/indian-express-bangla/media/media_files/2025/03/01/f0t8MC46FVaoQnHHbTTk.jpg)
Sports quota: স্পোর্টস কোটায় ভারতীয় রেলে চাকরি পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন খেলোয়াড়রা। Photograph: (প্রতীকী ছবি)
MS Dhoni-Pullela Gopichand, Sports quota: সরকারি প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ তথা ক্রীড়া কোটায় চাকরি পাওয়া খেলোয়াড়দের প্রতি বঞ্চনার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যদি কোনও ট্রেনযাত্রী ট্রেনে সফরের সময় শারীরিকভাবে ফিট কোনও টিকিট চেকারকে তাঁর কাজে বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখেন, তাহলে তাঁর মুখটা চিনে রাখুন। কারণ, কালো কোট এবং টাই পরা এবং হাতে সংরক্ষিত টিকিটের তালিকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ওই ব্যক্তি ভবিষ্যতে একজন জাতীয় তারকা হয়ে উঠতে পারেন। তিনি হয়তো এমন একজন তারকা, যিনি নিজের গোপন স্বপ্নের পিছনে ছুটছেন এবং জীবনের সংগ্রামের পথে লড়াইও করছেন।
ওই টিকিট চেকারের একটি ছবিও তুলে রাখতে পারেন। কে জানে, হয়তো তিনিই হতে পারেন পরবর্তী মহেন্দ্র সিং ধোনি।
ভারতের জাতীয় ব্যাডমিন্টন কোচ এবং ক্রীড়া জগতের অন্যতম বিখ্যাত নাম পুল্লেলা গোপীচাঁদ, সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় সরকারি চাকরিরত ক্রীড়াবিদদের কষ্ট ও দোটানা নিয়ে মুখ খুলেছেন। গোপীচাঁদ বলেছেন, কোনও চাকরিই বড় বা ছোট না। তবে, ক্রীড়াবিদরা খেলার মাঠের বাইরের কোনও কিছুতেই মজা খুঁজে পান না। সেটা টিকিট চেকারের কাজই হোক বা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি হওয়াই হোক।
গোপীচাঁদ বলেন, 'টিকিট চেকারের কাজটা খুবই কঠিন। অন্যরা বোঝে না যে, একজন ক্রীড়াবিদের জন্য চাকরিতে মনোযোগ দেওয়াটা ঠিক কতটা কঠিন ব্যাপার। তাঁদের খেলার বাইরে অন্য কিছুতে উৎসাহ থাকে না। এমনকী, যখন তাঁরা খেলাধূলা নিয়ে আলোচনা করেন, সরকারি কর্তাদের সেই সময় জি স্যার, জি স্যার বলতেও হয়।' বর্তমানে ভারতে খেলার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। তরুণ প্রজন্ম খেলাকে কেরিয়ার হিসেবে বেছে নিতে চাইছে। এই অবস্থায়, ধোনির কাহিনি নতুনভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজন বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রেলে ধোনির জীবন: স্বপ্ন বনাম বাস্তবতা
২০০০ সালের গোড়ার দিকে, পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুর রেলওয়ে স্টেশনে এক অনিচ্ছুক রেলকর্মী ছিলেন, যিনি পরে পুরো ভারতে সংস্কৃতির আইকন হয়ে ওঠেন। সেই সময় তিনি লম্বা চুল রাখতেন, এবং তাঁর চেহারা দেখে বোঝাই যেত যে তিনি এই চাকরির জন্য উপযুক্ত নন। এক তরুণ উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে, তিনি দিনের ৮ ঘণ্টা ট্রেনে টিকিট চেকিং করার পাশাপাশি ক্রিকেট খেলার ভার সামলাতে পারছিলেন না। তাই তিনি চাকরি ছেড়ে দেন— তারপর যা ঘটে, সেটা ইতিহাস।
ধোনির জীবনের টার্নিং পয়েন্ট
এই ব্যাপারে ধোনির বিখ্যাত উক্তি হল, 'এতদিন যদি চাকরির নিরাপত্তার কথা ভাবতাম, তাহলে কখনও ক্রিকেট খেলতেই পারতাম না।' তাঁর সেই বিখ্যাত সংলাপ, যা 'MS Dhoni: The Untold Story' সিনেমায় উঠে এসেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ধোনির বাবা ছিলেন পাম্প অপারেটর, জীবনের দায়িত্ব-কর্তব্যের কথা ভেবে রেলের চাকরিটি নিয়েছিলেন ধোনি। কিন্তু পরিবারের দায়িত্ব কমে যাওয়ার পর, তিনি শুধুমাত্র ক্রিকেটকে নিজের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেন। গোপীচাঁদের কথায়, 'ধোনি জানতেন যে, যদি স্বপ্ন পূরণ করতে চান, তাহলে ট্রেনের কামরায় আটকে থাকা চলবে না। তাই তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। বাকি সবটাই ইতিহাস।'
ক্রীড়াবিদদের জন্য সরকারি চাকরি—সম্ভাবনা নাকি সীমাবদ্ধতা?
