একাত্তর বছর। সেই স্বাধীনতার পরে পরেই ১৯৪৭ সালে প্রথম অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট খেলতে পা রেখেছিল লালা অমরনাথের ভারতীয় দল। বিপক্ষে ছিল ডন ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়া, আর কয়েক মাস পরেই যারা ইংল্যান্ডের মাটিতে ‘ইনভিন্সিবেলস’য়ের তকমা পাবে! ১৯৪৭ থেকে ২০১৮ অবধি গত ৭১ বছরে এগারোবার ভারতীয় দল অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজ খেলেছে কিন্তু কোনবারই প্রথম টেস্ট জিতে উঠতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত সেই অধরা সাফল্য এল অ্যাডিলেডের মাটিতে। সিরিজের শুরুতেই শুধু ১-০ তে এগিয়ে যাওয়া নয় এই ৩১ রানে জয় বিদেশের মাটিতে ভারতের সবচেয়ে কম ব্যবধানের জয়। অ্যাডিলেড ওভালে এই দ্বিতীয় টেস্ট জয় অনেকের মনেই ফিরিয়ে এনেছিল ২০০৩ সালের প্রথম জয়ের স্মৃতি।
দেখে নেওয়া যাক, ভারতের এই টেস্ট জয়ের কয়েকটি বিশেষ দিক।
পুজারার গুরুত্ব
চেতেশ্বর পুজারা ভারতীয় দলে খেলছেন গত আট বছর। দলের অন্যান্য আক্রমণাত্মক স্ট্রোকপ্লেয়ারদের মধ্যে পুজারা নিজের আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন তাঁর জমাট ডিফেন্সে ভর দিয়ে। ঘরোয়া ক্রিকেটে হাজার হাজার রান, ২০০-৩০০ রানের লম্বা লম্বা ইনিংস আর কপিবুক টেকনিক খুব অল্প বয়সেই পুজারাকে প্রচারের আলোয় নিয়ে এসেছিল আর তার সঙ্গে নামের পরে যুক্ত হয়েছিল ‘দ্বিতীয় রাহুল দ্রাভিড়ে’র তকমা। তরুণ পুজারার জন্য সেটা যতটা উপকার করেছিল তার বদলে প্রত্যাশার চাপ বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণ। হাজার হোক, রাহুল দ্রাভিড়ের মত সর্বকালের অন্যতম সেরাদের সঙ্গে তুলনা হলে সেই ব্যাটসম্যানের কাছে ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের দাবী অনেকাংশেই বৃদ্ধি পায়।
পুজারা নিজেকে প্রমাণ করলেও ঠিক সেই জায়গায় নিজেকে নিয়ে যেতে পারেননি। দেশের মাটিতে ভালো খেললেও বিদেশের অপেক্ষাকৃত কঠিন পিচে সেভাবে সফল হতে পারেননি। অথচ তাঁর কাছ থেকে কিন্তু সেটাই আশা ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ধীরগতির ব্যাটিং করার বদনাম। সত্যি বলতে কী গত কয়েক বছরে বেশ কিছু ইনিংসে পুজারা এসে রান তোলার গতিকে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর রক্ষণাত্মক ব্যাটিং দিয়ে। এতে মুশকিল হচ্ছে, রান আটকানোর চাপ না থাকায় বিপক্ষের বোলাররা খুব সহজেই তাঁদের নিজস্ব ছন্দে বোলিং করে তাঁদের মত করে চাপ সৃষ্টি করেছেন। আবার অন্যদিকে শম্বুক গতিতে ব্যাট করেও যখন তিনি বড় স্কোর না করে আউট হয়েছেন তখন ঐ অতগুলো বল খেলেও দলের বিশেষ লাভ হয়নি। দল থেকে বাদও পড়েছেন, আবার রঞ্জি ট্রফিতে শতরানের পর শতরান করে ফিরে এসেছেন।
