ক্রিকেট-ফুটবলের কলকাতায় দাবার মতো খেলা কিছুটা হলেও ব্রাত্য। গড়িয়াহাট ফ্লাইওভারের নিচে এক ঝাঁক দাবাপ্রেমীদের আনাগোনা দেখলে কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায় যে, ফেলু মিত্তিরের শহরে মগজাস্ত্রে শান দেওয়ার মানুষের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। বঙ্গজ গ্র্যান্ডমাস্টার সূর্যশেখর গঙ্গোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন যে, এই শহরে আন্তর্জাতিক মানের দাবার টুর্নামেন্ট আর হয় কোথায়!
কয়েক মাস আগে সূর্যও জানতেন না বোধহয় যে, খোদ তাঁর শহরেই বসতে চলেছে ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক চেস টুর্নামেন্ট। সৌজন্যে টাটা স্টিল। আর এই টুর্নামেন্টে অংশ নিচ্ছেন স্বয়ং বিশ্বনাথন আনন্দ। চৌষট্টি খোপের কিংবদন্তি ২৫ বছর পর ভারতে কোনও দাবা প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন। কলকাতায় খেলছেন ৩২ বছর পর। পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভিশি এই টুর্নামেন্ট উপলক্ষে শনিবার দুপুরে হাজির ছিলেন শহরের এক পাঁচতারা হোটেলে। একেবারে খোলামেলা মেজাজেই ধরা দিলেন তিনি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলার দুই গ্র্যান্ডমাস্টার দিব্যেন্দু বড়ুয়া ও সূর্যশেখরও। সাক্ষী থাকল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা।
আরও পড়ুন: বিশ্বের দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম গ্র্যান্ডমাস্টার হল ১২-বছর বয়সী দাবাড়ু আর প্রজ্ঞানানন্দ
কলকাতায় দাবার আন্তর্জাতিক আসরে অংশ নেওয়ার অনুভূতিটা কেমন?
১৯৮৬-তে কিন্তু এই কলকাতাতেই খেলেছিলাম। টাটার ওই প্রতিযোগিতাই ছিল আমার গ্র্যান্ডমাস্টার টুর্নামেন্ট। তখন আমি ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার ছিলাম। ফের এত বছর পর আবার কলকাতাতেই টাটার প্রতিযোগিতাতে অংশ নিচ্ছি। এটা ভেবে ভাল লাগছে। কলকাতা আমার চেনা শহর।
এই টুর্নামেন্ট থেকে দাবা কত’টা উপকৃত হবে?
আমার মনে হয় এই খেলাটা নতুন করে প্রাণশক্তির সঞ্চার করবে খেলায়। এই অঞ্চলে খেলাটা আরও জনপ্রিয় হবে। আমি রীতিমতো উৎসাহিত।
আপনার কি মনে হয় অলিম্পিকে দাবাকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ ?
অবশ্যই করা উচিত। তাহলে দাবারই লাভ হবে। যদিও চেস অলিম্পিয়াড হয়। তবুও অলিম্পিকে দাবার যাওয়া উচিত।
দীর্ঘদিন পর চেস অলিম্পিয়াডে অংশ নিচ্ছেন। এতদিন না খেলার কী কারণ? আর আসন্ন টুর্নামেন্টের জন্য আপনি কত’টা প্রস্তুত!
সত্যি বলতে ওরকম কোনও কারণ নেই না খেলার জন্য়। আসন্ন অলিম্পিকে খেলতে মরিয়া আমি। জানি লড়াই কঠিন হবে। কিন্তু আমি প্রস্তুত আছি।
আপনি যখন গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছিলেন তখন থেকে এখনকার দাবার কী ফারাক দেখেন?
দেখুন আমিই প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছিলাম ভারত থেকে। সেসময় সেভাবে আর গ্র্যান্ডমাস্টার হত না। কিন্তু এ ক’বছরে দৃশ্যটা আমূল বদলে গিয়েছে। এখন আমাদের দেশে পঞ্চাশের ওপর গ্র্যান্ডমাস্টার রয়েছে।
আপনার সাম্প্রতিক ফর্ম নিয়ে কী বলবেন? নিজেকে কোন জায়গায় দেখছেন?