এই প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন উঠেছে— সরকারি চাকরি কি খেলোয়াড়দের উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করে? সরকারি চাকরির বেতন, স্বাস্থ্যসেবা এবং পেনশন ক্রীড়াবিদদের আর্থিক নিরাপত্তা দেয়, কিন্তু একইসঙ্গে এটি কি তাদের সাফল্যের খিদে কমিয়ে দেয়? প্রাক্তন ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট অধিনায়ক ও রেলের উচ্চপদস্থ কর্তা ডায়ানা এডুলজি অবশ্য একে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দেখেন। তিনি বলেন, 'রেল ক্রীড়াবিদদের প্রতিবছর ৩৩০ দিনের বেতন-সহ ছুটি দেয়। মিতালি রাজ, পি.টি. উষা, সঞ্জয় বাঙ্গার ও মুরলি কার্তিকের মতো খেলোয়াড়রা রেলে কাজ করার পাশাপাশি ক্রীড়াজগতে দারুণ কেরিয়ার গড়েছেন।'
কিন্তু, ধোনির ক্ষেত্রে তা সত্য ছিল না। তিনি একজন নতুন আধিকারিক হিসেবে রেলে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর সহকর্মীরা তাঁর বিশেষ সুবিধা পাওয়া নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন। একবার ধোনি ভারতীয় রেলের ক্রিকেট ট্রায়ালে অংশ নেন, কিন্তু কোচ তাঁকে যোগ্য মনে করেননি। সেনিয়ে তাঁকে বিদ্রুপ করেও বলেছিলেন, 'টিকিট চেক কর, খড়গপুর ফিরে যাও, টেনিস বলে ক্রিকেট খেল।' ধোনি কিন্তু হাল ছাড়েননি। ২০০৯ সালে, তিনি ভারতীয় টেস্ট দলের অধিনায়ক ছিলেন এবং ব্র্যাবোর্ন স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করেন। একই স্টেডিয়ামে সেই পুরোনো রেলওয়ে কোচও উপস্থিত ছিলেন। ধোনি তাঁকে মাঠের বাইরে থেকে হাসিমুখে বলেছিলেন, 'স্যার, এখন টেকনিক ঠিকঠাক আছে তো?'
সরকারি চাকরি এবং ধোনির বিদ্রোহ
সরকারি অফিসের কঠোর ব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক বাধ্যবাধকতা কার্যত অনেক ক্রীড়াবিদেরই হাত-পা বেঁধে রাখে। সরকারি কর্তাদের স্বাক্ষরের মাধ্যমে খেলোয়াড়দের অনুশীলনের ছুটি নির্ধারিত হয়, যা বেশিরভাগ সময়ই তেলবাজি এবং স্নেহের রাজনীতির দৌলতেই মেলে। গোপীচাঁদের কথায়, 'তুমি যতই ভালো খেলবে, ততই ঊর্ধ্বতন কর্তাদের সন্তুষ্ট করতে হবে। নতুবা বদলি হতে হতে এমন জায়গায় পাঠানো হবে, যেখানে তোমার কেরিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে।'
এই কারণে, ধোনির মতো বিদ্রোহী মানসিকতার খেলোয়াড়েরা এই পরিবেশে টিকে থাকতে পারেন না। সিনেমায় দেখানো হয়েছে, ধোনির বিরুদ্ধে অফিসে উপস্থিত না থাকার অভিযোগ উঠেছে। তাঁর দুই সহকর্মী এনিয়ে নালিশ করেছেন। আর, এর ফলে তাঁকে অফিস থেকে তলবও করা হয়েছিল। তখনই ধোনি সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি আর এই চাকরি করবেন না।
আরও পড়ুন- নিউজিল্যান্ড ম্যাচে রোহিত-শামি খেলছেন না? সত্যিটা ফাঁস করে দিলেন রাহুল
শেষ কথা: ধোনির মত সবাই হতে পারে না, কিন্তু পরিবর্তনটা জরুরি
ধোনি ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি কোনও বাধার কাছে মাথানত করেননি। কিন্তু অধিকাংশ খেলোয়াড় পেনশন এবং চাকরির নিরাপত্তার কারণে নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দেন। সরকারি চাকরি নিশ্চয়ই ক্রীড়াবিদদের জন্য ভালো, কিন্তু সিস্টেমে পরিবর্তন দরকার। প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের আরও স্বাধীনতা ও অনুশীলনের সুযোগ দিতে হবে, যাতে তাঁরা ধোনির মতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য না হন। আর, যদি সেই পরিবর্তন না আসে, তাহলে আরও অনেক প্রতিভা সরকারি চাকরির ফাঁদে পড়ে হারিয়ে যাবে।