২০১৭ সালে শ্রীলংকার মাটিতে তিন টেস্টের সিরিজে দুটিতে শতরান করেন পুজারা। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে রান না করলে সেই গুরুত্বটা পাচ্ছিলেন না। কিন্তু ২০১৮ সালের শুরু থেকেই ছবিটা পালটাতে থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকাতে খুব বেশী বড় স্কোর না এলেও জোহানেসবার্গের দ্রুতগতির পিচে পুজারার ৫০ ভারতীয় দলকে প্রথম ইনিংসে একটা ভদ্রস্থ জায়গায় নিয়ে যায় যার ওপর ভর দিয়ে ভারতীয় বোলাররা শেষ অবধি জয় এনে দেন দলকে।
আরও পড়ুন, পার্থে নামার আগেই বড় ধাক্কা, ছিটকে গেলেন রোহিত-অশ্বিন
ইংল্যান্ডে প্রথম টেস্টে বাদ পড়লেও শেষ অবধি সিরিজটা মন্দ যায়নি পুজারার। নটিংহ্যামের তৃতীয় টেস্টে ভারতের জয় তাঁর অবদান ছিল দ্বিতীয় ইনিংসে ৭২ রান। পরের টেস্টে করেছিলেন অনবদ্য ১৩২ রান, যার দৌলতে ভারত জেতার খুব কাছে পৌঁছেও গিয়েছিল। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। শুধু রান নয়, পুজারার খেলার ধরণেও একটা পরিবর্তন চোখে পড়েছিল সবার। জমাট রক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত সিঙ্গলস্ নেওয়ার প্রবণতা, স্পিনারদের বিপক্ষে পায়ের চমৎকার ব্যবহার, সব মিলিয়ে শুধু উইকেটে টিকে থাকা নয় রান তোলার দিকে নজর দিয়েছিলেন পুজারা।
অ্যাডিলেডে প্রথম দিনেই কিছু অপ্রয়োজনীয় শটের দৌলতে ভারতের স্কোর হয়ে গেছিল ৪১ রানে ৪ উইকেট। উইকেটের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে পুজারা দেখেছেন একে একে রাহুল, কোহলি আর রাহানের প্রস্থান। কিন্তু নিজের ফোকাস নষ্ট হতে দেননি। প্রথমে রোহিত, তারপর ঋষভ এবং আশ্বিনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ রান যোগ করেছেন দলের খাতায়। অস্ট্রেলিয়ার তিন ফাস্ট বোলার এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা স্পিনার নাথান লিয়নকে সামলেছেন অনায়াস দক্ষতায়। শেষ পর্যন্ত নিজের ১২৩ রানে কামিংসের অবিশ্বাস্য থ্রোয়ে রানআউট হলেও তার আগে দলের মোট রানকে নিয়ে গেছেন ২৫০ অবধি। এখানেই না থেমে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসেও করেছেন দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৭১ রান। ভারত শেষ অবধি জিতেছে ৩১ রানে।
২০০৩ সালের অ্যাডিলেড টেস্ট যেমন পরিচিত ‘রাহুল দ্রাভিড়ের টেস্ট’ হিসেবে সেরকম ২০১৮ সালের অ্যাডিলেড টেস্টকে ভারতীয় ক্রিকেটপ্রমীরা মনে রাখবেন ‘চেতেশ্বর পুজারার টেস্ট’ হিসেবে। আর সিরিজে বাকি তিনটে ম্যাচে এই ফর্ম ধরে রেখে পুজারা যদি ভারতীয় দলকে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে তাদের প্রথম সিরিজ জয় এনে দিতে পারেন তাহলে হয়তো ‘দ্বিতীয় দ্রাভিড়ে’র বদলে ভারতীয় ক্রিকেটে তৈরি হবে ‘প্রথম পুজারা’র কিংবদন্তি।
