দাদু ময়দানি ফুটবলের সাক্ষাৎ কিংবদন্তি, আস্ত মিথ যাকে বলে আর কী! আর নাতি এবার চললেন বিশ্বকাপ খেলতে। দাদু ফুটবল দুনিয়া শাসন করেছেন '৭০-এর দশকে। নাতিও কম যান না। দুই প্রধানে দাপিয়ে ফুটবল খেলা গৌতম সরকারের নাতি ঋষভ মুখোপাধ্যায় এবার খেলবেন ক্রিকেট বিশ্বকাপে। ভারত নয়, ঋষভের গায়ে থাকবে সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর জার্সি। সিনিয়র নয়, আগামী বছর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। ডিভিলিয়ার্স, স্টেইনদের দেশেই এবার বাইশ গজ কাঁপানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।
আরও পড়ুন ছাত্র রোহিতের চোটে স্বপ্নপূরণ পুত্র সিদ্ধেশের, দোলাচলে কোচ
শনিবার সকালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র পক্ষ থেকে ফোন করা হলে উচ্ছ্বাসে গদগদ 'ভারতীয় ফুটবলের বেকেনবাউয়ার'। ঋষভ নাম শুনেই ফোনে গড়গড় করে গৌতমবাবু বলতে থাকেন, "আমার নাতিকে নিয়ে গর্ব করার দিন এসে গিয়েছে। আমিও ক্লাব স্তরে একটু আধটু ক্রিকেট খেলেছি। দু-বছর আগে দুবাইতে গিয়েছিলাম। সেখানে ওকে দেখে চমকে গিয়েছিলাম। আমার ভাগ্নে প্রদীপ্তকে বলেছিলাম, ঋষভ বহুদূর যাবে, দেখে নিস। ব্য়াট-বল দুটোতেই চৌকস। মিলিয়ে নেবেন, ভারতের জাতীয় দলের হয়েও একদিন খেলবে ও।" উচ্ছ্বাস, আবেগ একাকার হয়ে যায় জীবনে একদিন পেলেকে মার্কিং করার সুযোগ পাওয়া গৌতম সরকারের গলায়।
গৌতম সরকারের ভাগ্নে প্রদীপ্তবাবু দেড়দশক হয়ে কর্মসূত্রে দুবাইবাসী। তাঁরই বড় ছেলে ঋষভ এবার অন্য দৃষ্টান্ত নিয়ে হাজির হচ্ছেন। আদতে সিঁথির মোড়ের বাসিন্দা প্রদীপ্তবাবুরা। তবে বহুদিনই দেশছাড়া। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল ঋষভ-নামা! জন্ম এ শহরেই। ছোট্ট ঋষভ মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে পাড়ি দিয়েছিলেন দুবাইতে। শৈশব থেকেই বাইশ গজের প্রতি আকর্ষণ ঋষভের। ক্রিকেটের প্রতি উৎসাহ দেখেই প্রদীপ্তবাবু স্থানীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমি থেকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। তারপর পুরোটাই ইতিহাস। প্রথম বাঙালি হিসেবে বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছেন অন্য দেশের হয়ে। শেষ তিন বছর আন্তঃএমিরেটস টুর্নামেন্টে ব্যাটিং, বোলিংয়ে টানা পারফর্ম করে চলেছিলেন। তার সুবাদেই এবার বিশ্বকাপ-যাত্রা।
