Advertisment

'দেখতে পাচ্ছ মুকুল, সোনার কেল্লা', কেমন ছিল দুঃসহ ১১ বছর? অকপট অম্বিকেশ

সুপ্রিম কোর্ট রায় দিল, এই ধারায় সারা ভারতের নিম্ন আদালতে যত মামলা চলছে তা বন্ধ করতে হবে। তারপরেও মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। ২০১৫ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত, অর্থাৎ ৮ বছর লাগল মামলা থেকে বেরিয়ে আসতে।

author-image
Joyprakash Das
New Update
AMBIKESH_MAHAPATRA

অম্বিকেশ মহাপাত্র। ছবি- শশী ঘোষ

ব্যঙ্গ চিত্র শেয়ার করে গ্রেফতারের পর দীর্ঘ প্রায় ১১ বছর ধরে আদালতে চক্কর কাটতে হয়েছে অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে। মামলার ধারাটি সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করায় মুক্তি পেয়েছেন অম্বিকেশ। 'সোনার কেল্লা' ই-মেলে শেয়ার করায় জেল খাটতে হয়েছে এই অধ্যাপককে। দিনের পর দিন আদালতে ঘুরপাক খেতে হয়েছিল। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার কাছে অকপট অধ্যাপক।  

Advertisment

প্রশ্ন- সেদিন কী ঘটেছিল?

অম্বিকেশ মহাপাত্র- আমি একটা সমকালীন বিষয়ের ওপর কার্টুন পেয়েছিলাম ই-মেলে। আমার বন্ধুদের সেটা ফরোয়ার্ড করেছিলাম। মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে একটা পরিকল্পনা হয়। কলকতা পুলিশের যোগসাজসে তৃণমূল কংগ্রেসের ৭০-৮০ জন দুষ্কৃতী আমাদের আবাসনের অফিসে হাজির হয়। আমি তখন সমবায়ের সহ-সম্পাদক ছিলাম। সম্পাদক ছিলেন সুব্রত সেনগুপ্ত, তাঁর বয়স ছিল তখন ৭৩ বছর। জড় হওয়া দুষ্কৃতীরা একটি কার্টুন দেখিয়ে মারধর করে। চড়, থাপ্পর, গালিগালাজ ও  প্রাণনাশের হুমকি। তাঁদের কাছে হাতজোড় করে প্রাণভিক্ষা চাই। এই অবস্থায় তাঁদের নির্দেশিত মুচলেখা লিখে দিতে বাধ্য় হই। এটা ১২ এপ্রিল ২০১২ সালের ঘটনা। আমাকে ও সুব্রত সেনগুপ্তকে তাঁদের কথামতো পুলিশ গ্রেফতার করে। সেই রাত লকআপে কাটে। পরের দিন আদালতে জামিন হয়।

প্রশ্ন- মামলার ধারাই তো বাতিল হয়ে যায় সুপ্রিম কোর্টে?

অম্বিকেশ মহাপাত্র- ২০১৩ সালে যখন চার্জশিট গৃহীত হয়েছিল তখনও ৬৬-এ ধারাটা ছিল। কিন্তু, ২০১৫ সালে এই ধারাকে সুপ্রিম কোর্ট অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। কারণ, সুপ্রিম কোর্টে একটা জনস্বার্থ মামলা হয়েছিল। এই ৬৬-এ ধারায় গ্রেফতার হচ্ছে যার ফলে ভারতের সংবিধানের দ্বারা সাধারণের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সেই মামলায় আমিও একটা পার্টি ছিলাম। ২০১৫ সালে ২৪ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত রায় দিল। স্পষ্ট ভাবে বলল, এই ধারাটা অসাংবিধানিক। আজ থেকে বাতিল। আরও নির্দেশ দিল এই ধারায় সারা ভারতে নিম্ন আদালতে যত মামলা চলছে, তা বন্ধ করতে হবে। তারপরেও মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। ২০১৫ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত, অর্থাৎ ৮ বছর লাগল মামলা থেকে বেরিয়ে আসতে।

প্রশ্ন- অবশেষে কবে অব্যহতি মিলল?

অম্বিকেশ মহাপাত্র- একটা তড়িঘড়ি শুনানি নিয়ে আদালত ২০২১ সালে ১৪ সেপ্টেম্বর অর্ডার দেয়। সেখানে লেখে, ৬৬-এ ধারা থেকে অম্বিকেশ মহাপাত্রকে অব্যহতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু, মামলা থেকে নয়। এই খবরটা অর্ডার হিসাবে পাওয়ার পর আমি বিস্মিত হই। ২০২১-এর ডিসেম্বর চ্যালেঞ্জ করে মামলা দায়ের করি। ২০২২ সালে ১০টা শুনানি হয়। ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি জেলা আদালত থেকে চূড়ান্ত রায় এল। বিচারপতি পরিষ্কার রায় দিয়েছেন। পরে নিম্ন আদালতে যে মামলা হয়েছে, সেখান থেকে অব্যাহতি মেলে।

প্রশ্ন- কোর্টে চক্কর কাটা, সময় ব্যয় আপনাকে কতটা বিদ্ধ করেছে?

