Advertisment

মর্মান্তিক! লোধা নাবালককে পিটিয়ে মারার হৃদয়স্পর্শী একাহিনী চোখে জল আনবে!

ইতিমধ্যেই এঘটনার তদন্তে নেমে ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

author-image
Joyprakash Das
New Update
7 were arrested on the charge of beating Lodha minor to death

ইতিমধ্যেই এঘটনায় মূল অভিযুক্ত-সহ বেশ কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছে।

পশ্চিম মেদিনীপুরের লোধা নাবালককে পিটিয়ে খুনের অভিযোগের কাহিনী শুনলে চোখে জল তো আসবেই, মানুষের নির্মমতা, নির্দয়তা যে এ কাহিনী জানলে কারও হৃদকম্পও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে। আপনি ভাবতেই পারবেন না একবিংশ শতাব্দীতেও এমন নৃশংস ঘটনা ঘটতে পারে। চুরির অপবাদ দিয়ে যে ১২ বছরের নাবালককে মাথা মুড়িয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলল সমাজের কেষ্ট-বিষ্টুরা কার্যত সেই ছেলেটি নিঃস্ব। আত্মীয় পরিজনের কাছে চেয়ে-চিন্তে কোনওরকমে খাওয়া জুটতো অসহায় ওই নাবালকের। বাড়িতেও একাই থাকতো সে।

Advertisment

শুক্রবার বিকেলে ওই নাবালকের বাড়িতে গিয়ে বোঝা গেল না আদৌ ওটা কোনও থাকার জায়গা কি না। সরকারি প্রকল্পে একটা ছোট্ট ঘর পেয়েছে। যার জানালা নেই, দরজা নেই। ঘরের ভিতর অবিন্যস্তভাবে মলিন জামাকাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঘরের মেঝেতে পড়ে রয়েছে একটা থালা, একটা গ্লাস, প্লাস্টিকের জলের বোতল। দেখে মনে হবে পরিত্যক্ত ঘর। ওই ঘরেই বুধবার সকালে নাবালকের মৃতদেহ দেখতে পায় পাশের আত্মীয়স্বজনেরা। পাছে পথ অবরোধ হয় এই আতঙ্কে এমনকী তাঁর দেহও কাড়াকাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে যায় এলাকার মাতব্বররা।

অসহায় অকালে চলে যাওয়া নাবলকের পরিবারে মা বাড়িতে থাকে না বিগত ৫ বছর। বাবা ৮ দিন আগে বাইরে কাজে গিয়েছে। পরিবারের অন্য সদস্যরাও জানেন না বাবা কোথায়। বাবা জানেই না ছোট ছেলের মর্মান্তিক পরিণতি। ছেলেটির ২১ বছরের বড় ভাই ওই জেলারই অন্যত্র শ্বশুরবাড়িতে থাকে। মাঠে জনমজুরের কাজ করে। বছর ১৮-এর মেজ ভাই কাজের তাগিদে বেঙ্গালুরুতে আছে। বড় ভাই ঘটনা জানতে পেরে গ্রামে এসে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আছে। মেজ ভাই ট্রেনে ফিরছে। ১২ বছরের ছোট ভাইয়ের নিথর দেহ কাড়াকাড়ি করে সোজা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে গ্রামেরই একদল মাতব্বর। নাবালক ছেলেকে চুরির অপবাদে মারধর করে, ন্যাড়া করে দেয় একদল উন্মত্ত জনতা। তারপর ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল বাড়িতে। দরজা, জানালাহীন বাড়িতে ওই রাতে একাই শুয়েছিল নাবালকটি। সকালে আর ঘুম ভাঙেনি তার। মৃত নাবালকের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল পরিবারের কেউ নেই ঘরে। ওই ঘরে কেউ আর কেউ থাকে না। কোনও মানুষের থাকার মতো নয় সেই ঘর।

কী ঘটেছিল?

