রবিউল ইসলাম বিদ্যুৎ, ঢাকা
আইপিএলের মেগা নিলামে সাকিব আল হাসান অবিক্রীত থেকে যাবেন এটা হয়তো বাংলাদেশের কেউ ভাবেননি। বেঙ্গালুরুতে ১২ ও ১৩ ফেব্রুয়ারীর নিলামে প্রথম দিন অবিক্রীত থাকার পর দ্বিতীয় দিন সাকিবের নামই উঠেনি, দল পাওয়া তো দূরের কথা! কেন সাকিবের প্রতি ফ্রাঞ্চাইজিগুলোর এই অনাগ্রহ? সাকিবভক্তদের মাঝে এ নিয়ে নানা প্রশ্ন। একেকজন একেকরকম ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ খেলছে তারপরেও সাকিবের আইপিএলে দল না পাওয়া নিয়ে চর্চা থামছে না!
এদেশের সমর্থকদের একটা অংশ মনে করছেন, আইপিএলের ফ্রাঞ্চাইজিগুলো বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের নোটবুকে রাখে না! যে কারণে সাকিবের মতো বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার নিলামে অবিক্রীত থেকে যায়।
তবে বাংলাদেশী সমর্থকদের বড় একটা অংশ মনে করেন, সাকিবের দল না পাওয়ার ব্যাপারে তার পারফরম্যান্সই দায়ী। শেষবার আইপিএলে সাকিব কেকেআরের হয়ে বিবর্ণ ছিলেন। শুধু তাই নয়, ব্যাট হাতে সাকিবের বেশ কয়েকটি ম্যাচে পারফর্ম করার সুযোগ থাকলেও পারেননি। বরং তিনি যে স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেন সেটা আইপিএলে ম্যাচ জেতানোর জন্য পর্যাপ্ত নয়। আর আইপিএলে সাকিব খেলেন বোলিং অলরাউন্ডার হিসাবে। যেখানে সাকিবকে ব্যাট করতে হয় ৬-৭ কিংবা আট নম্বরে। এই পজিশনে দলকে জেতাতে হলে চালিয়ে খেলার বিকল্প নেই। সাকিবের এই সামর্থ্যের কথাও হয়তো দলগুলো বিবেচনায় রেখেছিল!
আরও পড়ুন: ভেঙ্কটেশ আইয়ারের সঙ্গে KKR-এর ওপেনিংয়ে কে! এই তারকারাই হতে পারেন সেরা তিন চয়েস
সাকিবের দল না পাওয়ার আসল কারণ কী? পুরো বিষয়টি খোলাসা করেছেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) ক্রিকেট উপদেষ্টা নাজমুল আবেদীন ফাহিম। বিকেএসপি থেকেই সাকিব-নাজমুলের ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক। সাকিব ক্রিকেটীয় যে কোনও সমস্যায় নাজমুলের শরণাপন্ন হন। এবার তিনিই ছিলেন সাকিবের ফরচুন বরিশালের ব্যাটিং পরামর্শক। নাজমুল আবেদীন ফাহিম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে বলছিলেন,“ এখানে দুটো ব্যাপার আছে। একটা হলো গত দুটো মরসুমে ওর (সাকিব) যে ফর্ম, পারফরম্যান্স ছিল আইপিএলে সেটা খুব একটা সন্তোষজনক ছিল না এটা বুঝতে হবে। আরেকটা হলো ও কতগুলো ম্যাচ খেলতে পারবে, কখন খেলতে পারবে এটাও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ফ্রাঞ্চাইজিগুলির জন্য। ওরা যতগুলো ম্যাচ খেলাতে চাইবে বা যতটুকু সময়ের জন্য ওকে চাইবে সে সময়টা ও দিতে পারবে কি না সেটাও একটা ব্যাপার।"
"আমাদের যেহেতু সাউথ আফ্রিকা এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজগুলো আছে ওর পক্ষে হয়তো সেভাবে সময় দেওয়া সম্ভব হবে না, অত বেশি ম্যাচ খেলা সম্ভব হবে না, সেটাও একটা ব্যাপার। আমার মনে হয় দুটো কারণেই সাকিব এই জায়গায় এসে পড়েছে!"
আইপিএলে গত দুই মরসুমের পারফরম্যান্সে সাকিব নিজেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। সেটা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই এবারের বিপিএলে অন্য সাকিবকে দেখা গেল। বিপিএলের শুরু থেকেই তিনি পাওয়ার হিটিংয়ের প্রতি মনোনিবেশ করেছেন। তাতে সফলও হয়েছেন। বিপিএলে টানা পাঁচ ম্যাচে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছেন সাকিব। আন্তর্জাতিক বা ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিতে এই কীর্তি আর কারও নেই। সবচেয়ে বড় কথা, এতদিন যে পাওয়ার হিটিংয়ে দূর্বলতা ছিল সাকিবের সেটি তিনি কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। কিন্তু তাতে লাভের লাভ যে কিছুই হলো না!