ফর্ম এমন একটা বিষয় যেটা ধারাবাহিক ভাবে এক জায়গায় থাকে না। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। আমি একটা জিনিস বুঝি যে, যে কোনও ম্যাচেই নিজের সেরাটা উজাড় করে দিতে হয়। এর কোনও বিকল্প নেই।
গ্যারি কাসপারভ ও অ্যানাটলি কারপভের মধ্যে কার স্টাইল আর খেলার ধরন আপনাকে আকৃষ্ট করত?
সত্যি বলতে কাসপারভের থেকে কারপভের খেলার স্টাইল সোজা ছিল। আমরা সবাই কম বেশি দু’জনকেই অনুকরণ করতাম। পরে বুঝলান ওনাদের স্টাইল মোটেই সহজ নয়।
সামনেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ, কী ভাবছেন আপনি!
দেখুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ এমন একটা খেলা যেখানে যে কোনও মুহূর্তে ম্যাচের মোড় ঘুরে যেতে পারে। খুব ক্লোজ প্রতিযোগিতা হয়। ম্যাগনাস কার্লসেন ও ফাবিয়ানো কারুয়ানার মতো খেলোয়াড়রা রয়েছে। ফলে কিছুই বলা সম্ভব না।
এত বছর ধরে টানা খেলার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পান আপনি?
দেখুন আমি আলাদা করে কোনও তাগিদ অনুভব করি না, আসলে আমি তো দাবা ছাড়া কিছু পারি না। এটা স্বাভাবিক ভাবেই চলে আসে। জিতি বা হারি আমি খেলাটা যতদিন পারব চালিয়ে যাব।
টাটা স্টিল আয়োজিত এই দাবা প্রতিযোগিতা র্যাপিড ও ব্লিটজ ফর্ম্যাটে হবে। ৪০ হাজার মার্কিন ডলার মূল্য়ের টুর্নামেন্টে র্যাঙ্কিংয়ের প্রথমসারির তারকারাই থাকছেন। আগামী ৯-১৪ নভেম্বর হো চি মিন সরণীর আইসিসিআর-এ বসছে এই ইভেন্ট।
বিদেশি খেলোয়াড়দের মধ্যে রয়েছেন আজারবাইজানের গ্র্যান্ডমাস্টার ও বিশ্বের তিন নম্বর শাখরিয়ার মামেদিয়ারভ, আর্মেনিয়ান গ্র্যান্ডমাস্টার ও বিশ্বের ছ’নম্বর লেভন অ্যারোনিয়ান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ডমাস্টার ওয়েসলে সো আসছেন। যিনি এই মুহূর্তে বিশ্বের ন’নম্বর। জাপানিজ-আমেরিকান গ্র্যান্ডমাস্টার ও চারবারের ইউএসএ চ্যাম্পিয়ন হিকারু নাকামুরা খেলবেন। যিনি র্যাঙ্কিয়ে ১৪ নম্বরে। রাশিয়ার গ্র্যান্ডমাস্টার সার্জে কারজাকিনও খেলবেন। যিনি এই মুহূর্তে ১৫ নম্বরে।
ভারতীয়দের মধ্যে অবশ্যই সবার আগে আনন্দ। এই মুহূর্তে যিনি বিশ্বের ১০ নম্বর। থাকছেন বাংলার সূর্যশেখর, পেন্টালা হরিকৃষ্ণ। টুর্নামেন্টে আলাদা করে চোখ থাকবে আর প্রজ্ঞানানন্দের দিকে। গত জুন মাসে মাত্র ১২ বছর ১০ মাস ১৩ দিনে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হয় সে। এদিনের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন টাটা স্টিলের সহ-সভাপতি (কর্পোরেট সার্ভিসেস) সুনীল ভাস্করণ। তিনি বললেন, “ আমরা আশাবাদী যে, এই ইভেন্ট দিয়ে সবে শুরু হল। ভবিষ্য়তে আমাদের আরও পরিকল্পনা রয়েছে। এখানেই শেষ নয়।” এই অনুষ্ঠানের ভাবনা বেরিয়েছে গেমপ্ল্যান স্পোর্টস প্রাইভেট লিমিটেডের মাথা থেকে। তারাই পরিচালনা করছেন। গেমপ্ল্যানের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর জিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন. “আমেরিকা-ইউরোপে এরকম প্রতিযোগিতা হয়েছে। কিন্তু ভারতে কখনওই হয়নি।”