত্র।
সেই ফাইনালের শেষ বলে জয়ের জন্য দরকার ছিল ১ বলে ১ রান। স্ট্রাইকে ছিলেন ফাস্ট বোলার হাসিবুল হোসেন শান্ত। বোলার বলেই একটু ভয় ছিল! এই ১ রান হবে তো? মার্টিন সুজির বল ব্যাটে চালাতে পারেননি। লেগেছিল প্যাডে। লেগবাই থেকে শান্ত দৌড়ে নিলেন ১ রান।
আরও পড়ুন হাসিনাকে জানানো উচিত ছিল শাকিবের, সাফ জানাচ্ছেন বাংলাদেশের মন্ত্রী
তারপর থেকেই যেন শান্ত-র পরিচিতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল '১ বলে ১ রান'। গোটা বাংলাদেশ সেদিন রংয়ের খেলায় মেতে উঠেছিল। সেই কথা মনে করিয়ে দিতেই নস্ট্যালজিক হয়ে পড়েন শান্ত। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-বাংলাকে বলে দেন, "ওটা আমার কেরিয়ারে এক স্মরণীয় মুহূর্ত। সবই মনে রয়েছে, এখনও। অবিকল। বলটা লেগেছিল প্যাডে। লেগবাই থেকে রানটা পেয়েছিলাম। এখন অনেকেই আমাকে চিনতে পারেন না। কিন্তু সবাই নাম জানেন। আর আইসিসি ট্রফির ফাইনালে ওই ১ বলে ১ রানের কথা বললে সবাই চমকে উঠে বলেন, 'আপনি সেই শান্ত!'
স্বপ্নের গোলার্ধের বাসিন্দা শান্ত-র অবশ্য এখনও আক্ষেপ রয়ে গিয়েছে। ইডেনে কেরিয়ারে একবারও না খেলতে পারার যন্ত্রণা। স্মৃতির পাতা উল্টে তিনি কেবল মনে করেন ১৯৯৮ সালের কথা। "মনে আছে আমরা সেবার ভারতের চেন্নাইয়ে কোকাকোলা কাপ খেলতে গিয়েছিলাম। যাওয়ার পথে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে একটা প্র্যাকটিস সেশন করেছিলাম। সব খেলোয়াড়েরই স্বপ্ন থাকে এসব মাঠে খেলার। আমারও ছিল। কিন্তু সে সময় বাংলাদেশ খুব বেশি ম্যাচ পেত না। তাই খেলা হয়নি। সেবার ভারত সফরে আমরা ওয়ানডেতে প্রথম জয় পেয়েছিলাম কেনিয়ার বিপক্ষে।" গলায় একরাশ আক্ষেপ নিয়ে বলতে থাকেন তিনি।
আরও পড়ুন দাদি-ই করে দেখাল, বলছেন মোহনবাগানে খেলা দেশের প্রথম ‘গোলাপি’ ক্রিকেটার
টি২০ সিরিজ এখন অতীত। ইন্দোরে শুরু হয়ে গিয়েছে টেস্ট সিরিজ। তবে সকলের নজরে ইডেন টেস্ট। গোলাপি বলে টেস্ট খেলা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশেই আলোচনা তুঙ্গে। দু-দলের কেউ এর আগে কৃত্রিম আলোর নিচে টেস্ট খেলেনি। গোলাপি বলের টেস্টে ভালো করতে মুশফিকদের শান্ত-র গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ, "বাংলাদেশের টেস্ট জেতার চিন্তা না করাই ভাল। ওপরের এক থেকে ছয় নম্বর ব্যাটসম্যানদের মধ্যে দুটো বড় পার্টনারশিপ তৈরি করতে হবে। এটা করতে পারলে ইডেন গার্ডেন্সে ভাল কিছু হতেই পারে।"
ভারতে যাওয়ার আগে শাকিবকে নিয়েও মুখ খুলেছেন তিনি। জুয়াড়ির কাছে তথ্য গোপন করায় নিষিদ্ধ হয়েছেন শাকিব আল হাসান। তাঁর না থাকাটা বাংলাদেশের জন্য বিরাট ক্ষতি। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক দলের নির্বাচক শান্ত মনে করেন, শাকিবের মতো ক্রিকেটারের এত বড় ভুল করাটা ঠিক হয়নি, "শাকিব এটা ঠিক করেনি। ওর এসব ভাল করে জানার কথা। কিন্তু সে তথ্য পেয়েও জানাল না। অবশ্যই সে ভুল করেছে। এর জন্য অবশ্য শাস্তিও পেয়েছে।" পরক্ষণেই তিনি যোগ করেন, "শাকিব অনেক উঁচুমানের ক্রিকেটার। পাকিস্তানের মোহাম্মদ আমির পাঁচ বছর পর ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন করেছে। শাকিবও ভুল শুধরে নিশ্চয় ফিরবে।"
যে ইডেনে খেলতে না পারার আক্ষেপ এখনও বয়ে বেড়ান শান্ত, সেই মাঠেই এবার সংবর্ধনা নেবেন তিনি। মঞ্চে থাকবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হাসিনা। থাকবেন একের পর এক নক্ষত্র। মাঠে খেলবেন মিরাজ, মুশফিকুররা। স্বপ্নপূরণ এভাবেও হয়, দেখিয়ে দেবেন হাসিবুল হোসেন শান্ত।