পাশের ঘরের খুড়তুতো দাদা বলেন, 'ভাইয়ের বিরুদ্ধে হাঁড়ি চুরির অভিযোগ করেছে। যদি চুরি করেও থাকে এভাবে কেউ পিটিয়ে মারতে পারে। প্রথমে বাড়ির পাশের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে। আমিও সেখানে গিয়েছিলাম। তারপর গ্রামের কেউ কেউ মারধর করতে থাকে। আমি তাঁদের হাতে-পায়ে ধরে মারধর না করতে অনুরোধ করি। কে শোনে কার কথা। ছোট্ট ফুলের মতো নাবালক ভাইকে বাজারের সেলুনে মাথা ন্যাড়া করিয়েছে। গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য ও ওর সঙ্গীরা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। ওদের ফাঁসি দেওয়া উচিত। মারধর করে বেগতিক দেখে রাতেই আবার ভাইকে মাঝে বসিয়ে বাড়ির পাশের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে। কোনওরকমে ভাই ওর ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়েছিল। সকালে গিয়ে দেখি মুখে গ্যাঁজলা বেরিয়ে মেঝেতে পড়ে রয়েছে। অসার শরীর। পরিবারের অন্যদের জানাই খবরটা। এই খবর শুনে ওর দাদা এসেছে।' অভিযোগ হওয়ায় পঞ্চায়েত সদস্য মনোরঞ্জন মাল-সহ ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে মনে হল তাঁদেরও কোনও হেলদোল নেই। গ্রামেই পিসির বাড়িতে এসে উঠেছে মৃত নাবালকের বড় ভাই। 'ভাই কেন চুরি করবে?' প্রশ্ন দাদার। দাদার বক্তব্য, 'ভাই যদি কিছু করেও থাকে তাহলে গ্রামের একদল মানুষ এত নৃশংস কি করে হয়? ১২ বছরের ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে?' তাঁর দাবি, 'অপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলাতে হবে।' ছেলেটির পিসেমশাই বলেন, 'ভাইপোর নিজের বাড়ির হাঁড়িকরা চুরি হয়েছে। সেটা আনতে গিয়েছিল। তারপর তাঁকেই ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভুল করলে প্রশাসনের হাতে তুলে দিতে পারত। আমাদের খবর দিত পারত। মাঝি পরগণার লোকজন আসবে শুনে তড়িঘড়ি জোর করে মৃতদেহ খড়্গপুর মেডিক্যাল কলেজে পোস্ট মর্টেমের জন্য নিয়ে গিয়েছে।' তিনি বলেন, 'জানেন শ্মশানে সৎকার করতে মাত্র ৬ জন গিয়েছিলাম। আমরা পরিবারের ৩ জন ও গ্রামের ৩ জন ছিল সেখানে। মাঝি পরগণার লোকজন আমাদের সঙ্গে থানায়ও গিয়েছিল। ওরা না এলে কেউ গ্রেফতার হত কিনা সন্দেহ। ওর বাবা বাইরে থাকায় ঘটনাটা জানে না।'

আরও পড়ুন- প্রাথমিকে নিয়োগ মামলা: ইডির তদন্তকারী অফিসারের বিরুদ্ধে বিরাট পদক্ষেপ বিচারপতি অমৃতা সিনহার

এদিকে, জেলা পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার বলেন, 'প্রাথমিকভাবে ধারনা ওই নাবালককে খুন করা হয়েছে। খুনের মামলা রুজু হয়েছে। ইতিমধ্যে ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।' সবংয়ের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া বলেন, 'দলের এক পঞ্চায়েত সদস্য এই ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে। পুলিশ কড়া ব্যবস্থা নিয়েছে। আইন আইনের পথে চলবে।

পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, এই নারকীয় ঘটনার পর এখনও পর্যন্ত এই গ্রামে এসে কোনও খোঁজখবর নেয়নি তৃণমূল বা বিজেপির কোনও নেতৃত্ব। বরং পথ অবরোধে হইচইয়ের ভয়ে মৃতদেহ প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে বাড়ি থেকে। এখন তাঁরা ন্যায্য বিচার চাইছে। যখন চন্দ্রযান পৌঁছে যায় অনায়াসে, সেই দেশে সামান্য চুরির অভিযোগে পিটিয়ে মেরে ফেলার অভিযোগ ওঠে অসহায়, নিঃস্ব নাবলককে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, মনুষ্যত্ব কি আর বেঁচে নেই?

Paschim Medinipore West Bengal Murder
Advertisment