অ্যাকাডেমি-নির্ভর টুর্নামেন্টে ধারাবাহিকভাবে পারফরম্যান্স। তারপরেই বছর আঠারোর তরুণ ডাক পান এমিরেটস অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্যাম্পে। ৩০ জনের দলের সেই ক্যাম্প চলেছিল প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে। দুটো অনুশীলন ম্যাচে ঋষভের ভয়ঙ্কর স্পেলের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানরা। ২ ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়ে নিজের আবির্ভাবের কথা সদম্ভে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। সদ্য শেষ হওয়া মরশুমে ২৩ উইকেট শিকার। তারপরেই মেলে চূড়ান্ত ১৪ দলের স্কোয়াডে বিশ্বকাপে যাওয়ার টিকিট।
আরব আমিরশাহীর জার্সিতে ঋষভ কার্যত অপ্রতিরোধ্য। এশিয়া কোয়ালিফায়ারের ১ নম্বর ডিভিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়েই বিশ্বকাপে খেলার ছাড়পত্র পায় মরুদেশ। দলকে চ্যাম্পিয়ন করার পিছনেও ঋষভের হাত! তিন ম্যাচে ঋষভের সংগ্রহে ৯ উইকেট। মালয়েশিয়া, নেপাল এবং ওমানের বিরুদ্ধে বিধ্বংসী ঋষভের সংগ্রহ যথাক্রমে ২, ৪ এবং ৩টে উইকেট।
বাঙালি ছেলের মরুদেশ জয়ের কাব্য অবশ্য এখানেই শেষ নয়। ধোনির স্নেহ-স্পর্শের কাহিনি অনেকেই জানেন না। আরব আমিরশাহীর নামকরা সমস্ত ক্রিকেট অ্যাকাডেমি- আইসিসি, জি ফোর্স, ডেজার্ট ক্লাব অ্যাকাডেমির 'গ্র্যাজুয়েট' ঋষভের আসল উত্থান ধোনির নিজস্ব দুবাই অ্যাকাডেমিতে। বর্তমানে সেখানেই খেলেন তিনি। প্রধান কোচ বিশাল মাহদিক এবং সহকারী কোচ গির্বান চক্রবর্তীর সাহচর্যে নিভৃতে বেড়ে উঠছেন তিনি। ধোনির সঙ্গে মোলাকাতের প্রসঙ্গে এখনও লাজুক হাসি হাসেন ঋষভ। দুবাই থেকে হোয়্যাটসঅ্যাপে ঋষভ বলছিলেন, "ধোনি একবার প্রমোশনাল ইভেন্টে এসেছিলেন। তখন আমি নেটে। অন্য ক্রিকেটারদের সঙ্গেই অনুশীলন করছিলাম। আমার বোলিংয়ের প্রশংসা করেছিলেন। তবে ওঁর মতো এক ব্যক্তিত্বের সামনে কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম।"
ধোনির অ্য়াকাডেমিরই বাঙালি কোচ গির্বান আবার প্রশংসা করছিলেন, উঠতি তরুণের কঠোর জেদ এবং অধ্যাবসায়কে। ডানলপের বাসিন্দা গির্বান দুবাই থেকে বলছিলেন, "ওর সাফল্যের খিদে সাংঘাতিক। প্রচুর পরিশ্রম করতে পারে। এত অল্প বয়সেই এত সাফল্য পেয়েও কিন্তু মাথা ঘুরে যায়নি। লম্বা রেসের ঘোড়া ও।"
আপাতত বিশ্বকাপকেই পাখির চোখ করছেন ঋষভ! বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধেও খেলারও মানসিক প্রস্তুতি সারা। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী হোয়্যাটসঅ্যাপ বার্তায় জানালেন, "ভারত বিশ্বক্রিকেটের অন্যতম শক্তিশালী দল। পাশাপাশি, ভারত আমার নিজের দেশ-ও! তবে স্বদেশের বিরুদ্ধেই দুরন্ত পারফরম্যান্স মেলে ধরতে চাই।" পেশাদারিত্বের কঠিন বর্ম আটকে রাখে আবেগকে।
জানুয়ারির মেগা-টুর্নামেন্টের পরে দেশে চলে আসতে চান তিনি। বাংলার হয়ে রঞ্জি খেলার স্বপ্ন দেখেন। তারপর আইপিএল, ভারতীয় সিনিয়র দল... ধাপে ধাপে এগোতে চান ঋষভ। দিল্লির ঋষভ পন্থ বিশ্বকাপে সুযোগ পাননি। বাঙালি ঋষভ সুযোগ পাচ্ছেন বিশ্বকাপে, অন্যভাবে।