প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয় বোলিং
চিরকালই ভারতীয় ক্রিকেটের দুর্বল দিক হল তাদের বোলিং। গত পঁচিশ বছরে ভারতীয় ক্রিকেটে খুব কম দলই এসেছে যারা ভারতের বাইরে টেস্ট ম্যাচে বিপক্ষের কুড়ি উইকেট নেওয়ার ক্ষমতা রাখত। শুধু তাই নয় বিশ্বের অন্যান্য দলে যখন একের পর এক আগুনে ফাস্ট বোলারের আবির্ভাব হয়েছে তখন ভারতীয় ফ্যানদের বসে থাকতে হয়েছে একজন প্রকৃত ফাস্ট বোলারের অপেক্ষায়। একজন ফাস্ট বোলার যিনি নিয়মিত ১৪০-১৪৫ কিলোমিটার/ঘন্টা গতিতে বল করে বিপক্ষের টপ অর্ডারে ভাঙন ধরাতে পারেন।
একদিনে পরিবর্তন আসেনি। কিন্তু আইপিএল, ভারতীয় যুব দল এবং ভারতীয়-এ দলগুলির বিভিন্ন বিদেশ সফর, ন্যাশানাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমি এবং এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনের বিশেষ প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে ভারতীয় দল অবশেষে খুঁজে পেয়েছে তাদের সঠিক বোলিং আক্রমণ। একদল ফাস্ট এবং স্পিন বোলার যাঁরা প্রত্যেকেই একে অপরের থেকে আলাদা এবং নিজেদের বোলিং প্রতিভার ভিত্তিতে দলে এক অসাধারণ ভারসাম্য এনেছেন।
জিগস পাজলের শেষ অংশটা বোধহয় ছিলেন যশপ্রীত বুমরা। একজন আক্রমণাত্মক দ্রুতগতির বোলার যিনি ইওর্কার দিতে সিদ্ধহস্ত। অ্যাডিলেড টেস্টে নিয়মিত ১৪৫ কিমি/ঘন্টার আশেপাশে বল করেছেন তিনি। তাঁর ১৫৩.৩ কিমি/ঘন্টার বলকে বলা হচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালের সবচেয়ে দ্রুতগতির বল। সঙ্গে আছেন অভিজ্ঞ ইশান্ত, বলের পেসের সঙ্গে সঙ্গে পিচের বাউন্সকে কাজে লাগানোর জন্য, অন্যদিকে মহম্মদ সামির বৈশিষ্ট্য তাঁর সুইং এবং রিভার্স সুইং করানোর ক্ষমতা। এঁরা তিনজন ছাড়াও দলে আছেন ভুবনেশ্বর কুমার এবং উমেশ যাদবের মত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সফল ফাস্ট বোলার। সঙ্গে স্পিন বিভাগের দায়িত্বে আছেন অফ স্পিনার রবিচন্দ্রন আশ্বিন, বাঁহাতি স্পিনার রবীন্দ্র জাদেজা এবং বাঁহাতি চায়নাম্যান বোলার কুলদীপ যাদব। সব মিলিয়ে অধিনায়ক বিরাটের কাছে বোলিং বিকল্পের কমতি নেই।
আরও পড়ুন, মণিপুরী যুবকের কামাল, টুইট করল আইসিসি
আর প্রত্যেকেই বোলিং করেছেন চমৎকার। একবারের জন্যেও অস্ট্রেলিয় ব্যাটসম্যানদের ম্যাচের রাশ নিজেদের হাতে নিতে দেননি। একদম মাপা লাইন-লেংথে বল করে চুপ করিয়ে রেখেছিলেন ব্যাটসম্যানদের। খেলার দ্বিতীয় দিনে ৮৮ ওভার ব্যাট করে মাত্র ১৯১ রান তোলে অস্ট্রেলিয়া। গত কুড়ি বছরে দেশের মাটিতে এত ধীরগতির ব্যাটিং করতে দেখা যায়নি অসিদের। গোটা টেস্ট ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়ার রান তোলার গতি ছিল ওভারে ২.৪ রানের কাছাকাছি যেখানে ভারতীয় দল রান করেছে ওভারে প্রায় ২.৯ রানের কাছাকাছি।
