এখনও স্থানীয় ফুটবলে জাল কাঁপিয়ে দেন। মাঠের নেশা তাঁকে তাড়িয়ে বেরায়। প্যারিসে গৃহহীনদের বিশ্বকাপে অধিনায়কত্ব করেও একরাশ ক্ষোভ, হতাশা, কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছেন দমদমের প্রসেনজিৎ। পাপানের জীবিকা এখন টোটো করে লোকের বাড়ি জল সরবরাহ করা।
একদিকে যখন কাতার বিশ্বকাপে মেসি, এমবাপেদের নিয়ে মাতামাতি চরমে, তখন প্যারিসে হোমলেস বিশ্বকাপের ভারতের অধিনায়ক লোকের বাড়িতে জলের জার বিক্রি করে দুমুঠো অন্নের সংস্থান করছেন। সঙ্গে বাহন টোটো চালিয়ে দুপয়সা রোজগারে কোনরকমে দিন গুজরান চলছে। দমদম এয়ারপোর্ট ১ নম্বর গেট এলাকার বছর চৌত্রিশের প্রসেনজিতের কথায়, "প্যারিস থেকে খেলে আসার পর আমার কিছু হয়নি। ফিরে আসার পর থেকে কোনও কাজ পাইনি। ওয়ার্ল্ড কাপ খেলে এসে টোটো চালাচ্ছি, লোকের বাড়ি বাড়ি জল বয়ে বেরাচ্ছি। এটাই আমার দুর্ভাগ্য। আমার কষ্ট হয়।"
পেটের তাগিদে এখন টোটো চালক প্রসেনজিৎ (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
২০১১-তে ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক হিসাবে দমদমের প্রসেনজিত বৈদ্য প্যারিসে গিয়েছিল হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ খেলতে। সেখানে কমিউনিটি কাপে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারতীয় দল। প্রসেনজিত বলছিলেন, "ফাইনালে বেলজিয়ামকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হই। সার্টিফিকেট ও মেডেল পেতে তিন বছর লেগে গিয়েছে। তাছাড়া আমাকে জার্সি, বুট বা লোয়ার কিছুই দেওয়া হয়নি। ভারতে প্রস্তুতি শিবিরে তো ভাল করে খাবারই জুটত না। তবুও হাল ছাড়িনি।" খেলতে গিয়ে অবহেলাও যেন তাড়িয়ে বেরিয়েছে প্রসেনজিতকে।
অবহেলা এখন নিত্য সঙ্গী প্রসেনজিতের (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
প্রসেনজিতের ফুটবলে উত্থান স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতা সুব্রত কাপ থেকে। ঠিক মতো খাবার না জুটলেও ছোট থেকেই ছিল ফুটবল খেলার অদম্য নেশা। তাঁর বাবা মইয়ের দোকানে কখনও আবার বাড়ি নির্মাণকর্মী হিসাবেও কাজ করতেন। প্রসেনজিত বলেন, "প্যারিসে যাওয়ার আগে সুব্রত কাপ খেলেছি। দিল্লিতে গিয়ে চ্যাম্পয়নশিপ খেলেছিলাম। স্ট্রাইকার পজিশনে মাঠে ছুটে বেড়াতাম। পারিবারিক সমস্যা ছিল, পুষ্টিকর খাবার পেতাম না। কিন্তু দাদা আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছে। লুকিয়ে চারটে করে ডিম, কলা খাওয়াতো। চায়ের দোকানে বিক্রিবাট্টা না হওয়ায় তা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। দাদা টোটো কিনে দিয়েছে। সেটাই এখন চালাই। আর লোকের বাড়িতে জল দিই। এমন করেই এখন সংসার চলছে।"
টোটো চালানোর পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি জল-ও পৌঁছে দেন চ্যাম্পিয়ন ফুটবলার (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
কলকাতার পাশে থাকা সত্ত্বেও ময়দান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি প্রসেনজিৎ। তাঁর কথায়, "চেষ্টা করেছিলাম হয়নি। অনেক দিক দিয়ে পার্টি-পলিটিক্স চলে আসে। সেদিকে আমি যেতে চাই না। অনেকে বলেছিল নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বল। আমি সেটা চাইনি। অনেক খ্যাতনামা খেলোয়াড়ের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়েছে। একবার মেহতাব হোসেন সুযোগ দেওয়ার কথা বলেছিল আন্ডার-১৯ খেলার জন্য। বয়স বেশি হওয়ায় তা হয়নি। আমি বলেছিলাম সিনিয়রদের সঙ্গে খেলতে চাই। তা-ও হয়নি।"
