রবিবার, ছুটির দিন! ঘড়ির কাটায় ঠিক সকাল ১০:৪৫, ধর্মতলা মেট্রো স্টেশনের ২ নং গেট থেকে বেরোচ্ছেন দিদিমণি। সঙ্গে আরও দু’জন মাস্টার মশাই। হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে চলেছেন CTC ট্রাম ডিপো’র দিকে। সেখানে সকাল থেকে দিদিমণির জন্য অপেক্ষা করছে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের দল। সকাল থেকে রাত এই ছাত্র-ছাত্রীদের দিন কাটে রাস্তাতেই। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, কলকাতার রাজপথে এরাই পথপিশু নামে পরিচিত।
অনেকে এদের দেখলে পাশ কাটিয়ে দ্রুত চলে যান। আজ সকালটা একেবারে অন্যরকম। দিদিমণি আসতেই দিদিমণির কোলে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে সোনিয়া (নাম পরিবর্তিত)। একগাল হেসে প্রথম প্রশ্ন এত দেরি কেন হল মিস? মিসও কোলে তুলে বছর চারেকের সোনিয়াকে আলতো করে গাল টিপে দিয়ে বলল আজ ট্রেনটা বড্ড লেট। বাকিরা সব কোথায়? প্রশ্ন শেষ করতে না করতেই ব্যাগ কাঁধে হাজির একদল কচিকাঁচারা।
কলকাতার রাস্তায় এমন দৃশ্য সচরাচর দেখতে আমরা খুব একটা অভ্যস্ত নই। পাশের চায়ের দোকানে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল প্রতি রবিবার এটাই দিদিমণির রুটিন ক্লাস। ১১ টা থেকে ১:৩০। আচ্ছা দাদা কতজন এখানে ক্লাস করে? উত্তরে চায়ের দোকানদার জানালেন সংখ্যাটা প্রায় ২০ থেকে ২৫। তবে সবাই রোজদিন আসতে পারেনা। গাছের ছায়ায় চট পেতে শুরু হল ক্লাস। আজ অবশ্য হাতের কাজের এবং সঙ্গে নাটকের ক্লাস নেবেন দিদিমণি। সুদূর রানাঘাট থেকে এই পথশিশুদের ‘মানুষ’ করতেই ছুটে আসা প্রতি রবিবার। জানালেন পাপিয়া কর।
নামটা চেনা লাগল? হ্যাঁ ইনি-ই সেই পাপিয়া কর। রানাঘাট স্টেশনে ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে পাত পেড়ে ভিখারিদের খাইয়ে সংবাদ শিরোনামে এসেছিলেন তিনি। তার পর থেকেই মাঝে মধ্যেই সংবাদ মাধ্যমের লাইমলাইটে হামেশাই এই নামটা ঘোরাফেরা করে। এইতো মাত্র ক’টা দিন আগেই প্রবীণ দম্পতিকে জামাই জীবনের প্রথম জামাই ষষ্ঠী খাইয়ে এসেছিলেন সংবাদ শিরোনামে।
অনুষ্ঠানের মুল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, ‘অন্নপূর্ণা সরাইঘরের’ কর্ণধার পাপিয়া কর। আর পাপিয়ার এই কাহিনী বিপুল ভাইরাল হয়েছে নেটদুনিয়ায়। জামাই ষষ্ঠীর দুপুরে পাত পেড়ে প্রবীণ এই দম্পতিকে খাওয়ালেন পাপিয়া। সুব্রত বাবুর পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, আর অপর্ণার পরনে লাল টুকটুকে শাড়ি। পাপিয়ার সৌজন্যে জমে উঠল সেদিনের দুপুরের সেই অনুষ্ঠান। যার পুরোটাই এখন ভাইরাল নেটদুনিয়ায়। দুস্থের ‘সান্টা ক্লজ’ হিসাবেও পরিচিত তিনি। ১৩ বছর ধরে অভুক্তদের মুখে অন্ন তুলে দেন রানাঘাটের পাপিয়া কর। তার এই উদ্যোগ ইতিমধ্যেই সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামে এসেছে। রানাঘাট স্টেশন চত্বরে অভুক্ত মানুষদের কাছে স্বয়ং ‘ঈশ্বর’ তিনি।
আরও পড়ুন: আজব বিজ্ঞাপন! পেটের তাগিদে যুবকের ‘অদ্ভূত পোস্ট’ সোশ্যাল মিডিয়ায়
পাপিয়া দেবী’র কথায় প্রতিদিন ‘অন্নপূর্না সরাইঘরের’মাধ্যমে ১০০ মানুষকে খাওনোর দায়িত্ব কাঁধে তুলেছেন তিনি। পাশে পেয়েছেন অসংখ্য সাধারণ মানুষকে। এর পাশাপাশি নানান ধরণের সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন পাপিয়া দেবী। মাঝদিয়া এবং কলকাতায় দু’জায়গায় রয়েছে তার এই বিশেষ স্কুল। যেখানে সপ্তাহে একদিন করে পথশিশুদের পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাজ, নাটক ইত্যাদি নানান বিষয় শেখান তিনি। শহরের বেশ কয়েকজন তাঁর এই কাজে এগিয়ে এসেছেন। তাকে ক্রমশ উৎসাহ জুগিয়ে গিয়েছে।
পাপিয়াদেবীর কথায়, তার এই কাজে তিনি সবার আগে পাশে পেয়েছেন নিজের স্বামীকে। যিনি সবসময় পাপিয়ার পাশে থেকেছেন। তাঁকে উৎসাহ দিয়ে গেছেন। তাঁর কথায়, ‘তপ্ত দুপুরে স্টেশনের ওই অসহায় মানুষগুলোকে পেটভরে খাইয়ে যে শান্তি তা আর অন্য কোথাও নেই’! পাশাপাশি এই অসহায় শিশুদের ‘মানুষ’ করার লক্ষ্যে অবিচল পাপিয়াদেবী।