অম্বিকেশ মহাপাত্র- ১১ বছরে প্রায় ৭০ দিন শুনানির দিন ধার্য হয়েছিল। সব তারিখে শুনানি হয়েছে তা-ও নয়। কোনও দিন বিচারপতি নেই, আদালতে ছুটি। তবু কম করে আমি ৪০ দিন আদালতে গিয়েছি। তারিখের পর তারিখ পড়েছে। সময় নষ্ট, অর্থ নষ্ট, বিরক্তি, হয়রানি, হেনস্তা তো ছিলই। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আমার পাসপোর্ট সংক্রান্ত। নানা ঝঞ্ঝাট পার করে তা রিনুয়াল করা গিয়েছে। আদালতের অনুমতি সত্ত্বেও পুলিশি ভেরিফিকেশনে সমস্যায় পড়েছিলাম।

প্রশ্ন- যে কার্টুন ছবি তোলপাড় ফেলেছিল, তা বাইরে এল কী করে?

অম্বিকেশ মহামাত্র- ইমেলে আমার কাছে এসেছিল। আমি আমার বন্ধুদের ইমেলে পাঠিয়েছিলাম। এর বেশি কিছু না। এটা ফেসবুকেও লোকে শেয়ার করেছিল। এখন হাতে হাতে স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট। ফেসবুক থেকে টুইটার, সেখান থেকে ইমেলে যাওয়া। সেখান থেকে খবরের কাগজে যাওয়া।

প্রশ্ন- সবাই জানত আপনার তৈরি?

অম্বিকেশ মহাপাত্র- আমি এটা বানাতে পারলে গর্ববোধ করতাম। কার্টুন আমি কখনও বানাইনি। তবে প্রচুর শেয়ার করি। ভালো লাগে। কার্টুন দেখলে বোঝার চেষ্টা করি। নিজে কখনও আঁকিনি।

প্রশ্ন- লকআপের অভিজ্ঞতা….

অম্বিকেশ মহাপাত্র- সেটা এক দুঃসহ রাত। জীবনেও ভাবিনি এমন ঘটনার সম্মুখীন হব। লক-আপ মানে ছোট্ট ঘর। রাত কাটাচ্ছি। কোণায় নোংরা। তখন পূর্ব যাদবপুর থানা। একটা ডিম লাইট জ্বলছে ওপরে। একটা গরাদ ছাড়া জানালা-দরজা কিছু নেই। ভ্যাপসা গরম, ভীষণ নোংরা। শুয়ে পড়ার কোনও অবস্থা ছিল না। খাওয়া বলতে রুটি, তরকারি আর কাঁচা পেঁয়াজ জুটেছিল। ব্যথা পাওয়ায় নোংরা মেঝেতেই শুয়ে ছিলেন সুব্রত সেনগুপ্ত।

প্রশ্ন- কার্টুন কি প্রতিবাদের বড় মাধ্যম?

অম্বিকেশ মহাপাত্র- প্রতিবাদ শুধু নয়, মজাটা ভাগ করার জন্য শেয়ার করেছিলাম। খুবই ইন্টারেস্টিং ছিল। তার মধ্যে একটা বক্তব্যও ছিল, দেখতে পাচ্ছ মুকুল, সোনার কেল্লা। আমার তখন সত্যজিতের সিনেমার কথা  মনে পড়েছে। যেখানে বলছে, ওটা দুষ্টু লোক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছে, ভ্যানিস। এই যে মজাটা। সমকালীন বিষয়ে, তখন যেটা ঘটেছিল। ভারতীয় সংসদে নজীরবিহীন ঘটনা ঘটেছিল। রেল বাজেট পেশ করেছেন দীনেশ ত্রিবেদী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে বলেছেন রেলমন্ত্রীকে সরাতে হবে। জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় সরতে হল দীনেশ ত্রিবেদীকে। রেলমন্ত্রী হলেন মুকুল রায়। ছিলেন বাজেট পেশের সময় এক রেলমন্ত্রী, আর বাজেট পাশের সময় আরেক রেলমন্ত্রী। দীনেশ ত্রিবেদী ভ্যানিস, মুকুল এসে গেল।

প্রশ্ন- বামপন্থী বলেই কি আপনার ওপর এই ঘটনা?

অম্বিকেশ মহাপাত্র- আমি কিন্তু সক্রিয় রাজনীতি করি না। বামপন্থার প্রতি ভালোবাসা ছিল, সেটা সবাই জানে। সব থেকে বড় কারণ, মমতা বলেছিলেন বদলা নয় বদল চাই। ক্ষমতায় এসে গণতন্ত্র নিধন করবেনই। এটা তাঁর এজেন্ডা।

kolkata police Mamata Banerjee Arrest
Advertisment