সোমবারের বিকেল। ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় সাড়ে চারটে। এক ঝটকায় সময়টা বহু বছর পিছিয়ে গেল। ফের একবার ইস্টবেঙ্গল জার্সিতে মজিদ বাসকর আর জামশিদ নাসিরি।
আটের দশকে এই জুটি ফুল ফুটিয়েছিল কলকাতা ময়দানে। কিন্তু ২০১৯-সালেও তাদের মহিমা যে অটুট, তা স্বয়ং মজিদ-জামশিদও কল্পনা করতে পারেননি।
তিন দশক পর কলকাতায় পা রেখে অভিভূত মজিদ। ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালের সেরা বিদেশি হিসেবেই তাঁকে গণ্য করা হয়। ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতে মাত্র ২৪টি মাস কাটিয়েই ক্লাবের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে নিজের নাম লিখিয়েছেন তিনি।
এদিন সকালেই জামশিদের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল-মহামেডান ঘুরে গেছেন। বলছেন, "সবই তো বদলে গেছে। গ্যালারিটাও চিনতে পারছি না। থেকে গেছে শুধু লাল-হলুদ। কলকাতায় আসার আগে ভাবছিলাম, আমাদের বিমানবন্দরে কে নিতে আসবে? জনাকয়েক ক্লাব কর্তা বড়জোর। কিন্তু এখানে এসে দেখি শয়ে-শয়ে সমর্থক আমার নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। ভাবতেই পারি না, মানুষ এখনও এত ভালবাসে আমাকে। কলকাতা বরাবরই স্পেশ্যাল।"
ভিডিও দেখুন: তিন দশক পরে শহরে আশির বাদশা, আবেগের সুনামিতে ভাসলেন মজিদ
এতগুলো বছর মজিদের সঙ্গে কলকাতার কোনও সম্পর্কই ছিল না মজিদের। অথচ শহরটাকে হাতের তালুর মতো চেনেন। জামশিদের গাড়ি করে ইলিয়ট রোড, বাবুঘাট, লর্ড সিনহা রোডে পিজি-র রাস্তায় স্মৃতিমন্থন করে এসেছেন তিনি। মজিদ বলছেন," কোনও যোগাযোগই ছিল না কলকাতার সঙ্গে। কোনও খবরই পেতাম না এতদিন। ইস্টবেঙ্গল যখন আসতে বলেছিল আবার খুব দোনামোনায় পড়ে গিয়েছিলাম। মনো (মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য), জামশিদ ফোন করে বলল আসতে। তাও বারবার ভেবেছি, ফিরব কি না! তারপর পরিবার থেকে বলল যেতে, চলেই এলাম।"
ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের ড্রেসিংরুমে কোনোও ফারাক খুঁজে পাননি তিনি। তাঁর মতে দু'টো ক্লাবের পরিবেশই এক ছিল। ফ্যানেদের আবেগ ভুলতে পারেননি মজিদ। সেই টানেই বিকেলে মাঠে ছুটে এলেন। সমর্থকদের সঙ্গে হাত মেলালেন। বল পায়ে শটও নিলেন। এখনও মজিদের চোখের সামনে সেরা ম্যাচ বলতে ভেসে ওঠে রোভার্স কাপ ও দার্জিলিং গোল্ড কাপ। প্রাক্তন সতীর্থদের ভোলেননি এখনও। মনোরঞ্জন, পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়, সুধীর কর্মকার এবং মহম্মদ হাবিবের নাম বলে গেলেন একের পর এক। মজিদের থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তাঁর দেখা সেরা ফুটবলার কে, তিনি ডিফেন্ডার হিসেবে সুব্রত ভট্টাচার্য ও গোলকিপার হিসেবে ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায় কেই বেছে নিয়েছেন।
ভবিষ্যতে কোচ হিসেবে কলকাতার কোনও দল থেকে ডাক পেলে তিনি কি আসবেন? এই প্রশ্নের উত্তরে হাসলেন। বললেন, "আমার হাতে বেশ কিছু ভাল ফুটবলার আছে। ইস্টবেঙ্গল যদি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে, তাহলে আমি সন্ধান দিতে পারি।" মজিদ এখন আর সেভাবে ফুটবল দেখেন না, তাঁর মনে পেলের খেলাই গেঁথে রয়েছে। আর এই প্রজন্মের মেসি আর রোনাল্ডোর মধ্যে মেসিকেই এগিয়ে রাখলেন তিনি।
আগামিকাল নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মজিদকে বরণ করে নেবে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। লাল-হলুদের শতবর্ষ উপলক্ষ্যেই তাঁর কলকাতা য় আগমন। শেষ ২৪ ঘন্টায় ইস্টবেঙ্গল ফ্যানেরা বুঝিয়ে দিয়েছেন কোনও এক বিশেষ দশকের নয়, মজিদ ফুটবলেরই বাদশা। তাঁর ম্যাজিকে এখনও বুঁদ কলকাতা।
ফিরে দেখা মজিদ বাসকরকে
১) ইরানে কেউ এক ডাকে চিনবেন না মজিদ বাসকরকে। কিন্তু ভারতীয় ফুটবল ভুলতে পারেনি এই স্কিমার আর স্কোরারকে। ভাবলে অবাক লাগে এই ফুটবলারই ১৯৭৮ সালে আর্জেন্তিনায় ইরানের হয়ে বিশ্বকাপ খেলেছিলেন।
২) ইরান থেকে আলিগড় বিশ্ববিদ্য়ালয় পড়তে আসেন মজিদ আর জামশিদ নাসিরি। তাঁরাই যে পরবর্তী সময় ফুটবল মক্কার অন্য়তম সেরা নক্ষত্র হয়ে উঠবেন তা কল্পনা করতে পারেননি অনেকেই। যদিও মজিদ ম্য়াজিক আজও অটুট।
৩) ভারতীয় ফুটবলে খেলে যাওয়া ‘শতাব্দী সেরা ফুটবলার’ বলতে মজিদই। আটের দশকে মহামেডান আর ইস্টবেঙ্গলকে সাফল্য়ের শৃঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন এই ইরানিয়ান। কিন্তু লাল-হলুদকে নিজের সেরাটা উজার করে দিয়েছিলেন। ৭১ ম্য়াচে ৬২ গোল করেছিলেন তিনি। আটের বাদশ হয়ে যান তিনি। স্মৃতির সরণীতে রয়ে গিয়েছে ডিসিএম, রোভার্স কাপ, দার্জিলিং গোল্ড কাপ ও ফেডারেশন কাপ।
৪) চিমা ওকোরি, ক্রিস্টোফার, এমেকার আগে ভারতীয় ফুটবলে যে তিনজন বিদেশি নিজেদের রাজ্য়পাট বিস্তার করেছিলেন তাঁদের মধ্য়ে ছিলেন মজিদ, জামশিদ নাসিরি ও মাহমুদ খাবাসি।
৫) বেহিসাবি আর অসংযমী জীবনযাপনের কারণেই কলকাতাকে বিদায় জানিয়ে ইরানে ফিরে গিয়েছিলেন মজিদ। দীর্ঘদিন তাঁর কোনও খোঁজও পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায় ইরানের এক ক্লাবেই কোচিং করাচ্ছেন তিনি। তিন দশক পরে কলকাতায় ফিরলেন তিনি। কিন্তু আজও মজিদের জনপ্রিয়তায় এক ফোঁটাও ভাটা পড়েনি।