ভারতীয় বোলিং শক্তির এখনো কিছু খামতি আছে। সেগুলির মধ্যে প্রধান হল বিপক্ষের নিচের দিকের খেলোয়াড়দের দ্রুত আউট করার অক্ষমতা। হয়তো ভারতীয় বোলারদের মধ্যে এখনও ‘কিলার ইংস্টিঙ্কটের’ সামান্য অভাব আছে যার জন্য অনেক সময়ই বিপক্ষের টপ অর্ডারকে উড়িয়ে দেওয়ার পরেও নিচের দিকের ব্যাটসম্যানদের সামনে এসে তাঁরা আটকে যাচ্ছেন। ইংল্যান্ডের মাটিতে এই জিনিস বারবার দেখা গেছে। এই টেস্টেও অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে শেষ চার উইকেটে যোগ করেছে ১০৮ রান আর দ্বিতীয় ইনিংসে শেষ চার উইকেটে যোগ করেছে ১৩৫ রান। নাথান লিয়ন বা মিচেল স্টার্কের মত বোলাররা দুই ইনিংসেই মূল্যবান রান যোগ করেছেন, দলকে সাহায্য করেছেন শেষ অবধি লড়াই করতে। পরের টেস্টগুলিতে এদিকেই নজর দিতে হবে ভারতের বোলিংবাহিনীকে।
পন্থের বিশ্বরেকর্ড
নিজের ষষ্ঠ টেস্টেই রেকর্ড বইয়ের পাতায় জায়গা করে নিলেন ভারতীয় দলের নতুন উইকেট কিপার ঋষভ পন্থ। ঋদ্ধিমান সাহার চোট এবং ইংল্যান্ডে প্রথম দুই টেস্টে দীনেশ কার্তিকের ব্যর্থতা ভারতীয় দলে পন্থের জায়গা করে দিয়েছিল। নিজের জীবনের তৃতীয় টেস্ট নিজের প্রথম টেস্ট শতরান করলেও তাঁর কিপিং নিয়ে এখনো প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ইংল্যান্ডে, ঘরের মাটিতে উইন্ডিজদের বিপক্ষে এবং অ্যাডিলেডের প্রথম টেস্টেও উইকেটের পেছনে যথেষ্ট নড়বড়ে দেখিয়েছে তাঁকে। তবে পন্থের বয়স খুবই কম, তাই সময় দিলে নিজেকে উন্নত করে নিতে পারবেন বলেই আশা করা যায়। অন্তত তাঁর ক্যাচিং যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য এবং অ্যাডিলেডে এগারোটি ক্যাচ নিয়ে পন্থ এখন জ্যাক রাসেল আর এবি ডি ভিলিয়ার্সের সঙ্গে একটি টেস্টে সর্বোচ্চ ক্যাচের বিশ্বরেকর্ডের ভাগীদার। এর সঙ্গে তাঁর ঝোড়ো ব্যটিং করার ক্ষমতা দলে পন্থের গুরুত্ব অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে।
ক্রিকেট চিরকালই ‘টিমগেম’ এবং নিয়মিত জিততে হলে দলের এগারো জন খেলোয়াড়েরই অবদান খুবই জরুরি। এই টেস্টেও প্রথম ইনিংসে আশ্বিনের লড়াকু ২৫ রান এবং ম্যাচে ৬ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংসে রাহুলের দ্রুত ৪৪, কোহলির ধৈর্য্যশীল ৩৪ এবং রাহানের ৭০ রানের কথা ভুললেও চলবে না। এই অস্ট্রেলিয় দলের ব্যাটিং তেমন শক্তিশালী নয়। স্টিভ স্মিথ এবং ডেভিড ওয়ার্নারের ব্যান এখনো তাদের ভোগাচ্ছে। কিন্তু তাই বলে তারা লড়াই থেকে সরে আসেনি। অ্যাডিলেডে শেষদিনের খেলা সাম্প্রতিক কালের টেস্ট ক্রিকেটের এক অন্যতম সেরা দিন। তাই ১-০ এগিয়ে থাকলেও ভারতের সিরিজ জয় মোটেই সহজ হবে না। সেখানেই দলগত খেলার গুরুত্ব এবং তাই ভারতের সাফল্যের জন্য শুধু কোহলি বা পুজারা নয় পুরো দলকেই ভালো খেলা খেলে যেতে হবে পরের টেস্ট ম্যাচগুলোতে।