প্যারিসের জ্বলজ্বলে স্মৃতি আঁকড়ে দিন কাটছে প্রসেনজিতের (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
প্যারিসে খেলার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? প্রসেনজিৎ জানাচ্ছিলেন, "ওখানে অনেক বড় বড় টিমের সঙ্গে খেলেছিলাম। ওরকম অভিজ্ঞতা ভারতে হয়নি। ওখানকার টিম, ম্যানেজমেন্ট পুরোটাই আলাদা। থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থাপনা ভাল ছিল। সেখানে প্লেয়ারদের সঙ্গে মিশে খেলার অনেক কিছু টেকনিক শিখেছি। তবে আমার সঙ্গে অনেক কিছু জালিয়াতিও হয়। আমার আন্তর্জাতিক শংসাপত্র আটকে রাখা হয়েছিল। আমার কাছ থেকে জার্সি, বুট সব কেড়ে নিয়েছে ইন্ডিয়া টিমের কর্তারা। একটা সার্টিফিকেট, একটা মেডেল দিয়েছে। এটা সব থেকে বেশি কষ্ট। কোনও স্মৃতি নেই।"
পাড়ার ছোট ফুটবলারদের কোচিংও করেন প্রসেনজিৎ (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
বলতে বলতে যেন একরাশ অভিমান ঝরে পড়ে বছর চৌত্রিশের প্রসেনজিতের গলায়। অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনাতে গিয়ে চোখ ছলছল করে ওঠে দমদমের ১নং মতিলাল কলোনির পাপানের। বাড়ির পাশের মাঠেই প্র্যাকটিস করতেন তিনি। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেদের ফুটবলে কোচিংও করান তিনি। ফুটবল এখনও তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। তবে সময় বয়ে গিয়েছে। প্রসেনজিৎ বলে চলেন, "আমাদের বলা হয়েছিল তোমরা এখান থেকে অনেক টাকা পাবে। ভবিষ্যৎ হয়ে যাবে। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হয়ে খালি হাতে ফিরেছি। শুধু মেডেল আর সার্টিফিকেট নিয়ে। তাও তা তিন বছর ঘুরিয়ে দিয়েছে। আমাদের পুরো টিমটার সঙ্গে এই কান্ড ঘটিয়েছিল। এটাই সব থেকে বড় কষ্ট। আমি শুধু নিজে অধিনায়ক ছিলাম তাই নয়, কোচিং করাতেও পারতাম," বলছিলেন প্রসেনজিৎ।
স্মৃতির এলবাম খুলে দেখেন তিনি এভাবে (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
প্যারিসের খেলা প্রসঙ্গে প্রসেনজিৎ বলেন, 'চ্যাম্পিয়ন্স কাপে প্রথমে খেলা পড়েছিল ইংল্যান্ডের সঙ্গে। গোল করলেও আমরা হেরে যাই। তারপর মেক্সিকো সহ অন্যান্য দলের সঙ্গে খেলি। কোয়ার্টার ফাইনাল অবধি উঠি শেষমেশ। সেখানে হেরে যাই। দুটো অপশন থাকে, একটা চ্যাম্পিয়নশিপ অন্যটা কমিউনিটি কাপ। তারপর কমিউনিটি কাপে আমরা সেখানে চ্যাম্পিয়ন হই।"
প্যারিসে চ্যাম্পিয়ন হয়েও জুটল না কিছুই, আক্ষেপ প্রসেনজিতের (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে দুনিয়া জুড়ে মাতামাতি চলছে। এই দেশে উড়ছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, পর্তুগালের পতাকা। প্রসেনজিতের আক্ষেপ, "আজ আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল নিয়ে সবাই মাতামাতি করছে। আজ আমরাও মাতামাতি করতে পারতাম ভারতকে নিয়ে। ভারতও খেলতে পারত। পিছিয়ে এসেছি কারণ, আমরা খাওয়া-দাওয়া ঠিক করে পাচ্ছি না। সরকার যদি এগিয়ে আসতো তাহলে আমরাও খেলতে পারতাম। নাগপুরের প্রস্তুতি শিবিরে খেলতে গিয়ে বেগুন, আতপ চালের ভাত জুটেছিল। চিকেন মাসে একদিন। মাছও পেতাম না। এসব খেয়ে আমরা খেলতে পারব?"