ভারত শেষ টেস্টে অর্থাৎ তৃতীয় টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকাকে চারদিনের মধ্যেই পর্যুদস্ত করে এক ইনিংস ও ২০২ রানে হারিয়ে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে আরও মজবুত জায়গা করে নিল। এরই সঙ্গে সিরিজ হোয়াইটওয়াশ করল ০-৩ ব্যবধানে। অবশ্যই ভারতীয় সমর্থক ও ফ্যান হিসেবে খুশিতে সামিল সকলেই।
অন্যদিকে, দক্ষিণ আফ্রিকার কথা যদি ভাবতে হয়, তাহলে তাদের জন্য এই ফলাফল অতি চিন্তার উদ্রেক করবে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বেশ কিছু যুব খেলোয়াড় নিয়ে ভারত সফরে এসেছিল প্রোটিয়ারা। ডিন এলগার, কুইন্টন ডি কক, ফাফ ডু প্লেসি, কাগিসো রাবাদা ও শেষ টেস্টে জুবেইর হামজা ছাড়া কেউ মনে দাগ কাটতে পারলেন না।
প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংস ছাড়া প্রতি টেস্টেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে 'ক্যাচ আপ' গেম খেলতে বাধ্য করে ভারত। পিচে যে জুজু ছিল, সেটা মানা যাবে না। তাহলে ভারত রানের পাহাড় গড়ে কী করে! আর যদি পরিসংখ্যানই দেখা হয়, তাহলে ভারতীয় পেসারদের পরিসংখ্যানটাও একবার দেখতে হবে। মহম্মদ শামি (১৩, তিন টেস্ট), উমেশ যাদব (১১, দুই টেস্ট), ইশান্ত শর্মা (২, দুই টেস্ট) উইকেট নিয়ে প্রমাণ করেছেন, বলে যদি গতি থাকে, তার সঙ্গে সিম, সুইং ও রিভার্স সুইং মেশানো যায়, তাহলে ভারতের মাটিতেও পেস বোলারদের সাফল্য আসে।
অকপটে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ভারতীয় পেস বোলাররা গত দু'বছর দুর্দান্ত বোলিং করছেন। তাঁরা এমন ত্রাস সৃষ্টি করেছেন, যে অন্য কোনও দল উইকেটে ঘাস রাখার আগে দু'বার চিন্তা করছে। যেটা আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা কিম্বা নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে ভাবা হতো। এটা ভেবেই ভাল লাগছে। প্রাথমিক স্পেলে ফাস্ট বোলাররা উইকেট তুলে নিলে, পরবর্তী স্পেলে স্পিনারদের উইকেট নেওয়াটা সুবিধাজনক হয়।
দেখতে গেলে হাশিম আমলা, জাক কালিস, এবি ডিভিলিয়ার্স, ডেইল স্টেইন, মর্নি মর্কেল ও ইমরান তাহিরের মতো প্লেয়ারদের অবসর নেওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকা দলটা নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাচকরা জানতেন যে, এই খেলোয়াড়দের সময় ফুরিয়ে আসছে, তখন তাঁরা কী করছিলেন? বিশ্বকাপেও দক্ষিণ আফ্রিকার পারফরম্যান্স ছিল হতাশাজনক।
একটা জিনিস এখানে প্রমাণিত। ওদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে প্রতিভা উঠে আসছে না। কিম্বা এটা বলা যেতে পারে 'কোলপ্যাক' চুক্তির (ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইউ) অন্তর্গত নাগরিকরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে ক্রিকেট খেলতে পারেন। দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবোয়ে ও বেশ কিছু ক্যারিবিয়ান দেশ এই চুক্তির আওতাধীন। জাতীয় দলের মায়া ত্যাগ করেই একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ইউ-ভুক্ত দেশে থাকতে হয়। এরপর সেই ক্রিকেটার জাতীয় দলে ফিরতে চাইলে তাঁকে কোলপ্যাকের সব সুবিধাই ছাড়তে হয়) জন্য প্রচুর প্রতিভাবান ও যোগ্য খেলোয়াড় উন্নততর জীবনযাপনের জন্য চলে যাচ্ছে ইংল্যান্ডে। আপনাদের একটু স্মরণ করিয়ে দিই। ২০১৯ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড দলে পাঁচ থেকে ছ'জন ছিলেন যাঁরা ইংল্যান্ডের বাইরের ক্রিকেটার। চার থেকে পাঁচ জন ক্রিকেটার ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বংশোদ্ভূত। যেমন গায়ানা থেকে কোলপ্যাক চুক্তির হাত ধরেই ইংল্যান্ডে এসেছেন জোফ্রা আর্চার।
ভারত এই মুহূর্তে ২৪০ পয়েন্টে পেয়ে আইসিসি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শীর্ষে। অনান্য দলের সম্বিলিত পয়েন্টের থেকেও আট পয়েন্ট বেশি। ভারত আপাতত এইভাবে খেললে ব্যাটিং, বোলিং (পেস-স্পিন), ফিল্ডিং মিলিয়ে যে জায়গায় রয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে একজন ক্রিকেটপ্রেমী ও ভারতীয় ফ্যান হিসাবে আশা করতে পারি যে, বিরাট কোহলি ও তাঁর দল আগামী পাঁচ বছর সারা বিশ্বে রাজত্ব করবে। অস্ট্রেলিয়াকে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে হারিয়ে আসার পর আমাদের সংকল্প আরও দৃঢ় হয়েছে।
যার কথা উল্লেখ না-করে এই লেখা শেষ করা যাবে না। মুম্বইয়ে যশস্বী জয়সওয়াল। ১৭ বছরের এই ওপেনার বিজয় হাজারে ট্রফিতে বিশ্বরেকর্ড করেছে। ৫০ ওভারের ফর্ম্যাটে (লিস্ট-এ) সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে দ্বি-শতরানের নজির গড়েছে যশস্বী। ১৬ বছর বয়সে শচীনের অভিষেক, ১৭ বছরে যশস্বীর বিশ্বরেকর্ড। মুম্বই কিন্তু এখনও তাদের ভাণ্ডার থেকে মাঝেমধ্যেই একটি করে রত্ন বের করে দিচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য। অধীর আগ্রহে বসে থাকব এই ক্রিকেটারের গতিপথের দিকে তাকিয়ে।
দু'টি শতরান, একটি দ্বি-শতরান করে সর্বসম্মতিক্রমে ম্যান অফ দ্য সিরিজ নির্বাচিত হয়েছেন রোহিত শর্মা। ময়াঙ্ক আগরওয়ালের সঙ্গে তাঁর ওপেনিং জুটি আপাত স্থায়ীত্ব দিয়েছে সেটা বলাই যায়।
শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়ের আগের কলামগুলি পড়ে দেখুন:
পথপ্রদর্শক হিসাবে ছাপ রেখে যাওয়ার পক্ষে সৌরভের কাছে ১০ মাসই যথেষ্ট’
‘ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট’, প্রমাণ করে দিলেন রোহিত শর্মা
ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো সহজে লড়াই ছাড়বে না দক্ষিণ আফ্রিকা