সাকিবের বিপিএলের পারফরম্যান্সে গুরুত্বই দেয়নি আইপিএলের ফ্রাঞ্চাইজিগুলো। তারা আগেই যে দল গোছানোর হিসাব নিকাশ পাকা করে ফেলেছেন। নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলছেন, "সাম্প্রতিক সময়ে ওর (সাকিব) যে ফর্মটা ছিল এটা যদি ফ্রাঞ্চাইজিগুলো বিবেচনায় নিতে তাহলে ওর একটা সুযোগ ছিল। কারণ এখন ও ব্যাটিং দিয়েই যথেষ্ট অবদান রাখার ক্ষমতা রাখে এমনকি আইপিএলেও। ওর ব্যাটিংটা এবং বোলিংটা যদি যোগ করা হয় ও দামী একজন খেলোয়াড় হতে পারত। আমার ধারণা ওকে যদি কোনো ফ্রাঞ্চাইজি নিত তাহলে সে ফ্রাঞ্চাইজি লাভবান হতো।"
নাজমুল আবেদীনের কথার সত্যতা বিপিএলে সাকিবের স্ট্রাইক রেট দেখলেই বুঝতে পারবেন। গুরুর নিকট তালিম নিয়ে পাওয়ার হিটিংটা অল্প কিছুদিনেই রপ্ত করে ফেলেছিলেন বাংলাদেশের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার।সাকিবের পরিবর্তনটা বোঝা যাবে টানা পাঁচটি ম্যাচে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হওয়া ম্যাচগুলোতে একটু চোখ রাখলেই। চট্টগ্রামে ১৭৫.৮৬ স্ট্রাইক রেটে মিনিস্টার গ্রুপ ঢাকার বিরুদ্ধে করলেন ২৯ বলে ৫১। পরের ম্যাচেই সিলেটে গিয়ে ব্যাটিংয়ের ধার আরও বাড়িয়ে নিলেন সাকিব। এবার স্বাগতিক সিলেট সানরাইজার্সের বিপক্ষে করলেন ১৯ বলে ৩৮। স্ট্রাইক রেট ২০০.০০।
পরের ম্যাচে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিরুদ্ধে স্ট্রাইক রেট অবশ্য অতটা বেশি ছিল না। খেলেন ৩৭ বলে ৫০ রানের ইনিংস। চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের বিরুদ্ধে স্ট্রাইক রেটটা বাড়িয়ে নেন সাকিব। ৩১ বলে ৫০ রান এসেছে সাকিবের ব্যাট থেকে। খুলনা টাইগার্সের সঙ্গে এল ২৭ বলে ৪১। স্ট্রাইক রেট ১৫১.৮৫।
এ জন্যই নাজমুল আবেদীন বলছিলেন,“ সাকিবের যেটা সমস্যা ছিল সেটা বিগ হিটিংয়ে। সাকিব গ্রাউন্ডে রানটা ভালোই করতে পারে। কিন্তু সম্প্রতি দেখেছি ছয় মারতে গিয়ে ও প্রায়ই বাউন্ডারি লাইনে আউট হচ্ছে। দশটা মারলে হয়তো আটটাতেই আউট হচ্ছে। একটা-দুটো হয়তো ছয় হচ্ছে। কিন্তু এবারের বিপিএলে ওকে বড় বড় ছয় মারতে দেখেছি। অনেক বড় ছয় মারতে দেখেছি। এই পরিবর্তনটা আইপিএলের সম পর্যায়ের ব্যাটসম্যানের মতো।”
তারপরেও আইপিএলের কোনও দলে ঠাঁই হয়নি সাকিবের। তার দল না পাওয়ার আরও কী কারণ থাকতে পারে? নাজমুল আবেদীন বলে গেলেন,“ সাকিবের দল না পাওয়ার আরেকটি কারণ আইপিএলে ফ্রাঞ্চাইজিগুলি হঠাৎ করেই দল তৈরি করে না, ওরা অনেক আগে থেকেই চিন্তাভাবনা শুরু করে, হয়তো মাসখানেক আগে যখন পরিকল্পনা শুরু করেছিল ওই পরিকল্পনায় হয়তো সাকিব ছিল না। ওরা হয়তো পরিকল্পনা করেছিল কাকে কাকে নিবে, বিকল্পও হয়তো ভেবে রেখেছিল। এভাবে পুরো একটা দল গোছানোর প্রক্রিয়া নিশ্চয়ই ওদের শুরু হয়েছিল।"
"এখন যদি ওরা সাকিবকে নিতে চায় তাহলে দলের ব্যালান্সটা নষ্ট হয়ে যায়, এটাও একটা ব্যাপার হতে পারে। প্রাথমিক পরিকল্পনায় হয়তো সাকিব কারও মাথায় ছিল না। তবে ও এখন ভালো ফর্মে ছিল আইপিএলেও খেলতে পারতো ভালো।”